খেলার পরে খেলা


সারাদিন গতকালের বাংলাদেশ – ভারত এশিয়া কাপ ক্রিকেটের ফাইনাল নিয়ে হাজারো পোস্ট দেখছি। আমি কোন খেলাতেই বিশেষজ্ঞ নই, ক্রিকেটে তো নয়ই। সব খেলাই দেখি রিল্যাক্স করার জন্য, আইনের মারপ্যাঁচে না গিয়ে খেলা দেখি। খেলা দেখা মানেও স্কোর দেখা মাঝে মধ্যে কাজের ফাঁকে ফাঁকে। জানি যদি কাজ নাও করি, দু মিনিট পরেই অন্যমনস্ক হয়ে যাব কিছু একটা ভাবতে ভাবতে। এটা মনে হয় যারা অংক বা পদার্থবিদ্যা নিয়ে কাজ করেন তাদের কমন সমস্যা। প্রশ্ন বা সমস্যা মাথার মধ্যে সারাদিন ঘোরাফেরা করে, তাই অন্য যাই করি না কেন সেটা না করার মত। সারাদিন টিভি চলে। মুলত খবর। বউ কোন কথা জিজ্ঞেস করলে বলতে পারি না, কারণ ওসব কিছুই আমার কানে ঢোকে না। এসবই আমার জন্য পার্সোনাল কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের মত কাজ করে, এর বেশি কিছু না। তাই লিটন কিভাবে আউট হয়েছে জানি না, দেখিনি। দেখলেও বলতে পারতাম না ঠিক না বেঠিক – নিয়ম জানি না বলে। যাই হোক, এবারের এশিয়া কাপ ফলো করেছি, ভালো লেগেছে। পাঁচ পাঁচটা বিশ্বমানের দল উপমহাদেশে (শ্রীলংকাকে নিয়ে) – কম কথা নয়। আফগানদের খেলা ভালো লেগেছে, ওরা খেলার জন্যই খেলেছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটা দেশে ওদের অগ্রগতি অকল্পনীয়। ফাইনাল খেলা এঞ্জয় করেছি। অনেকদিন পরে এরকম হার্টবীট ফিল করলাম, শেষের দুই ওভার চোখ বন্ধ করে দেখেছি লাইভ স্কোর। বাংলাদেশের ইনিংসের পরে আশাই করিনি খেলাটা এতো  জমে উঠবে। আমাদের ছেলেরা সেটা করেছে। এটাই বা কম পাওয়া কি? ভালো খেলা মানেই লটারি বা জুয়া এ অর্থে যে আগে থেকে কিছু বলা কষ্ট। যেসব খেলার রেজাল্ট আগে থেকেই বলে দেয়া যায় – সেটা আর খেলা থাকে না। লিটন আউট না হলে কি হতে পারত এ নিয়ে জল্পনা কল্পনা অনেক হতে পারে, প্রতিটি ম্যাচের পরেই, প্রতিটি কাজের পরেই এমন হয়। তবে যদি, কিন্ত এসব নিয়ে কল্পনার ক্যানভাসে ছবি এঁকে মজা পাওয়া যায়, বাস্তবতা তাতে বদলায় না। তাছাড়া এটাও ঠিক প্রতিপক্ষ তার স্ট্রাটেজি ঠিক করে স্কোরবোর্ডের রান দেখে। তার উপরেও যে কথা – ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা। যদি আমাদের ক্রিকেট প্রতিটি ম্যাচে এক দুইজন খেলোয়াড়ের পারফর্মেন্সের উপর নির্ভর করে, তাহলে এটা টিমের জন্য শুভ সংবাদ নয়। লিটনের আউট নিয়ে এতো কথা বলে আমরা আর দশজন যারা ম্যাচটাকে শেষ বল পর্যন্ত নিয়ে এলেন তাদের প্রতি কি অন্যায় করছি না? টিমের প্রতি কি অন্যায় করছি না? তাছাড়া প্রতিপক্ষে যারা ছিল তারাও কিন্তু এই মাশরাফি, মুশফিক, লিটন, ফিজদের মতই তরুনেরা যারা একই রকম আবেগ দিয়ে খেলে, জয়ের জন্য লড়াই করে, আম্পায়ার ভুল করলে এতে তাদের দোষ নেই। যতদূর জানি আম্পায়ার ভুল করলে রিভিউ কল করা যায়। সেটা না করতে পারা এটার দুটো কারণ হতে পারে, হয় সে সুযোগ আগেই হাতছাড়া হয়ে গেছে অথবা ক্যাপ্টেন মনে করেননি তার দরকার আছে। মাশরাফির ইন্টারভিউতে এই আউট নিয়ে কোন কথা শুনিনি। শ্রীলংকার বিরুদ্ধে প্রথম খেলায় তামিম যেভাবে আহত হওয়ার পরেও ব্যাট করেছে আমরা একবাক্যে তার প্রশংসা করেছি। গতকাল কিন্তু যাদব একই রিস্ক নিয়েছে, আমরা সেটা বলতে ভুলে গেছি। তাহলে আমরা কিসের জন্য লড়াই করি – ক্রিকেটের জন্য নাকি দলের জন্য। এখানেও আমরা ব্যতিক্রম নই। আমাদের কাছে দেশের চেয়ে দল বড়। আসলে এ নিয়ে লেখার কোন ইচ্ছাই ছিল না। কিন্তু যতদিন আমরা আমি, আমরা এসবের থেকে বেড়িয়ে আসতে না পারব – সামাজিক বা মানসিক উন্নতির সম্ভাবনা খুব কম। আমাদের বাইরেও বিশাল এক পৃথিবী আছে, যেখানে ওরা থাকে। আমাদের এই সেক্টেরিয়ান মনোভাব নিয়ে আমরা কখনই সেই বৃহত্তর আমরার অংশ হতে পারব না, বিশাল তোমাদের মাঝে ছোট্ট আমরা হয়ে থাকব। গতকাল খেলার পরে মনে হয়েছিল, ক্রিকেট জিতল, জিতল ভারত, বাংলাদেশ, আফগানিস্থান। কিন্তু আজকের পোস্ট পরে মনে হল ভারতের জয় আমরা মানিনি, বাংলাদেশের হারকেও মানিনি, মুল্য দেইনি আফগানদের সুন্দর খেলার। আর সব মিলে হেরেছে ক্রিকেট। কারো কারো পোস্টে দেখলাম অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড আর ভারতকে বাদ দিয়ে খেলার কথা। ওদের বাদ দিলে মনে হয়না দক্ষিন আফ্রিকা এই ডিভিশনে খেলবে। হবে দুটো ডিভিশন আর আমরা পড়ব সেই সেকেন্ড ডিভিশনে। এটাই কি আমরা চাই? দেশপ্রেম ভালো, তবে তার অর্থ এই নয় অন্যদের ঘৃণা করতে হবে, বিশেষ করে সেই ঘৃণার ফলে যদি আলটিমেটলি ক্রিকেটটাই না হয়ে যায়। আমি সিওর লিটন না হলে আমরা অন্য এক কারণ বের করতাম, কারণ আমরা খেলাকে খেলা হিসেবে না নিয়ে যুদ্ধ হিসেবে দেখি। কিছুদিন পরে সাকিব, ফিজ অনেকেই এই রোহিত, যাদব এদের সাথে এক টিমে খেলবে, বন্ধুত্ব করবে। তাই ক্ষনিকের উত্তেজনায় খেলাটাকে নীচে না নামিয়ে আনলেই ভালো। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত টিমকে টপকে রানার্স আপ হওয়া এটাই কি কম কথা? ক্রিকেট বা যেকোনো খেলা শুধু খেলোয়াড়দের খেলাই নয়, দর্শকদেরও খেলা। আমাদের উপরেও এই খেলার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। এটা মনে রেখেই আসুন আমরা খেলা দেখি, খেলার আলোচনা সমালোচনা করি আর মাঠে যারা খেলে তাদের পারফর্মেন্সের মর্যাদা দিই। দল নির্বিশেষে সকল খেলোয়াড়দের একটা সুন্দর টুর্নামেন্ট উপহার দেওয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।

দুবনা, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮               

          

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি