সেপ্টেম্বর ০৬, ১৯৮৩


সকাল থেকেই বাড়িতে ভীষণ ব্যস্ততা। রান্নাবান্না, ব্যাগ গোছানো। কাজের কি শেষ আছে? ব্যাগ অবশ্য অনেক আগে থেকেই গোছানো ছিল। তবুও শেষ মুহূর্তে দেখছে সবাই। বাবা বার বার জিজ্ঞেস করছেন এটা দেওয়া হল কিনা, সেটা দেওয়া হল কিনা। শত হলেও এক অচেনা অজানা দেশে যাচ্ছে বাড়ির ছোট ছেলে, এই প্রথম একা একা যাচ্ছে বাড়ি ছেড়ে। চিন্তার শেষ নেই। আগস্টের মাঝামাঝি খবর আসে যে আমি সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করতে যাচ্ছি সিপিবির স্কলারশিপে। যেহেতু এতে সরকারি অনুমোদন ছিল না আর দেশে চলছিলো এরশাদের অপশাসন, তাই যতক্ষণ না বিমানে উঠে বসছি এক ধরণের অনিশ্চয়তা থেকেই গিয়েছিল। ব্যাপারে পার্টি অফিস থেকেও সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল। আমরা যেন কোন মতেই না বলি সোভিয়েত ইউনিয়নে যাচ্ছি লেখাপড়া করতে, জিজ্ঞেস করলে যেন বলি ওখানে ভাই বা কোন নিকটাত্মীয় থাকেন, তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। বানিয়ে কথা বলা, বিশেষ করে শেখান বুলি আওড়ানো আমার জন্য সবসময়ই সমস্যার। টেনশন তাই কম ছিল না। তাছাড়া এর আগে দু দুবার মানে ২২ ২৯ আগস্ট ঢাকা থেকে ফিরে এসেছি শেষ মুহূর্তে টিকেট আসেনি বলে। সব মিলে সকালটা ছিল বেশ উত্তেজনাপূর্ণ। তাছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার ব্যাপারটা ঠিক হয়ে গেলে আমি আগস্টের মাঝামাঝিই বুয়েটের ক্লাস বাদ দিয়ে বাড়ি এসেছি শেষ কয়েকটা দিন সবার সাথে কাটাব বলে। দিন অনেক রাত জেগে গল্প করতাম সবাই। প্রায়ই ছোটবেলার স্মৃতিচারণ ছিল এসব আড্ডার প্রধান বিষয়। তবে এটাও ঠিক, তখন আমার মনে হয়েছিল এ যাত্রা বছর ছয়েক বা বড়জোর দশ বছরের জন্য। আমি তখন থেকেই ঠিক করেছিলাম যদি যাই পিএইচডি করেই ফিরব। তবে সে যাত্রা যে সারা জীবনের জন্যই হবে সেটা কারো মাথায় আসেনি, আমার তো নয়ই।
মা অসুস্থ, তাই বাড়িতেই মার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আমাদের বাড়িতে আমরা কখন যাই বলতাম না, আর যাই বললে মা বলতেন, “যাই বলতে নেই, বল আসিমা আসিবলে মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেলাম বাসস্ট্যান্ডে। বাবা, দিদি, সুধীরদা, বউদি, তপনদা, রঞ্জিতদা, বাবলুদা, রতন, ভ্রমরসহ বাড়ির প্রায় সকলেই এলো আমাকে বাসে উঠিয়ে দিতে। ঠিক হল রতন যাবে আমার সাথে এয়ারপোর্টে। সবার মন খারাপ, অথচ সবাই চেষ্টা করছে হাসিঠাট্টায় পরিবেশটা হাল্কা রাখতে। বাসে উঠে বসলাম। তরা ব্রীজের উপর দিয়ে বাস যাচ্ছে ঢাকার পথে। যতক্ষণ না পরিচিতমুখগুলো একে একে মিলিয়ে গেল, তাকিয়ে রইলাম জানালা দিয়ে। ঢাকায় পার্টি অফিসে গিয়ে শুনলাম, আজ সব রেডি। কালিদা বলে দিলেন এয়ারপোর্টে চলে যেতে। ওখানে তিনি সব কাগজপত্র হাতে ধরিয়ে দেবেন।
এয়ারপোর্টে এসে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বললাম রতনের সাথে। খেলাঘর নিয়ে মূলত কথাবার্তা। আসলে দিনগুলোয় আমরা সংগঠন নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে খেলাঘর, উদীচী এসবের কথাই বেশি হত। এক সময় ডাক পড়ল ভেতরে যাওয়ার। রতনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে, বললাম, যেন চলে না যায়, আমি ইমিগ্রেশনের কাজকর্ম সেরে আবার কথা বলব। তখন তো এখনকার মত এত অভিজ্ঞতা ছিল না, পৃথিবীটা ছিল আমার গ্রামের মতই খুব সহজ সরল, আমলাদের বিধিনিষেধের বাইরে। ইমিগ্রেশন পার হয়ে বুঝলাম, ওপারে চলে এসেছি, এখন আর চাইলেই পা টা অন্য পারে রাখা যাবে না। ঘুরতে শুরু করলাম এয়ারপোর্টের ভেতরে। চোখ এয়ারপোর্টের কাঁচের বিশাল দেয়াল ভেদ করে খুঁজছিল রতনকে। শেষ পর্যন্ত পেয়েও গেল। কি যেন বলতে চেষ্টা করছে, আমিও বলছি। ওকে বললাম জোরে বলতে, কিচ্ছু শুনতে পারছি না। কিছুক্ষন পরে বুঝলাম, আসলে কাঁচের দেয়াল ভেদ করে আমাদের কথা একে অন্যের কাছে পৌঁছতে পারছে না। কলম আর কাগজের টুকরো এলো সাহায্যে। লিখলাম, বাড়ি যা, আমি মস্কো পৌঁছে চিঠি দেব। তোরাও লিখিস।
এরোফ্লতের বিমানে পাশের সিটে বসে ছিল ইকবাল। আর ছিল জালাল, আনোয়ার, শুভ, মুফিজ। যদি ভুল না করি আরিফ, কল্লোল, আজাদ, দীপঙ্করও ছিল এই ফ্লাইটে। প্লেন উড়ল ঢাকা থেকে। একটু পরেই আমি জানালা দিয়ে নিচের দিকে খুঁজতে শুরু করলাম আমাদের গ্রাম, তরার ব্রীজ। ঢাকা থেকে অনেক প্লেন তখন যেত আমাদের গ্রামের উপর দিয়ে। কিন্তু উপর থেকে দেখলাম বাংলাদেশের সব গ্রামের চেহারা প্রায় একই রকম। এর মধ্যে তরা খুঁজে বের করা ছিল এক রকম অসম্ভব কাজ।
প্রথম যাত্রা বিরতি বোম্বাই। হাফপ্যান্ট পরা পুলিশেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে এয়ারপোর্টে। আমরাও এক ঘণ্টার এই বিরতিতে বোম্বাইয়ের এয়ারপোর্টে একটু ঘুরে বেড়ালাম। এরপরের যাত্রা বিরতি ছিল করাচীতে। ওখানে নামতে দেয়নি। বসেই ছিলাম পুরোটা সময়। নামার ইচ্ছেও হয়নি। এর পরের যাত্রা বিরতি তাসখন্দে। এটা সোভিয়েত উজবেকিস্তানের রাজধানী। সেখানে আমরা নামলাম বেশ রাতে। বেশ ঠাণ্ডা ছিল বাতাসে আর ছিল সমাজতন্ত্রের গন্ধ। খান থেকে উড়াল দিয়ে মস্কো যখন নামি সকাল হয়ে গেছে। পাইলট আসন্ন অবতরণের ঘোষণা দিতেই জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম মস্কো। নিচে শুধু লাল হলুদ আর সবুজের খেলা। শরতের ছোঁয়া লেগেছে প্রকৃতির গায়ে আর মনে। রঙ বেরঙের পোশাকে সেজে সে স্বাগত জানাচ্ছে নতুন অতিথিদের। মস্কো নেমে আমাদের আবার ইমিগ্রেশন পার হতে হল। বেরিয়ে এসে দেখি অনেক বাংলাদেশি ভাইয়েরা অপেক্ষা করছেন আমাদের জন্য। পরিচয়ের পালা শেষ। এবার নতুন যাত্রা। আমরা যারা প্যাট্রিসে মানে গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব তারা যাচ্ছি ইউনিভার্সিটির বাসে করে স্টেলে, অন্যেরা যাবে ইউনিভার্সিটি হোটেলে, অপেক্ষা করবে তাদের পরবর্তী গন্তব্য জানার।
বাসে করে শারদীয় মস্কোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছলাম মিক্লুখো মাক্লায়ার হোস্টেলে। শুরু হল নতুন জীবন। সোভিয়েত জীবন। দিনটা ছিল ০৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩, আজ থেকে ঠিক ৩৫ বছর আগে।

দুবনা, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮           


         

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি