জীবন

খুব সকালে কল্যাণ দা ফোন করল। আমাকে সাধারণত এত সকালে কেউ ফোন করে না বিশেষ কাজ না থাকলে। বুঝলাম দুঃসংবাদ আছে। 

- অশোক মামা মারা গেছেন। 
অশোক মামা, আমাদের সেজো মামা। 

আজকাল প্রায়ই দিন শুরু হয় কোন না কোন মৃত্যু সংবাদ শুনে। কয়েক দিন আগে দিলীপ দা মারা গেলেন। আমাদের মেসতুতো ভাই। অশোক মামার মৃত্যু সংবাদ শুনে একের পর এক স্মৃতি ভেসে উঠল মনের কোণে। 

ইদানীং খেয়াল করলাম অনেক লোক সম্পর্কে আমি ভাবি বা জানি তাদের মৃত্যুর পর। ইনস্টিটিউটে প্রচুর লোকজনের সাথে কাজকর্ম করি। হাই হ্যালো হয়। শুধুমাত্র যারা আমার ফিল্ডে কাজ করে ওদের সম্পর্কে কমবেশি জানি। অন্যদের সম্পর্কে শুধু একটু আধটু।  উনি নামকরা বিজ্ঞানী, এই ফিল্ডে কাজ করেন ইত্যাদি। শুধুমাত্র কেউ মারা গেলে যে অরবিতুয়ারি বা নেক্রোলগ লেখা হয় সেটা পড়ে তাদের সম্পর্কে জানি, দুঃখ হয় কেন জীবদ্দশায় আরও বেশি করে মিশলাম না, জানলাম না। অনেক সময় মনে হয় নিজের সম্পর্কে আমিও অনেক নতুন কিছু জানব নিজের নিক্রলগ পড়ে। 

আমার বাংলাদেশ মানে তরা গ্রাম। জীবনের প্রথমটা সেখানেই কাটে, এরপর মস্কো। হয়তো দেশে ফিরে চাকরি করলে প্রগতিশীল ধারার অনেক মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হত। করোনা কালে প্রচুর মানুষ মারা গেলেন। তাদের বিরাট অংশের চিন্তাধারা আমার সাথে মেলে। তাদের সম্পর্কে  আমার বন্ধুরা যখন লেখে, বুঝি দেশে থাকলে আমারও হয়তো সুযোগ হত তাঁদের সান্নিধ্য পাবার, তাঁদের স্নেহধন্য হবার, তাঁদের অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করার। 

আসলে মানুষ যখন প্রশ্ন করতে শেখে তার আগে তাকে জীবনের একটা বিরাট পথ পাড়ি দিতে হয়। অনেক অভিজ্ঞতায়, অনেক জ্ঞানে জ্ঞানী হতে হয়। কেবল মাত্র তখনই সঠিক প্রশ্ন করা যায়।  কিন্তু এর মধ্যে উত্তর যারা দিতে পারতেন তাদের অনেকেই ছবি হয়ে যান। অনেক প্রশ্নের উত্তর তাই বাতাসে ভেসে বেড়ায়, অবয়ব পায় না।  

অশোক মামার সাথে আমার প্রথম দেখা ১৯৬৯ সালে। দেশ ভাগের পরপর চার মামা আর মাসীমা ভারত চলে যান, দেশে থেকে যান শুধু মা। জনি না আমার জন্মের আগে মা এত ঘনঘন ভাইবোনদের সাথে দেখা করতে ইন্ডিয়া যেতেন কিনা। কেননা তখন আমাদের অনেকগুলো পিঠাপিঠি ভাইবোন জন্ম নেয়। আমিই ছিলাম শেষ সন্তান। ইন্ডিয়া যাওয়ার আগে মার মুখে প্রায়ই মামাদের আর মাসীমার  গল্প শুনতাম আর প্রতি সপ্তাহে ওদের কেউ না কেউ মাকে চিঠি লিখতেন। তাই মামাদের বা মাসীমাকে না দেখলেও তাঁরা ছিলেন আত্মার আত্মীয়। 

১৯৬৯ সালে প্রথমবার ইন্ডিয়া গেলাম মার সাথে। আমি আর রতন। ও সময় অশোক মামা আর সুবোধ দা কাজ করতেন বোকারো স্টীল সিটিতে। দু জনেই ইঞ্জিনিয়ার। সুবোধ দা থাকেন বউদিকে নিয়ে। আমরা ওখানেই আস্তানা গাড়লাম। বউদি তখন অন্তঃসত্ত্বা। ওদের ছেলে বাপি আমাদের ঘরে প্রথম সন্তান। আমি বউদিকে সাধ খাইয়েছিলাম। অনেকপরে ২০১১ সনে সাধ খাওয়ালাম মুন্নাকে যখন জন্ম নেয় রিতম, আমাদের পরের জেনারেশনের শেষ প্রতিনিধি। যাহোক, অশোক মামা থাকতেন একটু দূরে, অন্য এক ফ্ল্যাটে। অনেক বিকেলে আমরা হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম ওখানে। মামা তখনও বিয়ে করেননি। ওর বাসার সামনে বাচ্চাদের প্লে গ্রাউন্ড। ওখানে সিঁড়ি বেয়ে উঠে লোহার ঢালু বেয়ে নেমে যেতাম নীচে। আমি গ্রামের ছেলে। এসব আমরা করতাম কালীগঙ্গার তীরে, জল দিয়ে পাড় ভিজিয়ে। ওখানে অনেক সময় চারায় কাটা ছেঁড়ার ভয় ছিল। এখানে সে ভয় নেই। মামার ওখানে চা বিস্কুট আর মিষ্টি খেয়ে সবাই মিলে ফিরে আসতাম দাদার ওখানে। অশোক মামা ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, যাকে বলে সুপুরুষ।  সেই দিনগুলো আজও স্মৃতিতে গেঁথে আছে।

এরপর ইন্ডিয়া যাই ১৯৭২ সালে। তখন কি মামার সাথে দেখা হয়েছিল? মনে নেই। হলেও খুব অল্প সময়ের জন্য। সুবোধ দা তখন কোলকাতায় চিকিৎসারত। তাই বোকারো আর যাওয়া হয়নি। এরপর শুনলাম ইংল্যান্ড থেকে মামা ভালো অফার পেয়েছেন। কিন্তু মামা যেহেতু বিয়ে করেননি, তাই দাদু তাঁকে যেতে দিলেন না পাছে মেম বিয়ে করে। এখন মনে হয় আমি মস্কো আসার আগে দাদু বেঁচে থাকলে সেখানেও ভেটো দিতেন। মামা পরে দেশে বিয়ে করে সেখানেই রয়ে গেলেন। মস্কো থেকে আমাদের অনেক বন্ধুই ইংল্যান্ড যেত সামারে কাজ করতে, কেউ কেউ আত্মীয়ের বাসায়। তখন মনে হত, ইস, মামা ইংল্যান্ডে থাকলে ঘুরে আসা যেত। ভিসাও নিয়েছিলাম একবার, যাওয়া হয়নি। এরপর আর কখনও ইচ্ছেও করেনি ওদিকে যাবার। আমার ধারণা, ব্রিটিশ ভারতে জন্ম নিলে আমি বিপ্লবী হতাম। ইংল্যান্ড বা ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও জাতি হিসেবে ওদের প্রতি আমার বিদ্বেষ এখনও তুষের আগুনের মত জ্বলছে। 

আশক মামার সাথে শেষ দেখা ২০১৪ সালে। সেবার ইন্ডিয়া যাই বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে সংক্ষিপ্ত ট্যুরে। মামা তখন চাকরি থেকে অবসর নিয়ে কোলকাতা থাকেন মামিকে নিয়ে। ওদের একমাত্র ছেলে হায়দ্রাবাদে চাকরি করে। মামি অনেক দিন থেকেই অসুস্থ। এর আগে মামা ছিলেন দৈত্যের মত। আমি হাঁ করে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এবার দেখলাম আমরা দুজনে মাথায় সমান। মামাই বয়সের ভারে ছোট হয়ে গেছেন নাকি আমি বড় হয়ে গেছি, কে জানে? সময়ের অভাব, তাই বেশিক্ষণ বসা হয়নি। তবে যোগাযোগ ছিল। আমার কাজকর্ম নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। কসমোলজির উপর আমার বইটার খসড়া পড়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ সাজেশন দিয়েছেন। মাঝেমধ্যে লিখে জানাতেন যে আমার নাবলাবাণী থেকে শুরু করে বিভিন্ন লেখা শুধু পড়েনই না রীতিমত সংগ্রহ করেন। বলতেন আমি যেন রাজীনীতি বা সামাজিক ব্যাপারে না লিখে বিজ্ঞান নিয়েই লিখি। এ নিয়ে আমাদের হয়াটস আপে ছোটোখাটো বিতর্কও হত। জন্মদিনে, নববর্ষে, বিজয়ায় উইশ করতেন। আমিও উত্তর দিতাম। 

এবার জন্মদিনে নিজে ব্যস্ত ছিলাম কঙ্কাল নিয়ে, তাই মামার কথা মনে হয়নি। পরশু কল্যাণ দার সাথে কথা হল, গতকাল রতনের আর স্বপন দার সাথে। রতন বল অশোক মামার সাথে কথা হয়েছে। ভালো আছেন। মামিমা আগের মতই। সঞ্জয়কে নিয়ে চিন্তিত। তখন মনে হল অশোক মামার বার্থডে উইশ পাইনি, নববর্ষের শুভেচ্ছাও এখনও পৌঁছেনি। ভাবলাম নিজেই লিখব। তারপর কিসব কাজে যথারীতি ভুলে গেছি। 

কল্যাণ দার ফোন এলে মনে হল কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু এটা যে অশোক মামা সেটা ধারণা করিনি। সারা জীবনে মামার সাথে যত কথা বলা হায়নি, আজ সকাল থেকে তারচেয়ে অনেক বেশি কথা বলে ফেলেছি দুজনে। মৃত্যু স্থান কালের দূরত্ব কমিয়ে দেয়। আচ্ছা জন্মের আগেও কি জীবন আছে অথবা মৃত্যুর পরে? যদি আমাদের অস্তিত্ব শুধু জন্ম মৃত্যুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে তাহলে সেটা মনে হয় গাউসের ডিস্ট্রিবিউশন ফাংশন অথবা ডাইরাকের ডেলটা ফাংশন জাতীয় কিছু একটা। জন্মের আগে পর্যন্ত এর ভ্যালু শূন্য, যেমনটা মৃত্যুর পরে। আর জন্ম আর মৃত্যুর মাঝে এর ভ্যালু পজিটিভ। এই সময়টা জীবন পরিপার্শ্বের সাথে ইন্টার‍্যাকট করে আর জন্মের আগে ও পরে করে না। ঠিক যেমনটা ডার্ক এনার্জি সেটা করে না। তবে ডার্ক এনার্জির অস্তিত্ব আমরা বুঝতে পারি মহাবিশ্বের ত্বরিত সম্প্রসারণ থেকে, মৃত্যুর পরে জীবনের অস্তিত্ব আমরা টের পাই আমাদের স্মৃতির পরতে পরতে। 

মৃত্যু মনে হয় ডিপোজিটে রাখা জীবনের শেষ সম্বল। একান্তই ব্যক্তিগত। কাউকে দান করা যায় না। পাওয়ার অফ এটর্নী করে কারো কাছে হস্তান্তর করা যায় না। দিনের শেষে লকার থেকে নিজেকেই তা উঠাতে হয়। এরপর শুরু হয় অন্তহীন যাত্রা নক্ষত্রের দেশে। আলো আর আঁধারে ঘেরা এ পথ কোন শুরু জানে না, শেষ জানে না। এ এক মৃত্যুহীন অনন্ত জীবন।       

দুবনা, ০২ জানুয়ারি ২০২১ 




Comments

  1. সুন্দর লিখেছেন ভালো লাগলো,আবার মনে ভিতর কিছুটা চাপা কষ্ট হচ্ছিলো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কষ্টের কী আছে। এটা জীবন আর জীবন সমসময়ই আনন্দময়। ধন্যবাদ!

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

রাজনীতি

স্মৃতি