জুলফিয়া

যেহেতু আমার ছোটবেলায় গ্রামে খেলাঘর বা কচিকাঁচার আসর ছিল না, তখন সম্মেলন যে কী সেটা জানতাম না। সে অর্থে  সম্মেলনের সাথে প্রথম পরিচয় কলেজ জীবনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে। তখন জেলা সম্মেলন হয়, আমিও জেলা কমিটিতে নির্বাচিত হই। এরপর নিজের গ্রামে খেলাঘর আসর গড়ে তুলি। সেখানেও সম্মেলন করি একজন অর্গানাইজার হিসেবে। খেলাঘর মানিকগঞ্জ জেলা সম্মেলন হয় সে সময়ই।  এসব ছিল আনন্দঘন মুহূর্ত, অনেক স্বপ্নের বীজ সেখানেই বপন করা হয়েছিল। এরপর মস্কো চলে এলে প্রতি শীতে আমরা যেতাম ছাত্র সংগঠনের সম্মেলনে - সেও ছিল আনন্দ মেলা। এরপর সময়ের সাথে সাথে সম্মেলনগুলো কনফারেন্সে রুপ নেয়, যেতে শুরু করি পদার্থবিজ্ঞানের উপর নানা কনফারেন্সে। প্রথম দিকে এসব ছিল খুব সিরিয়াস ব্যাপার স্যাপার। নামীদামী বিজ্ঞানীদের বক্তৃতা শোনা, নিজের কাজের কথা তাঁদের জানানো। অনেকবার যেতে যেতে এটা একসময় রুটিনে পরিণত হল। কাজের বাইরেও এটা হল বন্ধুদের সাথে, কলিগদের সাথে দেখা করার উপলক্ষ্য। কনফারেন্স হলে যাঁদের সাথে কোন বিষয়ে প্রচণ্ড দ্বিমত, তর্কবিতর্ক সন্ধ্যায় তাঁদের সাথেই একসাথে রেস্টুরেন্টে যাওয়া, হৈচৈ করে খাওয়া দাওয়া। এবার কনফারেন্স ছিল একটু অন্য রকমের। শেষ দিন ছিল ভল্গা নদীপথে বুলগার নামে এক অতি প্রাচীন শহর ভ্রমণ। ওখান থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল ছয়টা, দু ঘণ্টা পরে আমার ট্রেন। রোম থেকে আসা সালভাতর নদী বন্দর থেকে পায়ে হেঁটে হোটেলে ফেরার প্রস্তাব দিল। রাজী হয়ে গেলাম। তারপর হোটেলের কাছে এসে ও গেল ঘুরতে। ওর প্লেন আগামী কাল ৩ রা সেপ্টেম্বর। আমি হোটেলে ফিরলাম লাগেজ নিতে। দেখি আলিওশা বসে আছে।
- চল খেতে যাই।
- পারছি না রে, একটু পরে আমার ট্রেন।
ওর কাছ থেকে বিদায় নিলাম, ইগর ট্যাক্সি ডেকে দিল। থাকে মস্কো। দেখা হবে বললেও জানি দেখা হবে আবার কোন কনফারেন্সে, সম্মেলনে। এর মাঝে দেখা হবে কোন পত্রিকার পাতায় যখন আমি নিজে বা ওদের কেউ কোন পেপার পাবলিশ করবে।

ট্রেনে উঠে দেখি আমার কামরায় এক মেয়ে বসে চেষ্টা করছে বিশাল একটা ব্যাগ সীটের নীচে ঢোকাতে। আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলল
- আমি ভেবেছিলাম এটা মহিলাদের কামরা।
- কী আর করা। যাকগে, তোমার ভয়ের কোন কারণ নেই।
- আচ্ছা।
ওকে সাহায্য করলাম ব্যাগটা রাখতে। দরকারি জিনিসপত্র বের করে নিজের ব্যাগ দুটো সীটের নীচে ঢুকিয়ে সেটা নামিয়ে দিলাম। ট্রেন ছাড়তে আরও মিনিট দশেক, দুটো সীট এখনও ফাঁকা। কে জানে আসবে কি না? প্রায় ১১ ঘণ্টার জার্নি। এসব জার্নিতে কারমার লোকদের সাথে একদিকে যেমন বলার মত কথা তেমন থাকে না, অন্য দিকে কথা না বলাটাও কেমন যেন অস্বস্তিকর মনে হয় কখনও কখনও। সোভিয়েত আমলে লোকজন ট্রেনে উঠেই খাবারের আয়জনে ব্যস্ত হয়ে পড়ত, আমন্ত্রণ জানাত খেতে। নিজে যখন অজুহাত খুঁজছি কথা শুরু করার, ও নিজেই জিজ্ঞেস করল 

- কি নাম তোমার?
- বিজন। তোমার?
- জুলফিয়া।
- আমাদের দেশেও এরকম নাম আছে।
- তোমার নামের অর্থ কি?
- জনহীন। (আমি সব সময়ই একটু অস্বস্তি বোধ করি এর উত্তর দিতে। কেননা এটা নাম হলেও বিশেষণ। অনেক সময় কারণ বলতে হয় কেন এই নাম) 
এরপর ও উপরে উঠে গেল। আমাদের দুজনের সীট ছিল উপরে।
- তুমি যদি মাইন্ড না কর, আমি কাপড়টা চেঞ্জ করে নিচ্ছি।      
- ঠিক আছে।
আমি জামাকাপড় চেঞ্জ করে নিলে ও নিজেও চেঞ্জ করতে চাইল। আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। ট্রেন অলরেডি চলতে শুরু করেছে, নীচের দুটো সীটে কেউ যাচ্ছে না। একবার ভাবলাম নীচের সীটে চলে আসি। আবার মনে হল যদি ঝামেলা করে, নীচের সীটের ভাড়া বেশি। নিরাপত্তা ভাড়া (আমার তাই মনে হয়, ওখান থেকে পড়ে বড়জোর একটু আঁচড় লাগবে)। আমি অবশ্য উপরের সীটের ভাড়া বেশি নিতাম বাড়তি ভয় আর উত্তেজনার জন্য। তবে রেল কোম্পানি আমাকে জিজ্ঞেস করে না বলে আইডিয়াটা পাস করা হয়নি।
- আমি চা আনতে যাচ্ছি। তোমার জন্য আনব? আমার কাছে বিস্কুট আর চকলেট আছে।
- না না। আমি কিছুক্ষণ আগেই খেয়েছি।
- ওকে। তবে সবকিছু এখানে রইল। তুমি চাইলেই নিয়ে খেতে পার।
এই বলে আমি গেলাম গরম জল আনতে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
- তুমি মস্কো যাচ্ছ?
- হ্যাঁ।
- কাজান থেকে?
- না, আমার বাড়ি ছোট এক শহরে। এখান থেকে চার ঘণ্টার পথ। বাসকিরিয়ার পাশে।
- আচ্ছা। আমি আজ দুপুরে বুলগার গেছিলাম এস্কারশনে। ওখান থেকে তোমার শহর নিশ্চয়ই কাছে?
- হ্যাঁ। বুলগার একসময় বিশাল রাজ্য ছিল। পরে রাশানদের হাতে ধ্বংস হয়ে যায়।
- তুমি মনে হয় ঠিক বলছ না।  রাশানরা এ দিকে আসে ষোড়শ শতাব্দীতে ইভান দ্য টেরিবলের সময়। বুলগার যখন শক্তিশালী রাজ্য ছিল তখন খাজার, মঙ্গোল এরা ওদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। রাশানরা তখন ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল।
- সেটা ঠিক, তবে রাশিয়ার শুরুও কিন্তু ইভান দ্য টেরিবল দিয়ে হয়নি।
- হ্যাঁ। ৯৮৮ সালে ভ্লাদিমির খৃস্টান ধর্ম গ্রহন করেন। রুরিক এর আগে এদেশে আসেন।
- আসলে মঙ্গোলরা যখন আসে রাশিয়ান রাজন্যবর্গ তাঁদের সাথে সন্ধি করে, বুলগাররা সেটা করেনি। তাই মঙ্গোলরা ওদের রাজ্য ধ্বংস করে। যারা বেঁচে ছিল তারা কাজান চলে যায়, অন্যেরা বুলগেরিয়া।
- আজকে গাইড সেটাই বলল।
- তুমি এদেশে পড়াশুনা করেছ?
- হ্যাঁ, রুদেএনে মানে গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
- আমিও সেখানেই ভর্তি হয়েছিলাম, পরে মস্কো স্টেটে চলে গেছি। 
- আচ্ছা। আমি রুদেএনে ফিজিক্সে পড়েছি, এখন পড়াই। তবে কাজ করি দুবনায়। তোমার সাবজেক্ট কি?
- জার্নালিজম। আচ্ছা, আমি একটা লেকচার শুনব এখন ইউটিউবে। শুভ রাত্রি!
- শুভ রাত্রি!

আমার অনেক দেরিতে ঘুমানোর অভ্যেস। মাঝ রাতে ঘুম ভাঙল। উঠে বই পড়তে পড়তে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। এক সময় জানানো হল এক ঘণ্টা পরে আমরা মস্কো পৌঁছব। আমি উঠে হাতমুখ ধুয়ে চা খেলাম, বাসায় জানালাম আমার মস্কো ফেরার কথা। জামাকাপড় বদলিয়ে জুলফিয়াকে ডাকলাম
- সুপ্রভাত। আমরা পৌঁছে গেছি প্রায়।
- সুপ্রভাত। তুমি অন্য সীটটাতে বসবে? আমি পোশাক বদলে নিই।
- অবশ্যই। চা খাবে?
- না।
- তুমি এখন হোস্টেলে যাবে?
- হ্যাঁ!
- দাস? (এটা মস্কো স্টেটেরে একটা হোস্টেলের নাম)
- তুমি জানলে কোত্থেকে?
- আমার দেশিদের অনেকে সেখানে থাকত। (এ সময় আমার মনীন্দ্র বর্মণের কথা মনে পরল। আমি ছাত্র জীবনে ওর ওখানে যেতাম কখনও কখনও)। তাছাড়া কিছুদিন আগেও আমাদের বাসা ছিল ও এলাকায়। আমি রেগুলার বাজার করতাম রিও আর আশানে।
- তাই বল।
এর মধ্যে ট্রেন থামল।
- তোমাকে হেল্প করতে হবে?
- যদি একটু ব্যাগটা বের করতে সাহায্য কর।
- ঠিক আছে। তুমি আমার ব্যাগটা নাও। আমি ওটা নিচ্ছি।

বিশাল ব্যাগ। যেমন সাইজ তেমন ওজন। কিছুই করার নেই। কোন মতে টেনে বের করলাম। বুঝলাম মেট্রো পর্যন্ত নিতে হবে।

- আমি ট্যাক্সি ডেকেছি। অনেক ধন্যবাদ। অনেক শুভ কামনা।
- তোমার জন্যও শুভ কামনা! 

আমি চলে গেলাম বাসায়। সেভা মেট্রো স্টেশনে এলো আমাকে নিতে। সারাদিন কাজের ব্যস্ততা। ছাত্ররা এলো। দীর্ঘ ছুটি শেষে আবার নতুন করে জীবনের শুরু। দীর্ঘ শীতের পরে বসন্তে যেমন গাছপালা জেগে ওঠে, গ্রীষ্মের ছুটির পর সেপ্টেম্বরে ক্লাসরুমগুলোও তেমনি প্রাণ ফিরে পায়। আজ ক্লাস তেমন ছিল না, তবুও প্রায় ছয়টা পর্যন্ত কাটালাম ছাত্রদের আর ইউরি পেত্রভিচের সাথে গল্প করে।  সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে রান্না করলাম। মনিকা, ক্রিস্টিনা, সেভা - সবাই বাসায়। ওদের খাইয়ে, নিজে খেলাম। ক্রিস্টিনা চলে গেল বান্ধবীর কাছে। সে সন্তান সম্ভবা। ওর বন্ধু নিজের শহরে গেছে দিদিমার মৃত্যুর খবর পেয়ে। ক্রিস্টিনা যাচ্ছে বান্ধবীর মনে সাহস যোগাতে। 
- কোন সমস্যা হলে লিখিস বা ফোন করিস।

দুবনার বাস রাত ১১ টা। সেভা আর মনিকার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চললাম দুবনার পথে। বাসে বসে ফেসবুকে আবার কিছু লেখা, কিছু স্ট্যাটাস পড়লাম। মনে হল জুলফিয়ার কথা। দু দিন আগে ওকে চিনতাম না, আর কোন দিন হয়ত দেখা হবে না। কিন্তু কি অবলীলায় আমরা গল্প করে সময় কাটালাম। আবার অনেক দিনের চেনা বন্ধুর মত বিদায় নিলাম। ফেসবুকে অনেকের সাথে আলাপ। অনেককে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। কারও কারও সাথে দিনের পর দিন গল্প করে কাটিয়েছি। এমন হয়েছে কেউ আমাকে প্রশ্ন করলে ওরা আমার আগেই উত্তর দিয়ে দিয়েছে। এতটাই ছিল আমাদের বন্ধুত্ব, মনের যোগাযোগ। নিজেকে প্রশ্ন করলাম যদি এখন এমন হত যে হঠাৎ আমাদের একই কামরায় একসাথে কোথাও যেতে হচ্ছে যেমনটা জুলফিয়ার সাথে, আমি কি এত সরল মনে যেতে পারতাম? আমি সিওর নই। কারণ এখন আমি জানিনা ঠিক কীভাবে এদের সাথে চলব, বলব। যদি আগের মত আবেগ আর উচ্ছাস নিয়ে কথা বলি হয়ত এটাকে এরা হ্যারাজমেন্ট বলে অভিযোগ করবে আবার কিছু না বললে বা দায়সারা গোছের কিছু বললে বলবে তাদের আমি অবজ্ঞা করলাম। মনে পড়ল আলুর কথা। আলু আইভরি কোস্টের ছেলে। আমার কয়েক বছরের জুনিয়র। একই হোস্টেলে থাকতাম। একই ফ্লোরে। বিকেলে কিচেনে দেখা হত কখনও কখনও। একবার আমার প্রচণ্ড সর্দি। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে নাক ঝাড়তে ওয়াশ রুমে যাচ্ছি। হঠাৎ ও বলে উঠল
- আমি কালো বলে তুমি আমাকে অবজ্ঞা করছ, নাক ঝাড়ছ, থু থু ফেলছ।
আমি যত বলি আমার শরীর খারাপ, ও তত বেশি অবিশ্বাস করে।

মা বলতেন ব্রাহ্মনের আগে হাঁটলেও দোষ, পিছে হাঁটলেও দোষ। ব্রাহ্মণে ভরে যাচ্ছে পৃথিবী। 

দুবনা, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯    




Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি