শাড়ি যখন ফাঁসির রজ্জু

আমার ছোটবেলায় ঝড়ের কোন নাম ছিল না, ওরা ছিল নাম ঠিকানা বিহীন, ভূমিহীন অদম্য শক্তি যারা মুহূর্তের মধ্যে শত শত মানুষকে নিজেদের মতই সর্বস্বান্ত করত।  ইদানীং ওরা নাম পেয়েছে, জাতে উঠেছে। একইভাবে যদি ফেসবুকের বৃষ্টি বাদলকে, এর ঝড় তুফানকে নাম ঠিকানা দেওয়া হয় তবে বর্তমানে ফেসবুকের বাংলাদেশি ডোমেনে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের নাম ছিল শাড়ি।  

কনফারেন্সে ব্যস্ত থাকায় সব কিছু দেখা হয়নি। কয়েকজনকে লেখাটার লিংক পাঠাতে অনুরোধ করি। আমার এক বন্ধু, বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি নিজেই লিখেছেন "বেশ কয়েক বছর আগে হলে স্যারের লেখাটা পড়ে আমার ভালোই লাগতো, সাহিত্য জ্ঞানসমৃদ্ধ মনে হতো। কিন্তু সময় পাল্টে গেছে। আমাদের বোঝাপড়ার ক্ষেত্রও পাল্টেছে।" কথাটা এখানেই। আমরা পালটাচ্ছি আর আমরা চাইছি আমাদের সাথে সাথে সবাই বদলে যাক। আমাদের এই চাওয়াটা কী একধরণের মৌলবাদ নয়? চাওয়া ঠিক নয়, চাওয়ার ধরণটা। তাহলে কোথায় থাকবে মানুষের বাক স্বাধীনতা? অনেকের স্ট্যাটাস দেখে মনে হয়েছে তারা যতটা না লেখা নিয়ে ভাবছেন তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন এই সুযোগে লেখককে একটু গালমন্দ করার সুযোগ পেয়ে। অনেক মানুষকেও দেখেছি নিজেদের চিন্তা ভাবনাকে দূরে রেখে জনতার ভিড়ে মিশে যেতে। চিন্তাশীল মানুষ যখন অন্যদের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শ্লোগান দিতে শুরু করে তখন সেটা খুব ভয়ঙ্কর রুপ নেয়। 

আমার একটা বিরাট মাইনাস পয়েন্ট হল দেশের কাউকে তেমন না চেনা। কাউকে গুরু না মানা। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদকে যেটুকু চেনা সেটা ফেসবুকে আজ যারা তার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত বিভিন্ন সময় তাদের শেয়ার করা লেখা পড়ে বা ভিডিও দেখে। ওনার সাথে যে সব বিষয়ে আমি একমত তা কিন্তু নয়। এর আগে যারা বিদেশে থাকেন তাদের নাগরিকত্ব প্রশ্নে এক  লেখার প্রতিবাদে দু কলম লিখেছিলাম। তবে যেটা না বললেই নয় সেটা হল ওনার সেন্স অফ হিউমার। উনি নিজেকে নিয়ে হাসতেও দ্বিধা করেন না, যা কিনা বর্তমান বাংলাদেশে খুবই বিরল। বুদ্ধিজীবি মানেই হাসি ঠাট্টার ঊর্ধ্বে।

লেখাপড়া করার অভ্যেস থাকায় সময় পেলেই পড়ি। অনেক লেখকের প্রায় সব লেখাই পড়া আছে আর তা থেকে জানি সবার সব লেখা একই রকম ভালো হয়না। এমন কি বিশ্ব সাহিত্যের মহীপালদের কিছু কিছু কালজয়ী লেখার পাশে অতি সাদামাটা অনেক লেখাই দেখা যায়। সেসব লেখার সমালোচনা হয়। এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু বর্তমান লেখা নিয়ে যতটা না তার চেয়ে লেখকের সমালচনা হয়েছে বেশি। লেখাকে নয়, লেখককে ধুলিতে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে চারিদিক থেকে। মাঝে মধ্যে ফেসবুকে দু একটা ভিডিও দেখেছি যখন স্থানীয় কোন মাস্তান কাউকে মারছে আর সবাই চারিদিকে দাঁড়িয়ে দেখছে, কেউ বা মাস্তানকে উৎসাহিত করছে। শাড়ি নিয়ে বিভিন্ন লেখা পড়ে আমার কখনও কখনও সেটাই মনে হয়েছে। এটা মনে হয় যুগের হাওয়া। কি করল সেটা নয় কে করল সেটাই বড় কথা। প্রায়ই দেখা যায় একটা মানুষের সারা জীবনের উপার্জনগুলো কীভাবে ধুলায় মিশিয়ে দিতে। তখন আমার প্যারিসের দুই বন্ধুর গল্পের কথা মনে পড়ে। অনেক বার এটা লিখেছি, তবুও লিখছি।
"একজন স্বনামধন্য শিল্পী, আরেকজন বিশ্ববিখ্যাত লেখক। প্যারিসের বাসিন্দা। রোজ বিকালে এক দামী ক্যাফেতে বসে আড্ডা দেন - রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সিনেমা ইত্যাদি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেন। তাঁদের চারপাশে ভক্তদের ভিড়। একদিন শিল্পীকে অন্য এক বন্ধু জানালেন এই লেখক একজন সমকামী। তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না কথাটা, আবার যিনি বলেছেন তিনিও মিথ্যে বলার পাত্র নন, তাই একদিন লেখক  বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন "শুনলাম তুমি নাকি সমকামী, কথাটা কি সত্য?" "তুমি যা শুনেছ ভুল শুনেছ।" কিন্তু শিল্পীর মনে এর পরও সন্দেহ রয়ে গেল। তিনি একজন গোয়েন্দার শরণাপন্ন হলেন। কয়েকদিন পরে গোয়েন্দা জানাল তার লেখক বন্ধু সত্যি সত্যি সমকামী। শিল্পী তখন লেখকের সাথে কথা বন্ধ করলেন। বন্ধ হল বিকেলের আড্ডা। জীবন চলল নিজের পথে। অনেকদিন পরে তাঁদের হঠাৎ দেখা। লেখক বন্ধু এগিয়ে এসে বললেন " শোন, আমি প্রতিদিন সকালে উঠে অনেক কাজ করি। আমার সংসার আছে। তাদের দেখাশুনা করি। লেখালেখি করি। সারাদিন এরকম হাজার হাজার কাজ আমি করি। আর এই হাজার কাজের একটা আমার সমকামীতা। কিন্তু তোমার চখে আমার সমস্ত স্বত্বা শুধু একটা পরিচয়ের আড়ালে চলে গেল? তুমি এত বড় মাপের একজন শিল্পী, অনেক পড়াশোনা জানা একজন পরিপূর্ণ মানুষ। তোমার কাছ থেকে আর যাই হোক এই সংকীর্ণ মানসিকতা আশা করিনি।"  
আমার মনে হয় আজকাল আমরা নিজেরাও সেই শিল্পীর মত সংকীর্ণ মানসিকতায় ভুগছি। একদিকে আমরা মুক্ত চিন্তার কথা বলছি, অন্যদিকে নিজেরাই বিভিন্ন বিষয়ে ট্যাবু তৈরি করছি। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় অনেক বই, অনেক লেখক নিষিদ্ধ হয়েছেন। আমাদের দেশেও বিভিন্ন অজুহাতে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অনেক লেখকের লেখা পাঠ্য পুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর  বিরুদ্ধে লেখাও কম হয়নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, তলস্তয়, পুশকিন, দস্তয়েভস্কিসহ প্রায় সব কালজয়ী লেখক সৌন্দর্যের বিশেষ করে নারীদের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন। আজ কী কেউ আর "চপলা নারী" বা "সৌন্দর্য বিধ্বংসী শক্তি" এসব কথা মুখ খুলে বলতে পারবেন? কোন সুনীল কী সাহস করে বলবেন "এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ, এখনো সে যে কোন নারী"। এখন অনেকেই দেখছি শাড়ির অনুকরণে "লুঙ্গি" নিয়ে লিখছেন, কেউ কেউ শাড়ি লেখাটাকে ঘষে মেজে ফেসবুকে প্রকাশ করছেন। তাহলে যখন নজরুলের "মহাশ্মশান" বদলে কেউ "গোরস্থান" লেখে আমরা এর প্রতিবাদ করি কোন মুখে? এভাবে আমরাও কি অসহিষ্ণু মানুষে পরিণত হচ্ছি না?             

শাড়ি নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা শূন্যের কাছাকাছি। ১৯ বছর বয়েসে দেশ ছাড়া। বউ বিদেশি। তাই শাড়ির চল নেই আমার সংসারে। মেয়েরা বায়না ধরেছিল, দেশ থেকে শাড়ি এনেছিলাম, তবে সেসব বাক্সবন্দী হয়েই দিন কাটাচ্ছে। তার মানে এই নয় শাড়ির প্রতি আমার কোন অনুভুতি নেই, শাড়ি নিয়ে কোন স্মৃতি নেই। এখানে আসার আগে পর্যন্ত মা, দিদি, বৌদিরা শাড়িই পরতেন। তখন হাত দিয়ে ভাত খেতাম, খাওয়ার শেষে কল তলায় হাত ধুয়ে মায়ের আচলে হাত আর মুখটা না মুছলে খাবারটা ঠিক হজম হতনা। মা আগে থেকেই গামছা বাড়িয়ে দিতেন, কিন্তু মায়ের শাড়ির আঁচল - সেটা একেবারেই ভিন্ন ব্যাপার। মা না থাকলে দিদি বা বৌদির আঁচল কাজে লাগত। এখন আর দেশে তেমন যাওয়া হয় না, গেলেও হাত দিয়ে আর খাওয়া হয়না আর দিদি বৌদিরাও এখন বাড়িতে শাড়ি পরে না।  এখনও যখন শুনি "কি আঁচল বিছিয়েছ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে" তখন আমার সেই মায়ের শাড়ি আর আচলের কথাই মনে পড়ে। মস্কোয় কালেভদ্রে কোন অনুষ্ঠানে মেয়েরা শাড়ি পরে আসলে দেশের বাতাসের গন্ধ পাই। ফেসবুকে বন্ধুদের শাড়ি পরা ছবি দেখে মন জুড়িয়ে যায়। বিশেষ করে এখন তো শাড়ি আর আগের মত আটপৌরে কাপড় নেই। আগে মাকে বেনারসি, জামদানী এসব পরতে দেখলে ভালো লাগত। এখন শাড়ি শুধু শাড়ি নেই, সেটা শিল্পীর ক্যানভাস।       

যদি না এই কালবোশেখির ঝড়, লেখাটা পড়ে ভালই লাগত। রাশিয়ায় বলে কথা হল চড়ুই পাখি - মুখ থেকে বেরোলে ফিরিয়ে আনা যায় না। লেখাও তাই। লেখক নিজের ভাবনা লেখেন আর পাঠক নিজের ভাবনার পরিসর থেকে সেই লেখার ব্যাখ্যা করেন। তাই যেকোনো লেখার গ্রহণযোগ্যতা শুধু লেখার বা লেখকের উপর নির্ভর করে না, পাঠকের উপরেও নির্ভর করে। আর যদি পাঠকগণ এককাট্টা হয় এমনকি একেবারে নির্দোষ কোন লেখাকেও বিষাক্ত করে তোলা যায়। ক্রেতা যখন সর্বদা সঠিক  বিক্রেতা, মানে লেখক তখন নিরুপায়। আসলে লেখাটা পড়ে আমার মনে হয়েছে উনি শাড়ির একটা পজিটিভ ভাবমূর্তি তৈরি করতে চেয়েছিলেন সমাজে। আমরা হিজাব নিয়ে হাজারো কথা বলছি, কথায় কথায় বাংলা ভাষা, বাংলার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য রক্ষার কথা বলছি, সেক্ষেত্রে একজন সমাজ সচেতন মানুষ হিসেবে শাড়ির পক্ষে প্রচার চালানো অস্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। কথা উঠতে পারে ফুট ইঞ্চির হিসাব নিয়ে। উঠতে পারে কেন, উঠেছে? নারী পুরুষ সবাই এ নিয়ে বলছে। আমার তো মনে হয় এদের অনেকেই ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির জায়গায় ৯০-৬০-৯০ লিখলে খুব বেশি কিছু মাইন্ড করতেন না। সমালোচনা সব সময়ই ভালো, সেটা যেকোনো মানুষকে সঠিক পথ দেখতে সাহায্য করে। কিন্তু সমালোচনা যখন ব্যক্তিগত আক্রমণে পরিণত হয় সেটা আর সমালোচনা থাকে না। তবে এ কথাও ঠিক লেখায় কিছু কিছু অংশ অনেককেই, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষুব্ধ করেছে, করতেই পারে। তবে আমার যেটা মনে হয় উনি নারীদের হেয় করার জন্য এটা লেখেননি। আমার অন্তত মনে হয়েছে শাড়িও যে নারীকে সুন্দরভাবে উপস্থাপিত করতে পারে সেটা বলাই ছিল ওনার আসল উদ্দেশ্য। প্রশ্ন আসতে পারে উনি বলার কে? কিন্তু আমরা তো পোশাক পরিচ্ছদ পরিই নিজেদের সুন্দর করে তোলার জন্য। আমাদের চলন, বলন, আমাদের পোশাক পরিচ্ছদ সব কিছুর লক্ষ্যই নিজেকে যতদূর সম্ভব স্মার্ট হিসেবে প্রমাণ করা। তবে সেটারও নিশ্চয়ই মাত্রা থাকা দরকার। যদি আমার পোশাক আমার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হয় তবে লোকে আমাকে না দেখে আমার পোশাক দেখবে, পোশাকের প্রশংসা করবে। সেটা সব সময় যে খুব ভালো লাগবে তার কোন কথা নেই। এ প্রসঙ্গে আরেকটা রুশ গল্প মনে বলা যাক।

এক ফটোগ্রাফার গেছে বন্ধুর বাসায় বেড়াতে। অনেকক্ষণ ধরে গল্পগুজব, ছবি দেখানো। এসব দেখে বন্ধুর বৌ প্রচণ্ড উৎফুল্ল। সব দেখা শেষ হলে তিনি ফটোগ্রাফারকে বললেন
- আপনি এত সুন্দর ছবি তোলেন, ক্যামেরাটা নিশ্চয়ই খুব দামি।
ফটোগ্রাফার কিছু না বলে খাবার প্রসঙ্গে আসেন। খাবার পরিবেশন করা হয়। চর্ব্য-চূষ্য-লেহ্য-পেয়তে ভেঙ্গে পড়ছে টেবিল। খাওয়া দাওয়া শেষে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে ফটোগ্রাফার তৈরি হচ্ছে বাসায় ফেরার জন্য। পাশে দাঁড়িয়ে বন্ধুর বৌ।
- এত সুস্বাদু রান্না অনেকদিন খাইনি। আপনার হাড়ি পাতিল নিশ্চয়ই প্রচণ্ড দামি!

আমরা গল্পটা বলি যখন নতুন কেউ ক্লাবে আসে ছবি তোলা শিখতে। আর বলি, ক্যামেরা নয়, মানুষ ছবি তোলে। সব কিছু নির্ভর করে তোমার দেখার উপর, তোমার দেখাটাকে তুমি কিভাবে উপস্থাপন করছ তার উপর। এমন অনেকেই আছেন যারা তাদের ক্যামেরা, ফোন, পোশাক, ল্যাপটপ, বাড়ি-গাড়ির প্রশংসা শুনতে পছন্দ করেন, কারণ এসবই এসেছে তাদের মেধা আর শ্রমের ফল হিসেবে। কিন্তু সত্যিকারের রাঁধুনি যেমন "তোমার হাড়ি পাতিল খুব দামি" শুনে মন খারাপ করবে তেমনি সত্যিকারের ফটোগ্রাফার "তোমার ক্যামেরা নিশ্চয়ই খুব দামি" কথাটা অপমান হিসেবেই নেবে। "আপনার পোশাকটা খুব সুন্দর" আর "এই পোশাকে আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে" দুটো বাক্যের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব।

প্রশ্ন হল শাড়ি বাঙ্গালী মেয়েদের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলে কি না? বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম পোশাক, আর সেটা এসেছে বিভিন্ন দেশের পরিবেশ ও আবহাওয়াগত কারণে। সাধারণ মানুষের কাছে পোশাক যতটা না ফ্যাশান, তার চেয়ে বেশি নিরাপত্তা (শীত প্রধান দেশে এক রকম পোশাক, মরুভূমিতে অন্য রকম), প্রকৃতিকে মোকাবেলা করার অস্ত্র। এটা এক ধরণের অভ্যস্ততাও বলা যায়। যেমন রাশিয়ার মত দেশে কাউকে শাড়ি পরতে দেখলে সবাই তাকিয়ে থাকে। এক্সোটিক বলে মনে হয়। আমাদের দেশেও এক সময় মেয়েরা প্যান্ট পরত না, এখন পরে। তখন চোখে লাগলেও এখন আর চোখে লাগেনা। আমার ছোটবেলায় গ্রামে শুধু মৌলবি স্যারের বৌ কোথাও গেলে বোরকা পরতেন। এখন অনেকেই পরেন। তবে এটাও ঠিক বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য যদি আমরা ধরে রাখতে চাই, শাড়ি বাদ দিয়ে সেটা কল্পনা করা কষ্ট।

আমরা কথায় কথায় গণতন্ত্র, মানবতা এসব কথা বলি। গণতন্ত্র, মানবতা - এসবের মূলে রয়েছে ব্যক্তি মানুষ। কিন্তু কোন প্রসঙ্গে কথা উঠলেই আমরা আর ব্যক্তি মানুষ থাকি না, আমরা হয়ে উঠি সমষ্টি - আমরা হই বাঙ্গালী, বাংলাদেশি, মুসলমান, হিন্দু, নারী, পুরুষ ইত্যাদি ইত্যাদি আর আমরা এদের প্রতিনিধি হয়ে কথা বলতে শুরু করি ঠিক যেমন রাজনীতিবিদরা জনগনের নামে কথা বলে। বৌয়েরে সাথে  আমার না পড়লে, আমার সংসার না টিকলে আমি ভাবি সব নারীই এরকম, শুরু করি নারী বিরোধী আন্দোলন। ভুলে যাই আমার নিজের অনেক বন্ধুই সুখে সংসার করছে। সমস্যা যে নারীতে নয় আমার নিজের মধ্যেই সেটা যাচাই করিনা। এর মানে আমি আমার নিজের সমস্যা অন্যের ঘাড়ে, সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে বিপ্লব করি। এ এক অদ্ভুত কালেক্টিভিজম। সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে এসব বিপ্লব করতে পয়সা লাগে না। দরকার মাঝে মধ্য একটা চিল খুজে বের করা আর সময় বুঝে চিৎকার করা "চিলে কান নিল" বলে। ব্যস। হুজুগে পাবলিক এমন ইভেন্টের অপেক্ষায় বসেই আছে। হার-জিত বড় কথা হয়, ইস্যু বড় কথা নয় - আসল কথা সম্মিলিত দৌড়, নিজেকে কোন ঘটনার অংশ মনে করা। যে আমি আগে নিজেকে বড়জোর পাচ-সাত-দশ জনের একটা কালেক্টিভের অংশ মনে করতাম, সে আমি এখন লাখ জনতার অংশ। আমিও লাখ মানুষের সামনে আমার ক্ষুদ্র (আমি অবশ্য ভাবি প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ) মতামত তুলে ধরতে পারি। কেউ কেউ হয়ত সেটা পড়েও। এভাবেই একদিন আমি কায়াবিহীন একজন মানুষ হয়ে যাই, ঠিক মানুষ নই, বিশাল এক সমষ্টির ক্ষুদ্র এক অংশ। পিরামিডের এক ইট। যদি ভাগ্য ভালো হয়, যদি ঘটনাক্রমে কোন ইভেন্ট আমি নিজেই শুরু করতে পারি নিজেই একদিন সেই পিরামিডের শীর্ষে উঠে বসতে পারি। ভুলে যাই আমার নীচের ইটগুলো চলমান মানুষ, তারা যেকোনো সময় সরে যেতে পারে আর আমি নিজেও অবলীলায় পদদলিত হতে পারি।                  
অনেককেই অনেক সময় বলতে শুনি বামপন্থীদের মধ্যে হাজার বিভেদের কথা। কারণ এরা সবাই একেক জন একেকটা আইডিয়া। যার ফলে এদের সমঝোতায় আসা কষ্ট। প্রতিযোগিতার এই যুগে নিজের আইডিয়াকে সামনে আনতে হলে অন্যদের পেছনে ফেলতে তো হবেই। তাই এত মারামারি, কাটাকাটি। এর সুযোগ কিন্তু নেয় শত্রুরাই। তারপরেও নিজেকে সান্ত্বনা দিই এই বলে যে "ঈশ্বর মঙ্গলের প্রতীক। তাঁর কত নাম। কত দলাদলি, খুনাখুনি তাঁকে নিয়ে। অথচ শয়তান একটাই।" আমাদের এই দলাদলিও প্রমাণ করে আমরা মঙ্গলের পক্ষে।

দুবনা, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯    
                       


Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি