ফানি ফ্যামিলি

শনিবার। কিচেনে বসে আছি। মস্কো এলে আমি এখানেই সময় কাটাই টিভি, কম্পিউটার আর চা এখানে থাকে বলে। সেভা গেম খেলছে আর আমি ওর চুল শুকাচ্ছি। এটা সেভার  প্রিয় কাজ। আমি মস্কো এলেই বারবার স্নান করতে হবে আর আমাকে দিয়ে চুল শুকাতে হবে। অনেক সময় একটু বিরক্ত হলেও করি। মনে পড়ে নিজের ছেলেবেলার কথা। বাবা সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন  খদ্দেরদের নিয়ে। খদ্দের না থাকলেও গুদাম ঘরে বসে খবর কাগজ বা বই পড়তেন। আমি বিকেলের জন্য অপেক্ষা করতাম যখন বাবা আমাকে কোলে করে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন রংখোলায়। এটা আমাদের পুরানো বাড়ি। নদীর ভাঙ্গন শুরু হলে বাড়ি ভেতরে নিয়ে আসে আর ওখানে গড়ে সুতা রঙের খারখানা। তাই বাবা কাকারা ওটাকে পুরানো বাড়ি বললেও আমাদের কাছে তা  রঙখোলা  নামেই পরিচিত ছিল। আমি সুখে চোখ বন্ধ করে ঘাপটি মেরে থাকতাম বাবার কোলে আর ভাবতাম যদি সন্ধ্যাটা শেষ না হতো! এখন সেভাও তাই করে। চুল শুকিয়ে গেলেও বলে, না এখনও হয় নি, যে ওখানে ভেজা। যদি বলি না আর পারব না, তখন মাথা বা পিঠ চুলকিয়ে দিতে বলে। আমিও ভাবি, এইতো আর কয়েক দিন, তারপর বড় হয়ে যাবে, আর মাথা চুলকাতে দেবে না। যেমনটা মনিকা আর ক্রিস্টিনা কয়েক বছর আগেও বসে থাকতো চুল শুকানর জন্য, এখন আর বলে না, বড়জোর জামার পেছন দিকে বা জুতায় চেন লাগাতে ঝামেলা হলে সাহায্যের জন্য ডাকে। এখনও আমি এলেই ওরা বসে থাকে কখন আমি চা ঢালবো ওদের জন্য। যদি কখনো বলি ঢেলে  নিতে, না খেয়েই ক্লাসে চলে যায় বা ঘুমিয়ে পড়ে। মনে পড়ে বাড়ির কথা। আমাদের বাড়িতে সব সময়ই অনেক কাজের লোক ছিল। এক সময় রান্নাবান্না তো বটেই, এমনকি খাবারও তারাই পরিবেশন করত। আমি ক্লাস থেকে ফিরে মার কাছে খাবার চাইলে মা যখন ননীদিকে ডাকতো, আমি বলতাম, তাহলে আর বাড়িতে খাবার দরকার কি, আমাদের হোটেলে খেলেই তো হয়। মা, দিদি বা বৌদি মানে বাড়ির কেউ না দিলে আমি খেতে চাইতাম না। তাই এখানেও ছেলেমেয়েদের আবদার মানতে হয়, কাজ থাকলেও ঢেলে দেই ওদের চা অথবা বেড়ে দেই ওদের খাবার। শত হলেও আমি তো আসি ওদের কাছেই, দুদিন ওদের সঙ্গ দিতে।  
যাহোক, সেভার চুল শুকিয়ে দিচ্ছিলাম আর গল্প করছিলাম। কয়েকদিন আগে শুক্রবার যখন দুবনা  থেকে আসছি, হঠাৎ আন্তনের ফোন।
-   পাপ, তুমি কি মস্কো আসবে?
-   হ্যা, আমি অলরেডি মস্কোয়। কেন কি হয়েছে?
-   সেভা বাসায় নেই। মামা খুব টেনশনে আছে।      
-   এখন তো তেমন রাত হয় নি। ফুটবল খেলতে গেছে বোধ হয়।
-   না। আমরা ঝগড়া করেছি। প্রায় মারামারির মত। এরপর বেরিয়ে গেছে।
-   ঠিক আছে, দেখছি।
ফোন করার চেষ্টা করলাম সেভাকে। ফোন অফ। তখন সাড়ে নয়টা মত বাজে। আন্তনের উপর মেজাজ খারাপ হোল। ভাবলাম, বাসায় ফিরি, তারপর দেখি কি করা যায়। তবুও গুলিয়াকে ফোন করলাম সেভা  কোথায় জানার জন্য। ফোন ধরলো সেভা।
-   আজ ফুটবল খেলতে যাসনি?
-   না, মাঠ ভেজা।
বাসায় ফিরে দেখি সব থমথমে। আন্তন আমার অপেক্ষা না করেই ওর ডেরায় চলে গেছে। ছুটির কদিন এদিকে পা মারায় নি। গুলিয়া ডিপ্রেসড। বললো একটু ওয়াইন ঢালতে। এরপর অনেক দিন কেটে গেছে। আজ নিজেই সেভাকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছিলো।
-   কিছু না। আন্তন গেম খেলছিল, আমি বসে বসে দেখছিলাম।
-   তারপর?
-   তারপর আর কি? একটু ঝগড়া।
-   জিতলো কে?
-   কেউ না। ড্র হয়েছে।
-   মানে?
-   আমি হার স্বীকার করি নি। পরে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছি।
কিছুক্ষন চুপ থেকে আবার কথা শুরু হোল।
-   সেভা, পড়াশুনা করা দরকার। শুধু গেম খেললে তো জীবন চলবে না।
-   আমার ভালো লাগে না। স্কুলে যা পড়ায়, আমি বুঝি না ওটা আমার কি কাজে লাগবে।
-   আমরা জীবনে যা কিছু করি সব আমাদের কাজে লাগে না। তবে যেকোনো লক্ষ্যে পৌঁছুতে হলে অনেক অপ্রিয় কাজও করতে হয়। ফুটবলেও গোলে স্যুটকরার আগে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বলটা গোলবারের কাছে আনতে হয়।
-   কিন্তু বেশ কিছু বিষয় আমি একেবারেই বুঝি না।
-   তা আমাকে জিজ্ঞেস করলেই পারিস।
-   তুমি যেভাবে বোঝাও তাতে আমার মাথা কিউব সাইজ হয়ে যায়। দ্বিঘাত সমীকরন বোঝাতে গিয়ে তুমি প্যারাবোলা আঁক, একটা অঙ্কের মধ্যে তুমি হাজারটা উত্তর দিয়ে দাও। তে আমার মাথা ব্যথা শুরু হয়।
একটু থেমে কি যেন ভেবে আনবার বললো
-   হয়ত অন্যেরা তোমার কথা বোঝে, কিন্তু আমার মনে হয় তুমি অনেক কঠিন করে এগুলো বোঝাও। 
আবার বিরতি, সেভা তার ট্যাঙ্ক নিয়ে ব্যস্ত।
-   পাপা, তুমি কত বেতন পাও?
বললাম।
-   অনেক।
-   নারে। আমাদের কোন রকম চলে যায়।
-   কারন আমাদের বড় সংসার। কিন্তু তুমি একা থাকলে এটা তো ভালো বেতন।
-   কিন্তু আমি তো একা নই।
-   আমার মাসে ২৫৩০ হাজার রুবল হলেই চলবে।
-   কিন্তু তার জন্যেও তো পড়াশুনা করা দরকার। পড়াশুনা না করলে টাকা উপার্জন করাও বেশ কষ্ট। তা ছাড়া  আজকের বাজারে ওটা খুব বেশী টাকা নয়। বিয়ে করবি না?
-   না।
ভালো লাগলো সেভার মুখে অল্প চাহিদার কথা শুনে। আমার মনে হয় আমাদের চাওয়া-পাওয়ার সমীকরণ থেকেই হাজারো কষ্টের, হাজারো সমস্যার উদ্ভব। চাওয়া পাওয়ার ভারসাম্য না থাকলেই জন্ম নেয় অসুখ – নিজের বা প্রতিবেশীর – না পাওয়ার হতাশায় অথবা অতি পাওয়ার গর্বে। এই সমীকরণে পাওয়াটা আমাদের কন্ট্রোলের বাইরে, কিন্তু চাওয়াটা আমরা নিশ্চয়ই সীমানার মধ্যে রাখতে পারি। বুদ্ধ এ জন্যেই বলেছিলেন – “যদি সুখী হতে চাও নিজের লোভ সম্বরণ কর।“   
এর মধ্যে মামা ফিরে এলো তার বোনের বাসা থেকে। শনিবার করে বোনের বাসায় যায় তার কেনাকাটি করার জন্য, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে দিতে। আর বাসায় ফেরে বদ মেজাজ নিয়ে। এসেই দেখে বেসিন আর টেবিল ভর্তি নোংরা বাসন। ওর অভ্যেস দোকানে গেলেই এক আধটা করে প্লেট গ্লাস কেনা। ঘরে রাখার জায়গা নেই, কিন্তু কেনার শেষ নেই। আর বাচ্চারাও একটার পর একটা পরিষ্কার প্লেট গ্লাস নিয়ে নোংরাটা ফেলে রাখে। আমি বলি, সবার যদি  একটা করে সেট থাকতো, তাহলে খেয়ে সবাই ধুয়ে রাখতো, আর না রাখলেও প্রয়োজনে ধুয়ে নিত।
-   সেভা, প্লেট কাপগুলো ধুয়ে ফেল।
-   মাম। পারবো না।
-   আজ মায়ের কথায় করছিস না, বউ বললে একটা নয়, দশটা ধুবি।
-   বললাম তো পারব না। আমার ভাল লাগে না। বড়জোর টেবিলটা পরিষ্কার করতে পারি।
-   কেন করলে কি হবে? তুই কি পুরুষ না নাকি? দাও তো ওর ট্যাঙ্কে দড়ি বেধেটানুক এদিক-সেদিক।
-   বললাম তো আমি টায়ার্ড। রেস্ট নেবো।
-   রেস্ট নিতে হয় মরার পরে, কফিনে শুয়ে। আর জীবনে কাজ করে আনন্দ পেতে হয়।
এর মধ্যে মনিকা ক্রিস্টিনা চলে এল।
-   পাপা, আজকের মেন্যু কি?
-   মুরগী আর নুডলস।
-   কেন মাংস আনার কথা ছিল না।
-   মাকে বললাম কিনে আনতে। গেল না। কি আর করা।
গুলিয়া রুটির খোঁজ করলো। নুডলস খাবে না।
-   কেন, নুডলস খেলে কি হবে।
-   মামা ডায়েট কন্ট্রোল করছে।
-   কবে থেকে?
-   আজ থেকে।
-   তোমার ডায়েট কন্ট্রোলের দরকার নেই। ওটা আমার দরকার।
-   তোমার কেন?

-   যাতে আমাকে পুড়াতে কম লাকড়ি লাগে। তুমি তো কফিনে শুয়ে রেস্ট নেবে বললে। গায়ে চর্বি থাকলে মরার পরও ঠাণ্ডা কম লাগবে আর পচতেও অনেক সময় লাগবে। তাতে রেস্টটা জমবে ভালো। সেভা, যা দোকান থেকে একটা কেক নিয়ে আয়। মামা যখন ডায়েট করবেই, কেকটা খেয়েই করুক।


মস্কো, ১৩ মে ২০১৭         



    

Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি