অসুখের সুখ


অসুস্থ হওয়ার বেশ কিছু ভালো দিকও আছে। আমার পা বাবাজী অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেটা টের পেলাম। পায়ে ব্যথা এটা ঠিক, তবে কষ্ট ছাড়া কেষ্ট মেলে এটাই বা কে বলল।
সোমবার ক্লাস, তাই মস্কো যেতে হল। সেভাকে বলা ছিল মেট্রোতে আমাকে মিট করার জন্য। জ্যামের মধ্যে বসে নিজেকে আপেল, আম, আনারস ইত্যাদি সুস্বাদু ফলের সাথে তুলনা করতে করতে মস্কো পৌঁছতে রাত সাড়ে নয়টা। সেভাকে ফোন করলে বলল,
“দেখি ক্রিস্টিনা বা মনিকা কি করে।“
বুঝলাম ও  হয়তো এইমাত্র গেম শুরু করেছে। ওটা শেষ না করে উঠবে না। মেট্রোতে থাকাকালীন মনিকা ফোন করলো, কিন্তু কথা বোঝা গেল না। স্পরতিভনায়া মেট্রো থেকে তিন মিনিটের হাতা রাস্তে। তাই আর ওদের ফোন না করে নাচতে নাচতে বাসায় চলে গেলাম।  গিয়ে দেখি বরাবরের মতই কাপ প্লেট বাসনকোসন এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমার অপেক্ষায়। বললাম,
“আমার পা ব্যথা, এসব তোমাদের নিজেদেরই করতে হবে।“    
“ঠিক আছে। আমরা কিছুক্ষন আগে বাসায় ফিরেছি। কাল করব এসব।“
পরের দিন সকালে উঠে মেয়েদের পেলাম না। সেভা কলেজে যাওয়ার আগে আমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে এল। আমি অবশ্য একাই যেতে পারতাম। ওকে ডাকলাম, যাতে গেম থেকে উঠে বসে। ও বলল আমি ফেরার সময় ও লেনিনস্কি প্রসপেক্ট থেকে আমাকে নিয়ে আসবে।
ক্লাস শেষে ও ট্রেনে উঠে আমাকে মেসেজ পাঠালে আমিও বেরুলাম। দেখি ও জ্যাকেট ছাড়াই এসেছে। বাইরে তাপমাত্রা দশের নীচে। বৃষ্টি আর দমকা বাতাস। আমি বললাম
“জ্যাকেট নেই কেন। এখন তো বেশ ঠাণ্ডা।“
“আমার ঠাণ্ডা লাগছে না।“
“আমিও এক সময় তাই ভাবতাম আর তার ফলে তিরিশ বছর আগে ব্যথাটা সেই যে ঘাড়ে চেপে বসলো এখনও নামার নেই।“
“আমাকে এসব বাজে বকতে হবে না। ঠাণ্ডা লাগলে আমি পড়ব জ্যাকেট।“
“তুই কি মনে করিস তোকে এভাবে দেখে লোকজন হেরো ভাবছে। সবাই ভাবছে বোকা অথবা তোর পড়ার কিছু নেই।“
“পাপা, আমার বয়েই গেছে লোকজন কি ভাবছে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর।“
“ঠিক আছে। যা, আমি এখানে বসি। তুই দোকান থেকে কিছু সুপ আর মিশার (কুকুর) জন্য কিছু ন্যাপকিন কিনে নিয়ে আয়।“
“তোমার ঠাণ্ডা লাগবে না তো?”
“লাগলে আর কি করা।“   
কাজটা ছিল বড়জোর পনের মিনিটের। সেভার দেখা নেই তো নেই। অপেক্ষা অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে শুরু করলো। ফোন করে লাভ নেই। আমরা যাতে ডিস্টার্ব না করি ও ফোন মিউট করে রাখে। শেষ পর্যন্ত রাস্তার ওপারে সেভার দেখা পেলাম। এসে বলল
“ডিসকাউন্টে চকোলেট ছিল, তাই দেরি হল। তুমি নেবে?”
“হ্যাঁ, দিয়ে দিস।“
“তুমি তো এসব খাবে না। কিছুদিন পরে আবার আমাকেই দেবে।“
ওরা প্রায়ই এসব হাবিজাবি কেনে আর আমি নিয়ে যাই। বিশেষ করে মেয়েদের কাছ থেকে দামী দামী ওয়াইন আর কনিয়াক বা হুইস্কি।
বাসায় ফিরে দেখি মনিকা আর ক্রিস্টিনা মিলে সব কিছু পরিষ্কার করে রেখেছে। জিজ্ঞেস করলাম
“রান্না করব? খাবি তোরা?”
‘কোন দরকার নেই। কেউই খায়না।“ মনিকা উত্তর দিল।
“দেখ, যেটা ভালো মনে করিস।“
“ঠিক আছে, অল্প কিছু করে রেখে যাও।“
যাকগে, শেষ পর্যন্ত শুয়োরটার একটা গতি হল। বেচারা এতো দিনে ডীপ ফ্রিজে কি জমাটাই না জমেছে।
“পাপ, আন্তনকে ফোন কর। ও যদি না পারে, আমি তোমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে আসব।“ বলে সেভা ঘুমুতে গেল।
আন্তন এল পৌনে সাতটায় কাজের পরে।  
“খাবি?”
“হ্যাঁ। একটু খাওয়া যায়। তুমিও রেডি হয়ে নাও। একটু পরেই বেরুতে হবে।“
অনেক দিন পরে সবাই মানে আমি আর চার ছেলে মেয়ে এক সাথে, যদিও যে যার মত, কেউ ঘুমে, কেউ খেলায় ব্যস্ত।
আন্তন আমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে চলে গেল কানকভার বাসায়। আমিও ধীরে ধীরে দুবনার দিকে চললাম রাতের বাসে। বেশ ভালো লাগছিল ওদের কথা ভেবে। অনেক সময় অসুখও সুখের হয়।
দুবনা, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮  

 

Comments

  1. ছোট ছোট দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাগুলো আপনি বেশ অন্যরকম করে লেখেন। ভালো লাগে।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি