কাকু
কয়েকদিন আগে কাকুর জীবনস্মৃতি শেষ করলাম। মাহবুব এসেছিল বেড়াতে, আগে থেকেই জানিয়েছিল আসবে বলে। দেশ থেকে কেউ এলে আমি সাধারণত বই, আচার, মার্বেল এসব আনতে বলি। কোন বই আনতে হবে সেটা আগে থেকেই জানিয়ে দিই।
কাকুর সাথে প্রথম পরিচয় সত্তরের দশকে তাঁর চার্লস ডারুইনঃ পিতামহ, সুহৃদ সহযাত্রী দিয়ে। আবু জাফর সামসুদ্দীনের লেখায় জানতে পারি তাঁর মস্কোয় বসবাসের কথা। তাই নিজে যখন ১৯৮৩ সালে মস্কো আসি আশা ছিল সেখানে দেখা হবে, কথা হবে। আমার বন্ধুরা প্রায়ই তাঁদের বাসায় গেলেও আমার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি ১৯৯২ সালের আগে পর্যন্ত। সেটা অবশ্য আমার দুর্বলতা। আমিই পারিনা ভিড়ের মধ্য গল্প করতে। তাই যেকোনো আড্ডায় আমি কোন এক কোনে বই বা কিছু হাতে হারিয়ে যাই নিজের ভাবনার জগতে। কথা বলা আমার জন্য খুবই অন্তরঙ্গ প্রক্রিয়া - নিজেকে বোঝানোর বা অন্যকে বোঝার চেষ্টা। অন্য যে কোন মানুষের উপস্থিতি সেই প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। হয়ত সে কারণেই কাকু যখন মাঝে মধ্যে হোস্টেলে আসতেন - সেরকম আলাপ পরিচয় গড়ে ওঠেনি। তবে ১৯৯১ সালে বন্ধুদের অনেকেই চলে যায়। প্রগতি প্রকাশন বন্ধ হয়ে যায়, ফলে কাকুর হাতেও অফুরন্ত সময়। তখনই তাঁর সাথে একাকী ঘোরাফেরার সুযোগ আসে। তখন থেকেই ঘনিষ্ঠতা। কত জায়গা ঘুরে বেড়ানো, হাজারো গল্প করা - রাজনীতি, সাহিত্য কত কীই না থাকত সেসব গল্পে। কাকুর জীবন কথাও শুনেছি কতবার আরও ব্যাপক পরিসরে। তবে সে সব গল্পে তিনি কখনও তাঁর রাজনৈতিক অতীতের কথা বলেননি। কত অজানা তথ্যই না জানা হল বইটি পড়ে, জানলাম সে সময়ের বাংলাদেশের কথা। দেশ যখন বিরাট পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় - কী ১৯৪৭ এর দেশভাগ, কী ১৯৭১ এর স্বাধীনতা - এ সবই আমাদের দেশের জন্য, সমাজের জন্য যুগান্তকারী পরিবর্তন। ঠিক যেমনটা ১৯৯১ সালে সোভিয়েত দেশ ভেঙ্গে নতুন বিশ্বের জন্ম। আর যারাই এসব ঘটনায় কী প্রত্যক্ষ, কী পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছে, সবাই সেই ইতিহাসের একেকটা অংশ, নতুন প্রাসাদের একেকটা ইট পাথর।
বইটির পরতে পরতে ছিল ছিল আমাদের জীবন। বইটি পড়তে পড়তে ফিরে যাচ্ছিলাম মস্কোর সেই দিনগুলোয় যখন কোন অলস বিকেলে কাকুর বাসার বাইরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমরা দেশ নিয়ে ভাবতাম, দেশের গল্প করতাম। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি স্টাইলে লেখা বইটি কী এক দুর্বার আকর্ষণে টেনে নিয়ে যায় গ্রাম বাংলার হাটে মাঠে ঘাটে। মনে হয় এই তো আমি নিজেই বড়লেখা থেকে অনেক দূরে কালীগঙ্গা নদীর তীরে তরা গ্রামের রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কাকু যে আমাকে স্নেহ করেন সেটা জানতাম, তবুও মস্কোয় বা দেশে তাঁর হাজার হাজার গুণগ্রাহীর থাকার পরেও তাঁর দু দুটো বইয়ে (সমাজতন্ত্রে বসবাস - বইটা কাকু আমাকে উপহার দিয়েছিলেন ঢাকায় তাঁর বাসায় বেড়াতে গেলে আর জীবনস্মৃতিতে) প্রসঙ্গক্রমে আমার কথা উল্লেখ করেছেন - সেটা দেখে অবাক ও খুশি দুটোই হয়েছি।
আজ মস্কো আছি, ভাবলাম সেই পরিচিত রাস্তা মানে কাকুর বাসার পাশ দিয়ে হেঁটে আসি। সেটা আর হয়ে উঠলো না। তবে এ ছাড়াও আমাদের বেশ কিছু প্রিয় জায়গা ছিল। দূতাবাস স্কুলে কাজ করার সময় প্রায়ই জুবভস্কি বুলভার দিয়ে হেঁটে যেতাম, কখনো বা তলস্তয়ের বাড়ির পাশ দিয়ে। মস্কো স্টেট ইউভার্সিটির সামনে বা নোভোদেভিচি মোনাস্টিরের লেকের ধারে। শেষেরটা আমার বাসার পাশে, পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। তাই সেখানেই গেলাম। সেই গাছ, সেই লেক, সেই পাখি। কাকুর বইয়ের সূত্র ধরে আবার কত কথাই না হল কাকুর সাথে, অবশ্য মনে মনে। কাকু আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও এভাবেই তিনি তাঁর উপস্থিতিটা বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন তাঁর লেখা, তাঁর রেখে যাওয়া কাজের মধ্য দিয়ে আর অবশ্যই আমাদের স্মৃতিতে।।
মস্কো, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯
কাকুর সাথে প্রথম পরিচয় সত্তরের দশকে তাঁর চার্লস ডারুইনঃ পিতামহ, সুহৃদ সহযাত্রী দিয়ে। আবু জাফর সামসুদ্দীনের লেখায় জানতে পারি তাঁর মস্কোয় বসবাসের কথা। তাই নিজে যখন ১৯৮৩ সালে মস্কো আসি আশা ছিল সেখানে দেখা হবে, কথা হবে। আমার বন্ধুরা প্রায়ই তাঁদের বাসায় গেলেও আমার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি ১৯৯২ সালের আগে পর্যন্ত। সেটা অবশ্য আমার দুর্বলতা। আমিই পারিনা ভিড়ের মধ্য গল্প করতে। তাই যেকোনো আড্ডায় আমি কোন এক কোনে বই বা কিছু হাতে হারিয়ে যাই নিজের ভাবনার জগতে। কথা বলা আমার জন্য খুবই অন্তরঙ্গ প্রক্রিয়া - নিজেকে বোঝানোর বা অন্যকে বোঝার চেষ্টা। অন্য যে কোন মানুষের উপস্থিতি সেই প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। হয়ত সে কারণেই কাকু যখন মাঝে মধ্যে হোস্টেলে আসতেন - সেরকম আলাপ পরিচয় গড়ে ওঠেনি। তবে ১৯৯১ সালে বন্ধুদের অনেকেই চলে যায়। প্রগতি প্রকাশন বন্ধ হয়ে যায়, ফলে কাকুর হাতেও অফুরন্ত সময়। তখনই তাঁর সাথে একাকী ঘোরাফেরার সুযোগ আসে। তখন থেকেই ঘনিষ্ঠতা। কত জায়গা ঘুরে বেড়ানো, হাজারো গল্প করা - রাজনীতি, সাহিত্য কত কীই না থাকত সেসব গল্পে। কাকুর জীবন কথাও শুনেছি কতবার আরও ব্যাপক পরিসরে। তবে সে সব গল্পে তিনি কখনও তাঁর রাজনৈতিক অতীতের কথা বলেননি। কত অজানা তথ্যই না জানা হল বইটি পড়ে, জানলাম সে সময়ের বাংলাদেশের কথা। দেশ যখন বিরাট পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় - কী ১৯৪৭ এর দেশভাগ, কী ১৯৭১ এর স্বাধীনতা - এ সবই আমাদের দেশের জন্য, সমাজের জন্য যুগান্তকারী পরিবর্তন। ঠিক যেমনটা ১৯৯১ সালে সোভিয়েত দেশ ভেঙ্গে নতুন বিশ্বের জন্ম। আর যারাই এসব ঘটনায় কী প্রত্যক্ষ, কী পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছে, সবাই সেই ইতিহাসের একেকটা অংশ, নতুন প্রাসাদের একেকটা ইট পাথর।
বইটির পরতে পরতে ছিল ছিল আমাদের জীবন। বইটি পড়তে পড়তে ফিরে যাচ্ছিলাম মস্কোর সেই দিনগুলোয় যখন কোন অলস বিকেলে কাকুর বাসার বাইরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমরা দেশ নিয়ে ভাবতাম, দেশের গল্প করতাম। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি স্টাইলে লেখা বইটি কী এক দুর্বার আকর্ষণে টেনে নিয়ে যায় গ্রাম বাংলার হাটে মাঠে ঘাটে। মনে হয় এই তো আমি নিজেই বড়লেখা থেকে অনেক দূরে কালীগঙ্গা নদীর তীরে তরা গ্রামের রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কাকু যে আমাকে স্নেহ করেন সেটা জানতাম, তবুও মস্কোয় বা দেশে তাঁর হাজার হাজার গুণগ্রাহীর থাকার পরেও তাঁর দু দুটো বইয়ে (সমাজতন্ত্রে বসবাস - বইটা কাকু আমাকে উপহার দিয়েছিলেন ঢাকায় তাঁর বাসায় বেড়াতে গেলে আর জীবনস্মৃতিতে) প্রসঙ্গক্রমে আমার কথা উল্লেখ করেছেন - সেটা দেখে অবাক ও খুশি দুটোই হয়েছি।
আজ মস্কো আছি, ভাবলাম সেই পরিচিত রাস্তা মানে কাকুর বাসার পাশ দিয়ে হেঁটে আসি। সেটা আর হয়ে উঠলো না। তবে এ ছাড়াও আমাদের বেশ কিছু প্রিয় জায়গা ছিল। দূতাবাস স্কুলে কাজ করার সময় প্রায়ই জুবভস্কি বুলভার দিয়ে হেঁটে যেতাম, কখনো বা তলস্তয়ের বাড়ির পাশ দিয়ে। মস্কো স্টেট ইউভার্সিটির সামনে বা নোভোদেভিচি মোনাস্টিরের লেকের ধারে। শেষেরটা আমার বাসার পাশে, পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। তাই সেখানেই গেলাম। সেই গাছ, সেই লেক, সেই পাখি। কাকুর বইয়ের সূত্র ধরে আবার কত কথাই না হল কাকুর সাথে, অবশ্য মনে মনে। কাকু আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও এভাবেই তিনি তাঁর উপস্থিতিটা বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন তাঁর লেখা, তাঁর রেখে যাওয়া কাজের মধ্য দিয়ে আর অবশ্যই আমাদের স্মৃতিতে।।
মস্কো, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯
Comments
Post a Comment