পায়ের মাথাব্যাথা


আমার শরীর যে অসুখ-বিসুখের হোস্টেল এটা অনেক আগে থেকেই জানতাম, তবে ইদানিং মনে হচ্ছে এটা ওদের বাপের বাড়িতে পরিণত হয়েছে। বেড়াতে এলে আর যেতে চায় না, আবার আসেও সাধারণত ছুটির দিনে ঠিক যেমন চাকুরীজীবীরা আসে সপ্তাহের কাজের শেষে গ্রামের বাড়ি দু’দিন রেস্ট নিতে।
গত রোববার ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে দেখি বাম পা টা আলসেমি করছে। ডান পা হলে হয়তো এতোটা বিচলিত হতাম না, তবে বামপন্থায় বিশ্বাসী মানুষদের জন্য বাম পায়ের গুরুত্বই আলাদা। রোববার বলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া হল না। সোমবার ক্লাস, মস্কো যেতে হল। আমি আবার দাঁড়িয়ে বা বসে পড়াতে পারি না, অনবরত হাঁটি। পায়ের উপর চাপ পড়ল। ক্রিস্টিনাকে বললাম আমাকে মিট করার জন্য। কারো জন্য অপেক্ষা করা আমার জন্য এক বিশাল সমস্যা। কেন যেন মনে হয় ঐ লোকটাকে আমি চিনতে পারব না। তাই যতক্ষন না দেখা হচ্ছে টেনশনে সময় কাটে অথবা বলা চলে সময় কাটে না। এ জন্য বউ আমার সাথে বাইরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে না। জানে আমি ঠিক উল্টোপাল্টা কিছু একটা করে কোথাও চলে যাব। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এক সময় ফোন করলাম ক্রিস্টিনাকে। ট্রেনের শব্দে কথা বোঝা গেল না। লাইন কেটে গেল। বুঝলাম ও এখন মেট্রোতে। আবার অপেক্ষা। অনেকক্ষণ পরে ওর ফোন এল।   
-   তুমি কোথায়?
-   কেন, তোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি দোকানের সামনে।
-   আমি তো তোমার জন্য মেট্রোতে অপেক্ষা করছি। ঠিক আছে। তুমি দাঁড়াও। আমি আসছি।
বেশ কিছুক্ষন  পরে রাস্তার উল্টোদিকে ওর দেখা মিলল। ভিড়ের মধ্য থেকে আমাকে হাত নাড়াচ্ছে। আমি হাত নেড়ে জানালাম নিজের উপস্থিতি। বাড়িতে একমাত্র ক্রিস্টিনাই আমার কাজ সম্পর্কে জানতে চায়। এসেই জিজ্ঞেস বলল
-   প্রিভিয়েত (শুভেচ্ছা)! ছাত্রদের যন্ত্রণা দেওয়া আজকের মত শেষ হল?
-   প্রিভিয়েত! হ্যাঁ। আজকের মত শেষ।
-   কি পড়াও তুমি?
-   রিলেটিভিটি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স আর ইলেক্ট্রোডাইনামিক্স।
-   ছাত্ররা বোঝে কিছু?
-   এটা তো ওদের সমস্যা। আমি প্রথম দিনই বলেছিলাম, যারা ফেল করতে চাও হাত তোল। আমি অটোম্যাটিক্যালি সেটা করিয়ে দেব। কেউ রাজি নয়, মানে নিশ্চয়ই বুঝে বা বুঝতে চায়।
সোমবার করে সাধারণত সেভা আমাকে মিট করে। আমি ওদের সপ্তাহের বাজার করে দিই। আমি ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে সেটা করে ওদের জন্য রান্নাবান্না করে দুবনা চলে যাই রাতের বেলায়। আজ সেভার ক্লাস দেরিতে শেষ হবে, তাই ক্রিস্টিনা এল। টুকটাক কেনাকাটি করলাম। কেনাকাটি মানে রেডিমেড ফুড। মনিকা ক্রিস্টিনা বাইরেই বেশি খায়, সেভা প্রয়োজনে এটা সেটা সেদ্ধ করতে পারে। বাসায় কাজকর্ম থাকলেও সেটা করা হল না পায়ের আলসেমির কারণে। রাত নয়টায় ব্লাব্লা কার বুকিং দিলাম দুবনা ফিরব বলে। গত বছর দেড়েক ধরে ব্লাব্লা কারে জার্নি করছি। ওরা আমাকে প্রায় সবাই চেনে। ব্যাপারটা এ নয় যে আমি খুব কেউকেটা কেউ। আমার এক্সোটিক চেহারা ওরা সহজেই মনে রাখে এই আরকি। আমি সাধারণত সময় মত পৌঁছুই। গতকালও ব্যতিক্রম ছিল না। তবুও আলেক্সেই ফোন করলো
-   তুমি কোথায়?
-   এইতো মেট্রো থেকে বেরুবো। তুমি কোথায় অপেক্ষা করছ।
-   বাসস্ট্যান্ডের পাশে। তুমি এর আগে আমার সাথে গেছ ওখান থেকে। সাদা রঙের গাড়ি।
কিন্তু আমি ওকে কিভাবে বুঝাই আমি গাড়ির ব্র্যান্ড, রঙ কিছুই মনে রাখি না বা রাখতে পারি না। ফর্মুলার বাইরে কোন কিছুই আমার তেমন মনে থাকে না। যাই হোক, ঠিকঠাক দুবনা এসে পৌঁছলাম। আলেক্সেই দেখি আমি কোথায় নামবো সেটাও মনে রেখেছে। তবে আসল পরীক্ষা সামনে। রাতে পায়ের মতিগতি কি হয় কে জানে। যা হোক, রাতটা কাটল ভালোয় ভালোয়। সকালে গেলাম নিউরোলজিস্টের কাছে। আমি তার রেগুলার কাস্টমার সেই ১৯৮৮ থেকে ঘাড়ে স্পন্ডেলাইসিসের বোঝা নেওয়ার পর থেকে।
-   কি হয়েছে?
-   পা টা কথা শুনতে চাইছে না। যেখানেই রাখি, যেভাবেই রাখি – প্রতিবাদ করে।
-   হুম।
-   শরীরের নাটবল্টু ঢিলে হয়ে গেছে। শরীরটাই বদলানো দরকার।  
-   আইডিয়া খারাপ নয়। তবে আপাতত রিপেয়ার করা যাবে। এম আর আই করাতে হবে। সাথে ইঞ্জেকশন আর লেসার থেরাপি।
এই বলে তিরিশটা ইঞ্জেকশন লিখে দিলেন। ওগুলো কিনতে কিনতে মনে মনে ভাবলাম, আচ্ছা কি হত যদি শরীরের বিভিন্ন অংগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মত আন্টাগনিস্টিক হত। যদি পশ্চাতদেশ বলত
-   তোমার পায়ের ব্যথা, আমার তাতে কি? দেব না আমি আমার দেহে সুঁই ফুটাতে?  
আমার জন্য আবশ্য ভালো খবর একটা। গ্রামের স্কুল, মফস্বল শহরের কলেজ, লো প্রোফাইলের ইউনিভার্সিটি, সিচকে রোগ এসব নিয়েই জীবনের অনেকগুলো বছর কেটে গেল। ইদানিং অন্তত নামী দামী রোগেরা বাসা বাঁধতে শুরু করেছে এই জীর্ণ শরীরে। রোগেরা দীর্ঘজীবী হোক!

দুবনা, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ 



  

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি