বিফল বিনিয়োগ


বছরেরে শেষে কে যেন লিখেছিলেন "সরকার ও এনজিওর পক্ষ থেকে এত টাকা খরচ করার পরেও কেন নারী নির্যাতন কমছে না।" প্রশ্নটা মনে গেঁথে যায়, তাই দু কলম লেখার ইচ্ছে। দেশ সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমিত, মূলত ফেসবুক নির্ভর, তাই লেখাটা কতটুকু অব্জেক্টিভ হবে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবুও ফেসবুকে বিভিন্ন লেখা পড়ে মানুষের বা সমাজের একটা সাইকোলজিক্যাল চিত্র পাওয়া যায়। সমস্যা হল এই মতামতের একাংশ অন্ধভাবে সরকারে বিশ্বাসী, আরেক অংশ অন্ধভাবে সরকার বিরোধী। এখানেই আমার মনে হয় প্রশ্নের উত্তর নিহিত। 

আমাদের দেশ তো বটেই, সারা বিশ্বেই এখন রাজনীতিতে দুট ট্রেণ্ডঃ যারা ক্ষমতায়, তারা যেকোনো প্রকারে সেটা ধরে রাখতে চায় আর যারা ক্ষমতার বাইরে তারা যেকোনো উপায়েই হোক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়। এ যেন জীবনপণ নয়, মরণপণ লড়াই। বিগত প্রায় তিন যুগ ধরে ক্ষমতাশীল দল সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে বিরোধী দলকে ধ্বংস করতে। ফলে গণতন্ত্র বলি আর জবাবদিহিতা বলি - রাজনীতির এসব মূল উপাদানগুলো জনজীবন থেকে উধাও হয়েছে। অনেক দূরে যেতে হবে না, এমন কি ফেসবুকে প্রকাশিত বিভিন্ন গল্প পড়লেই সেটা বোঝা যায়। এসব গল্পের মূল কথাই হল বৌয়ের সাথে শাশুড়ির, সন্তানের সাথে বাবা মার, পুরুষের সাথে নারীর মরণপণ লড়াই, তাদের পারস্পরিক শত্রুতা। এখন অনেক গল্প লেখা হয় বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে। আচ্ছা এটা কি শুধুই খারাপ কিছু? আমরা নিজেরাই ছেলেমেয়েদের এমন ভাবে শিক্ষা দিই, যার মূল লক্ষ্য যদি বিদেশে না হয় দেশেই কোন বড় কোম্পানিতে কাজ করা। ছেলেমেয়ে সবাই শিক্ষিত হচ্ছে, চাকরি করছে। অনেক বাবামা তাঁদের পরিচিত পরিবেশ ছেঁড়ে কোথাও যেতে চান না, এমনকি সেটা যদি সন্তানদের কাছেও হয়। তাহলে কি তাঁদের জন্য কোন কেয়ারটেকার রাখা ভালো? নাকি বৃদ্ধাশ্রম, যেখানে কেয়ারটেকার যা খুশি তাই করতে পারবে না আবার বাবা মা এই বয়সে একাকীত্ব বোধ করবেন না? আমি বলছি না সবাইকে এই প্রেস্ক্রিপশনে চলতে, কিন্তু ঢালাও ভাবে কনকিছুই খারাপ বলা ঠিক নয়। একাধিক অপশন অনেক ভালো। অর্থাৎ সমাজেও আমরা দেখছি নিজে যেটা ভাবি তার বাইরে কোন কিছু গ্রহণ করতে আমরা মোটেই আগ্রহী নই। আর এটা আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশের ফল। 

প্রশ্ন করতে পারেন হঠাৎ এই ধান ভানতে শিবের গীত কেন? কথা হচ্ছে নারী অধিকার নিয়ে, এর সাথে এ সবের কি সম্পর্ক। গণিত বা পদার্থবিদ্যায় যেন কোন সমস্যা সমাধানের অন্যতম প্রধান শর্ত হল সঠিকভাবে সমস্যার প্রতিস্থাপন। এরপর দেখতে হয় মূল সমস্যার সাথে আরও কি কি সমস্যা দেখা দিতে পারে। এরপর সমস্যার সম্ভাব্য কি কি সমাধান হতে পারে। সর্বশেষ প্রাপ্ত সমাধানগুলোর মধ্যে যেগুলো ফিজিক্যাল সেসব রেখে বাকি সব বাদ দেওয়া। অনেকটা ছবি তোলার মত যেখানে ক্রপিং একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে। 

এবার ফিরে আসা যাক আমাদের প্রশ্নে? কেন সরকার বা এনজিওর পক্ষ থেকে এত উদ্যোগের পরেও নারী তার অধিকার পাচ্ছে না। এর মূলে আছে সমস্যার সার্বিক সমাধান না খুঁজে আংশিক সমাধান খোঁজা। মনে রাখতে হবে আদিম যুগে, যখন পশু শিকার ছিল মূল জীবিকা, তখন সমাজ কমবেশি ছিল মাতৃতান্ত্রিক। পুরুষ সে সময় ফিরে আসবে কি না সেটা নিশ্চিত ছিল না। নারীর উপর দায়িত্ব ছিল মানব জাতিকে বাঁচিয়ে রাখার। পরে যখন কৃষির আবিষ্কার ঘটে, প্রশ্ন আসে ব্যক্তি মালিকানার, পুরুষ ধীরে ধীরে নারীর অধিকার খর্ব করতে শুরু করে। সময়ের সাথে সমাজে ক্ষমতা বা পুঁজির গুরুত্ব যতই বেড়েছে, নারী ততই তার অধিকার হারিয়েছে। এরমধ্যে যোগ হয়েছে ধর্মের বয়ান, যা নারীকে পথে বসিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যতই নারী পুরুষের সাথে সমানে সমানে সামাজিক জীবনে অংশ নিচ্ছে পুরুষ ততই বেপারোয়া হয়ে উঠছে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে। ফলে বাড়ছে অসহিষ্ণুতা। তাই সরকার বা এনজিও যখন নারীকে শিক্ষিত করছে, তাকে স্বাবলম্বী হতে শিখাচ্ছে, অনেক পুরুষই এটাকে তাদের অস্তিত্ব সংকট বলে মনে করছে, আরও মরিয়া হয়ে বাধা দিচ্ছে নারীকে। বাড়ছে ধর্ষণ, শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা। এতেই বোঝা যাচ্ছে সমস্যাটা কমপ্লেক্স হলেও সরকার বা এনজিও এক চোখা ভাবে এটার সমাধান করতে চাইছে। অবশ্যই নারীশিক্ষার বিকাশ ঘটলে, তাকে সমাজমুখী করলে নারী স্বাবলম্বী হয়, কিন্তু এতে করে তাদের প্রতি পুরুষের মনোভাব বদলায় না। বরং স্বাবলম্বী নারীদের একাংশ বিভিন্ন পুরুষ বিরোধী বক্তব্যের মাধ্যমে এমনকি নারীর প্রতি সহানুভুতিশীল, নারীর সমান অধিকারে বিশ্বাসী অনেককেই শত্রু না বানালেও বন্ধু থাকতে দেয় না। আর এজন্যে নারী শিক্ষার সাথে সাথে যেটা দরকার তা হও নারী ও পুরুষ উভয়কে পরস্পরের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখানো। আর এটা করা সম্ভব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাঙ্গনে পরিবেশ আর পাঠ্যসূচীর পরিবর্তন এনে।  দুঃখজনক হলেও সত্য কোন ধরণের ধর্মীয় শিক্ষাই নারীর সমান অধিকারে বিশ্বাস করে না। তাই দেশে একদিকে ধর্মীয় শিক্ষা বাড়িয়ে আর অন্যদিকে নারীকে স্বাবলম্বী হতে শিক্ষা দিয়ে এ সমস্যার সমাধান তো করা যায়ই না, বরং আন্টাগনাস্টিক দুটো গ্রুপ তৈরি করে। ফলে নারী নির্যাতন কমে না, বরং বাড়ে। একই কথা বলা চলে ধর্মীয় ব্যাপারে। যতদূর জানি, ইদানীং সরকারের পক্ষ থেকে শুধু মসজিদ তৈরি জন্যই অজস্র অর্থ ব্যয় করা হয় না, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খৃস্টানদের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালনের জন্যও প্রচুর পরিমাণ সরকারী অনুদান দেওয়া হয়। কিন্তু এসবের পরেও  বিগত বছরগুলোতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বেড়েই চলছে। আর তার কারণও একটাই - ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটাই কমবেশি ট্যাবু হয়ে গেছে, শিক্ষা ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তো শেখানো হয়ই না, বরং পাঠ্যসূচীও সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়। একই কথা বলা যায় প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। এসব কারণেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পরেও যেখানেই সরকারী উদ্যোগকে ধর্মীয় গোঁড়ামির সাথে সংঘর্ষে যেতে হয়, সরকার লেজ গুটিয়ে পিছু হটে। ফলে নারীর উন্নয়নে বিশাল অংকের অর্থ বিনিয়োগ করার পরেও দিনের শেষে আশাতীত ফল পাওয়া যায় না, উল্টো, অবস্থা আরও ভয়াবহ হয়। অন্তত বর্তমান বাংলাদেশে নারীর আরও পর্দানশীন হওয়া, ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া সেই ইঙ্গিতই দেয়।         

দুবনা, ০৪ জানুয়ারি ২০২১ 





Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি