মোর ভাবনারে

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিটা রাশিয়ায় এক অদ্ভুত সময় গ্রীষ্ম যাই যাই করেও যায়নি একেবারে আবার শীতও সুযোগ পেলেই শরতের জানালা গলিয়ে নিজের নাকটা ঢোকাতে কসুর করে না আমার অভ্যেস শীত গ্রীষ্ম সব সময়েই ব্যালকনির দরজা খুলে ঘুমানো এখন রাতে ঠাণ্ডা পড়ে তাই সকালে লেপের নীচে শরীরের ঘুম যখন ভাঙ্গে মনে হয় মাথাটা যেন এই মাত্র ডীপ ফ্রিজ থেকে বের করে এনেছে কেউ আর হাত দুটো, যারা লেপের নীচ থেকে রাত দুপুরে বেড়িয়ে গেছিল হাওয়া খেতে মনে হয় যেন মরা মানুষের হাত 
আমি রাতের বেলায় বই পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়ি আবার ঘুম ভাঙ্গলে বই নিয়ে বসি একটু পড়ি, মেইল চেক করি, ফেসবুকে ঢুঁ দেই আজ সকালে উঠেই হোয়াটস অ্যাপে এক সংগৃহীত লেখা পেলাম হয়তো ধর্ম বা ধর্ম গ্রন্থের বিভিন্ন গল্প বা রূপকথাকে যুক্তি দেওয়ার অপচেষ্টা, তবে যুক্তি ফেলনা নয় তাই ভালো লাগল ওটা ছিল ছেলে আর মায়ের কথোপকথন
ছেলে মাকে ডারউইনের কথা শোনাচ্ছে আর মা ছেলেকে পুরাণের গল্প
মা বলছেন দশ অবতারদের কথা – মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, কৃষ্ণ আর অনাগত কল্কির কথা অজ্ঞাত কারণে অবশ্য বুদ্ধ এই তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, তার স্থান পেয়েছেন বলরাম মা বলছে মৎস্য বা মাছ প্রথম অবতার জলেই জীবনের শুরু কূর্ম বা কচ্ছপ – উভচর প্রাণী প্রাণ উঠে এলো ডাঙ্গায় বরাহ এটা বন্য শক্তির প্রতীক প্রাণ এলো, কিন্তু বুদ্ধি তখনো অধরা নৃসিংহ – আধা মানুষ আধা সিংহ বন্য প্রাণী পেল মানুষের আকার বামন –  মানুষ, তবে অন্যান্য জীবের তুলনায় অতি দুর্বল সে পরশুরাম এলো কুঠার হাতে শুরু হল হাতিয়া ব্যবহারের যুগ বন কেটে তৈরি হল বসবাসের ব্যবস্থা রাম – প্রথম সামাজিক বিধির প্রবর্তন করলেন জন্ম নিল সমাজ তৈরি হল রাজতন্ত্র বলরাম – হলধর লাঙ্গল তার অস্ত্র শুরু হল কৃষিকাজ এরপর এলেন কৃষ্ণ রাজনীতি, কূটনীতি আর ধর্ম নিয়ে আর কল্কি অবতার যিনি এখনও আসেননি তার ব্যাপারে বলেছেন কল্কি হবেন জেনেটিক্যালি অনেক উন্নত অবতার  
তবে আমরা তো জানি, মানে পড়েছি, যে কল্কি ধ্বংসের অবতার যিনি পাপপূর্ণ এই পৃথিবী ধ্বংস করতে আসবেন
এরকম লেখা প্রায়ই দেখা যায় আজকাল বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে চেষ্টা করা হয় সেটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়ার বিশ্বসৃষ্টি নিয়ে বিভিন্ন ধর্মে যেসব কল্পকাহিনী আছে তাদের মধ্যে চণ্ডীতে বর্ণিত কাহিনী বর্তমান বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার সবচেয়ে কাছাকাছি চেষ্টা করলে এসব গ্রন্থে বর্ণিত অনেক কিছুরই আধুনিক ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে কিন্তু সমস্যা ব্যাখ্যায় নয়, সমস্যা যদি কেউ ব্যাখ্যা দিয়ে সেই প্রাচীন যুগে আটকে থাকে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিয়ে যদি মানুষ পরবর্তীতে বিজ্ঞানের পথে না এগোয় বিজ্ঞানের পথ সত্যের পথ, সত্য সন্ধানের পথ এখানে সুবিধাবাদী ব্যাখ্যার সুযোগ নেই, সেটা করলে খুব তাড়াতাড়িই মুখোশ খুলে পড়ে অবশ্য শুধু যে ধর্ম নিয়েই এসব ঘটনা ঘটে তা নয় মনে পড়ে আশির দশকের কথা সোভিয়েত ইউনিয়ন গরবাচভ পেরেস্ত্রইকা গরবাচভের প্রিয় বুলির একটা ছিল “ব্যাক টু লেনিন, মানে লেনিনের কাছে ফিরে যাওয়া“ তবে পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে যান্ত্রিকভাবে এসব করলে হিতে বিপরীত হয় তাই ধর্মের ইতিহাস বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করে যদি ধর্মকে বিজ্ঞানসম্মত পথে না চালানো হয়, অন্তত বিজ্ঞানে প্রমাণিত সত্যকে মেনে নেওয়া না হয় তবে এসব হয়ে দাঁড়ায় সুবিধাবাদী ব্যাখ্যা       
যাকগে কথা হচ্ছিল এখনকার আবহাওয়া নিয়ে হ্যাঁ, সকালে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব থাকলেও এখনও সূর্যি মামা কুম্ভকর্ণের মত ছ’মাসের ঘুমে ঢলে পড়েনি আলসেমি সত্ত্বেও দেরিতে হলেও চুল্লীতে ঠিকই খড়কুটো ফেলে ফলে একটু বেলা বাড়লেই সেই চুল্লীর আগুনে গরম হয় পৃথিবী শরতের হাত ধরে যাই অফিসে রাস্তায় রঙ বেরঙের গাছপালার সাথে কথা বলতে বলতে দিন কাটে অফিসে বসে আর সূর্যটা যখন ভল্গায় ডুবে যায় কাজে বসে মন চারিদিক নিস্তব্ধ একশ মিটারের বেশি লম্বা করিডোরে আলোছায়ার খেলা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে শেষ আলোও ঘুমিয়ে পড়েছে দিনের খেলা শেষে রাত বাড়তে থাকে এক সময় পেটের ভেতরের দানোগুলো চিৎকার করে বলতে শুরু করে “ভাত দে, নইলে নাড়িভুঁড়ি খাবো“ বেরিয়ে পড়ি অফিস থেকে সাইকেলে আমার সাথে সাথে শোঁ শোঁ করে দৌড়োয় শীত কত কথা তার শুনতে শুনতে কান জমে যায়
অনেক অনেক আগে, দুবনা যখন গড়ে উঠতে শুরু করে, ইটালিয়ান বৈজ্ঞানিক ব্রুনো পন্টেকরভো এখানে সাইকেল চালানোর রেওয়াজ চালু করেন এখন গাড়ির প্রাচুর্য দেখা দিলেও সাইকেল চালানোর লোকের কমতি নেই আমি নিজে সাইকেলে যাতায়াত শুরু করি ২০০১ সালে মাত্র পনের দিনের মাথায় নতুন সাইকেল চুরি হওয়ায় অনেকেই সমবেদনা প্রকাশ করলে আমি বলি
তো চোরের সমস্যা                       
মানে?
মানে আবার কি? আমি হেঁটে যেতে পারব বা সাইকেল কিনে নেব
কিন্তু ওকে এখন ভাবতে হবে এই সাইকেল নিয়ে কি করবে কার কাছে বিক্রি করবে সব সময় ভাববে এই বুঝি ধরা পড়ল

জানিনা এই ব্যাখ্যা কারো পছন্দ হয়েছিল কিনা, তবে এ নিয়ে কেউ আর আমাকে বিরক্ত করেনি
২০০১ থেকে শুরু করে ২০১২ পর্যন্ত আমি শীত নেই গ্রীষ্ম নেই সব সময় সাইকেলে অফিস যেতাম তখন শীতে আর কেউ সাইকেল চালাত না আমার পরে অনেকেই শুরু করেছে শীতে সাইকেলে আমাকে দেখে বৃদ্ধা মহিলারা তাকিয়ে থাকতেন আর বলতেন “হা ঈশ্বর, হা ঈশ্বর“ আর আমি মনে মনে বলতাম, “লিখে রেখো, তোমার একজন শিষ্য বাড়িয়ে দিলাম সুদে আসলে ফেরত দিতে ভুলো না বন্ধু
অনেক দিন পরে আবার নতুন করে সাইকেলে অফিস করতে শুরু করেছি ভাবছি শীতটা সাইকেলেই কাটিয়ে দেব কিনা ভাবনা ভাবনা অন্তহীন ভাবনা

দুবনা, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮     





 

 

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি