ভল্গার হাওয়া


ডাক্তারদের প্রশ্নে আমি আর আমার বউ একেবারে বিপরীত মেরুর বাসিন্দা ও ডাক্তারের কাছে যাওয়া একেবারেই পছন্দ করে না বাচ্চাদের ডেলিভারি ছাড়া আর কখনও ও ডাক্তারের দুয়ার মাড়িয়েছে বলে মনে পড়ে না এমন কি সেই ২০১৫ সালে দাঁত উঠিয়ে সব ঠিকঠাক করে আর ওদিকে পা বাড়ায়নি দাঁতগুলো লাগানোর জন্য অগ্রিম টাকা পে করার পরেও আমার ঘটনা আলাদা আমার মনে হয় শরীরের সমস্যা এটা ডাক্তারদের সমস্যা, সেটা ঠিক করা ওদের কাজ তাই কিছু হলেই হাজির হই ওদের দুয়ারে অ্যাসিডিটির সমস্যা আমার অনেকদিন থেকে এবার তাই ভাবলুম যাই দেখি ডাক্তারের কাছে সব শুনে ডাক্তার পাঠালেন গ্যাস্ট্রস্কোপি করাতে ছোট একটা গ্যাস্ট্রিক মত আছে সেটা আমি ওদের ছাড়াই জানতাম এসব জানার জন্য পেটের ভেতর এত দামী নল ঢুকাতে হয় না, অল্প পয়সায় এক দুই পেগ ভদকা চালান দিলেই হয়। এই ফ্রন্টে সে অর্থে কোনই পরিবর্তন ঘটেনি রপর ডাক্তার পাঠালেন অ্যাবডোমেনের আল্ট্রাসনো করাতে সিস্টার বলে দিল কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে নির্ধারিত দিনে গেলে ডাক্তার সব দেখে বললেন, “পেটে প্রচুর গ্যাস তবে এর আগে যেমনটা ছিল তার চেয়ে তেমন পরিবর্তন ঘটেনি যাও, ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখাও, দেখ কি বলে আমার মনে পড়ল নিয়ম মেনে অনেক কিছু বাদ দিলেও আগের দিন খিচুরি ঠিক খেয়েছিলাম। গ্যাসের খনি ওখানেই ছিল। এরপর ডাক্তার পাঠালেন গ্যাস্ট্রো-অন্টলজিস্টের কাছে উনি দেখে বললেন অ্যাবডোমেনের এম আর আই করাতে ফোন করলাম। সিস্টার বলল ওখানে যেতে আর বারবার বলে দিল ফলমূল, শাকসবজি, ভাজাপোড়া এসব না খেতে। খাওয়া যাবে সেদ্ধ মাংস, ভাত এসব। ও যদি জানত পোড়া খাওয়াটা আমার নিত্যদিনের রুটিন! আমি তৈরি হলাম। কিন্তু সমস্যা হল কী খাবনা সেটা বুঝলাম ঠিকই কিন্তু কী খাবো সেটা নিয়ে ঘটলো সমস্যা। কারণ  আসলে “না” শব্দটা আমার খুব অপছন্দ, যদিও সেটা বলতে আমি কার্পণ্য করি না। ছোটবেলা থেকেই “না” শব্দ বলতে গেলে শুনিনি, আমি নিজেও চেষ্টা করি ছেলেমেয়েদের “না” না করতে। যেকোনো নিষেধাজ্ঞা আমার মধ্যে এক ধরণের প্রতিবাদ সৃষ্টি করে, এতে হয় হিতে বিপরীত। যাহোক গেলাম এম আর আই করাতে। রিসেপশোনে জিজ্ঞেস করায় বলল ৪০ থেকে ৫০ মিনিট লাগবে। এটা আমার জন্য নতুন নয়। প্রথম এম আর আই করাই ২০১২ সালে ঘাড়ে। জিজ্ঞেস করল বদ্ধ জায়গায় ভয় পাই কিনা মানে ক্লাউস্ট্রফোবিয়া আছে কিনা। আমি কিসে যে ভয় না পাই সেটা নিজেই জানি না। উঁচু থেকে নীচের দিকে তাকাতে পারি না তাই কোন দিনই আমার আর বড় হওয়া হল না। খোলা আকাশের নীচে দাঁড়াতে ভয় পাই পাছে আকাশ ভেঙ্গে পড়ে মাথায়! ভীরের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসে। বদ্ধ বলে মশারীর নীচে ঘুমুতে পারি না। সেই প্রথম বার কি যে ভয় পেয়েছিলাম। মনে হল অপারেটর হয়তো ভুলেই গেছে আমার কথা। যা হোক প্রায় আধঘণ্টা পড়ে ওদের সাড়া পেলে ধড়ে প্রাণ ফিরে পাই। এরপরে করাই ২০১৫ সালে কোমরে। তবে তখন খাবার দাবাড়ের কোন নিয়ম মানতে হয়নি। তাই সিস্টার যখন বলল ২০ থেকে ২৫ মিনিট লাগবে আমার আনন্দ থেকে কে? মনে পড়ে গেল সেই রুশ মহিলার কালো মানিক জন্ম দেওয়ার গল্প। শুয়ে আছি, চারিদিক থেকে ভুতেরা সব কান ঝালাপালা করছে চিৎকার চ্যাচামিচি করে। এই গলা শুকিয়ে আসে তো ঐ দম বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় আধঘন্টা পরে সিস্টার এসে বলল তোমার প্রিপারেশন ঠিক ছিল না, আবার করতে হবে। এক সপ্তাহ পরে এস। আমার তো মাথায় বাজ পড়ল। মনে পড়ল, আমি ভাজা পোড়া খাইনি ঠিকই, কিন্তু অফিসে বসে বসে একের পর এক সল্টেড স্টিক খেয়ে গেছি চায়ের সাথে। তাই আমি বার বার জিজ্ঞেস করলাম, কি খাওয়া যাবে না সেটা বলার দরকার নেই, কি খাওয়া যাবে সেটা বল। সিস্টার বলতে লাগল কি খাওয়া যাবে, আর আমি বললাম এটা আমি খাই না। শেষ পর্যন্ত ও বলেই দিল, দুদিন না খেলে কেউ মরে না। তুমি বরং না খেয়ে থাক। তোমারও মাথা ঘামাতে হবে না খাবার নিয়ে, আমাদেরও তৃতীয় বারের মত তোমার এম আর আই করতে হবে না। এটা অনেক ভালো উপায়। পরের সপ্তাহে এটা ওরা করল প্রায় দেড়ঘন্টা ধরে। ওখান থেকে যখন বেরুলাম নিজেকে মনে হচ্ছিল শ্রয়েডিঙ্গারের বিড়ালের মত – অর্ধ মৃত অর্ধ জীবিত। এরমধ্যে পেটের সমস্যা পায়ে বাসা বাঁধল। আবার এম আর আই। এবার মেরুদণ্ডে আর কোমরে। অল্প সময়ে এতগুলো এম আর আই বউএর পক্ষেও হজম করা কঠিন হল। তাই রাতে বাসায় ফেরার পথে জিজ্ঞেস করল
- কি বলল ডাক্তার?
- কি আর বলবে? হাড্ডিতে জং পড়ে গেছে।
- ওষুধ দিলো?
- ডাক্তার দেখে দেবে। তবে ভালো হবে শরীরটা বদলাতে পারলে?
- তাহলে এসব করার কী দরকার ছিল?
- না জানলে মূর্খ হয়ে মরতাম, এখন জ্ঞানী হয়ে মরব।
- ছাই পড়ুক তোমার মুখে।
- তাতে কিন্তু চুমুর স্বাদটা ছাই ছাই হবে।
- হোক।
ইনজেকশন চলছে, তবে পায়ের প্রতিবাদী ভাষা কমেনি তাতে। দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে আরাম পাচ্ছি না মোটেই। শুধু সাইকেল চালানোর সময় ব্যথাটা পালাচ্ছে। আমি চোখ বুজে হাঁটি, মাঝে মধ্যে সাইকেলও চালাই চোখ বন্ধ করে। এখন সাইকেলে ঘুমানো আর লেখাপড়া করাটা শিখতে হবে। অবশ্য রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে এক সাক্ষাৎকারে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর হাওয়া খাওয়ার জন্য রিক্সা কিনেছিলেন যাতে করে ছাঁদের উপর ঘুরে বেড়াতেন। রিক্সাও একটা অপশন হতে পারে। অন্য কাজকর্মও হবে আবার বিকেলে বউকে নিয়ে ভল্গার তীরে ঘুরে বেড়ানও হবে। সমস্যা একটাই। শীত দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।  

দুবনা, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ 



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি