পথ চলা কথা বলা


আজ ছিল সেভার জন্মদিন। আজ থেকে ১৮ বছর আগে ২০০৩ সালের ২ জানুয়ারি সেভা আসে আমাদের ঘর আলো করে। তারপর এক এক করে ঝরে যায় আঠারোটি বসন্ত। সেভা আজ থেকে সাবালক। এখন থেকে সমস্ত কাজকর্মের আইনি দায়দায়িত্ব ওর নিজের। সে অর্থে বাবামা হিসেবে আমাদের একটু হালকা লাগার কথা। ২০০৮ সালে যখন গুলিয়ার সাথে মূলত বাচ্চাদের মানুষ করার পদ্ধতি নিয়ে আমাদের মনোমালিন্য ঘটে আর টের জের ধরে আমরা আলাদা থাকতে শুরু করি, ভেবেছিলাম সেভার আঠারো বছর পূর্ণ হলে রাশিয়া ছেঁড়ে চলে যাব। তবে ২০১২ সালে আমরা নিজেদের মতানৈক্য দূর করার ফলে সেটা হল না, গত ২৮ ডিসেম্বর আরও পাঁচ বছরের জন্য দুবনায় আমার চাকরির মেয়াদ বাড়ালাম।  

গত কয়েকদিন যাবত বিভিন্ন কারণে বার বার ফিরে যাচ্ছিলাম অতীতের দিনগুলোয়। সেভার যখন জন্ম, আমি তখন অভিজ্ঞ বাবা। মনিকার জন্মের সময় ছিলাম অনভিজ্ঞ। বলতে গেলে ওর জন্যেই এদেশে থেকে যাওয়া। সেটা ৯০ এর দশক। আমার চারিদিকে অনিশ্চয়তা আর দারিদ্র্যের আকাশচুম্বী প্রাচীর। এদেশে আসার আগে অভাব কাকে বলে সেটা জানতাম না। ছাত্র জীবনেও ভালই ছিলাম। সবচেয়ে বড় কথা কেউ আমার মুখ চেয়ে বসে থাকত না। মনিকার জন্মের পরে প্রথম বুঝলাম দায়িত্ব কাকে বলে, কাকে বলে সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দেওয়া। তখন মস্কোয় নাকি বাতাসে টাকা ভেসে বেড়াত। বন্ধুদের অধিকাংশই ব্যবসা করত। ওদের বলতে শুনতাম লাভে ক্ষতি হওয়া। এদিকে আমার সন্তানের মুখের ভাত জোটাতে নাভিশ্বাস। বড়রা যখন অসহায় হয়, তখন নিজের অসহায়ত্বের জন্য নিজেকে দায়ী না করে যারা সত্যি দুর্বল, সেই বাচ্চাদের উপর সব দোষ দেয়। এটা ঠিক, মনিকা না এলে আমি হয়তো সান্তা বারবারা ইউনিভার্সিটি থেকে পাওয়া পিএইচডির অফার গ্রহণ করতাম, বা ইতালিতে থাকার চেষ্টা করতাম, কিন্তু ঘরে যার দুধের শিশু, পকেট যার গড়ের মাঠ, তার এসব শোভা পায়না। ফলে নিজের অসহায়ত্বের ঝাল মিটাতাম মনিকার উপরে। প্রচণ্ড ভালবাসার পরেও কখনও কখনও শাস্তি দিতাম। বলতে গেলে বিনা কারণে। নিজের অপারগতাকে ঢাকতে। ওকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করলে বলে 'পাপা, তোমার ভালবাসা ছিল শাস্তির চেয়ে অনেক বেশি। আমি কিছুই মনে রাখিনি।" কিন্তু আমি এ নিয়ে এখনও এক ধরণের অপরাধ বোধে ভুগি। ফলে ক্রিস্টিনার গায়ে কখনও হাত তুলিনি। এতদিনে বুঝে গেছি সন্তান তার বাবামাকে বেছে নেয় না, তাদের কোন দায়দায়িত্ব নেই বাবামার ব্যর্থতায়।  

গুলিয়া যখন বলে ওর প্রেগনেন্সির কথা, হঠাৎ যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল মাথায়। এর মধ্যে তিন তিনজন ছেলেমেয়ে। ১৯৯৮ সালের ডিফল্টের পর আমাদের আবার পথে বসার অবস্থা। সেটা সবে কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছি, সে সময় এই খবর। গুলিয়া বলে বাচ্চাদের জামাকাপড় সব আছে। তিন জন আর চার জনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু বাচ্চারা সারাজীবন ছোট থাকে না। খাওয়া পরার পাশাপাশি দরকার শিক্ষা। আরও সমস্যা হল আমি বাইরে যাই, লোকজনের সাথে মিশি। তিন বাচ্চার কথা শুনে ইতিমধ্যেই লোক হাসে। তাই অনেক বুঝিয়ে ওকে নিয়ে গেলাম গাইনোকলজিস্টের কাছে। সব খুলে বললাম। প্রথমে বাধা দেবার চেষ্টা করলেও সব শুনে বললেন পরের দিন আসতে আবরেশনের জন্য। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি রেডি হলাম। অনেক সাধাসাধির পরে গুলিয়া রেডি হল। তারপর আন্তন, মনিকা আর ক্রিস্টিনাকে ডেকে বলল "তোমাদের কে কে ভাই চাও।"  আন্তন বলল সে ভাই চায়। মনিকা পাপার ন্যাওটা। বলল, "পাপা যেটা চায়, আমি তাই চাই।" স্কোর ২ - ২। এবার ক্রিস্টিনার পালা। ক্রিস্টিনা রায় দিল মামার পক্ষে। এভাবে আমাদের সংসারে গণতন্ত্রের কাঁধে ভর করে সেভা এলো। 

২০০২ সালের সেপ্টেম্বর। আমরা সন্তান হবার কথা কাউকে বলিনি। আমি আর আমার প্রথম লোকাল বস যাচ্ছি মস্কো ইয়াকভ পেত্রভিচ তেরলেতস্কির ৯০ বছর উপলক্ষ্যে একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে। ভ্লাদিমির মিখাইলোভিচের বয়স তখন ৬৫। কিছুদিন আগে আবার দিয়ে করেছেন। বৌ তখন  তিরিশে পা রেখেছে। এর মধ্যে এক মেয়েও হয়েছে তাঁদের। ওনার অবশ্য অনেকগুলো সন্তান, তবে বৌয়ের সংখ্যা তার চেয়েও বেশি। আমরা যখন তুলস্কায়া থেকে সেরপুখভস্কি ভাল ধরে হেঁটে ইউনিভার্সিটির দিকে যাচ্ছি, উনি বললেন "লেনা প্রেগন্যান্ট।" সুযোগ পেয়ে আমিও বললাম, "গুলিয়াও গর্ভবতী।" "তভায় মাত" - তাঁর মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল। আমি অবশ্য অন্য কিছু আশা করিনি। ওই সময়ে চতুর্থ সন্তান নেওয়া - এটা ছিল পাগলামী।  কিন্তু তখন আর পিছু ফেরার উপায় নেই। পথ একটাই - সামনে চলা। এর মধ্যে জেনে গেলাম এ হবে ছেলে সন্তান। শুরু হল নাম খোঁজা। দুজনেই চেয়েছিলাম নামটা যেন ন দিয়ে শেষ হয়। আমাদের বাড়ির প্রায় সবার নাম ন দিয়ে শেষ - বাবা বৃন্দাবন, আমরা স্বপন, তপন, কল্যাণ, রতন আর বিজন। শুধু সুবোধ আর সুধীর এই দু ভাই ভিন্ন ছন্দে গেছে। গুলিয়ার দাদুর নাম ইভান, ভাই রুসলাম, বড় ছেলে আন্তন। তাই সেভাবেই নাম খোঁজা শুরু। ইভান, রোমান, স্তেপান, সিমন। কিন্তু মনিকা আর ক্রিস্টিনার নামের সাথে রুশ প্রথা অনুযায়ী বাবার নাম নেই, তাই গুলিয়া বলল নামটা একটু বড় হলে ভালো হয়। এভাবেই ঠিক হল সেভাস্তিয়ান বা সেভা। 
আন্তন আর মনিকার জন্ম মস্কোয়, ক্রিস্টিনার দুবনায়। পুরা প্রেগনেন্সি মস্কোর ২৫ নম্বর প্রসুতি হাসপাতালে নিজের ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে থাকলেও (গুলিয়া নিজেও এই ডাক্তারের তত্ত্ববধানে জন্ম নেয় ৬০ এর দশকে, আমাদের চার সন্তানের  গর্ভকালীন পর্যবেক্ষণ উনিই করেন) ঠিক করি ক্রিস্টিনার মত সেভার ডেলিভারিও হবে দুবনায়। এবার আমরা নিজেরাই ডাক্তার ঠিক করলাম কিছু পয়সার বিনিময়ে। সম্ভাব্য ডেট ছিল জানুয়ারির ৯ তারিখ। ভদ্রমহিলা বললেন, উনি ছুটিতে চলে যাচ্ছেন, তাই আমরা যেন ২ রা জানুয়ারিই ডেলিভারিটা করাই। পয়লা জানুয়ারি নববর্ষ পালন করে ২ তারিখ সকালে চলে গেলেই হবে। উনি আমাকে প্রস্তাব দিলেন সে সময় পাশে থাকতে। বাসায় ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, তাই পাশে থাকা হল না। এখন মনে হয় সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করা আবশ্যক ছিল। ২ রা জানুয়ারি সেভার জন্ম হল। আন্তন, মনিকা আর ক্রিস্টিনাকে নিয়ে গেলাম সেভাকে দেখতে। ছবি তুললাম। ঘর সাজালাম। দু দিন পরে সেভা এলো আমাদের ঘরে। মাস খানেক পরে আন্তনকে নিয়ে মস্কো গেলাম সেভার রেজিস্ট্রেশন করতে। মস্কো আমাদের স্থায়ী বাস, তাই বার্থ সার্টিফিকেট ওখানেই করতে হবে। ওখানে এসে শুনলাম এর মধ্যে আমি যেহেতু রুশ নাগরিকত্ব নিয়েছি নামের সাথে বাবার নাম রাখতে হবে। এর মধ্যে সেভা নামের সাথে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি, পরিবর্তনের কথা মাথায় আসেনি। যিনি ডকুমেন্টের জন্য কাগজপত্র ঠিক করছিলেন, বললেন, "ছেলে তো খুক লাকি। বাবার সাথে একই দিনে জন্ম নিয়েছে।" আবার অবাক হবার পালা। আমার জন্ম ২৫ ডিসেম্বর। ক্লাস ফাইভে যখন প্রইমারি স্কুল থেকে সার্টিফিকেট দেন, আমাদের ছোট মাস্টার মহাশয় নিজে থেকেই জন্ম তারিখ করে দেন ২ জানুয়ারি। অফিসিয়াল কাজকর্ম বাদে ওই দিনটার কোন গুরুত্বই ছিল না আমাদের কাছে। শেষ পর্যন্ত ২ জানুয়ারি আমাদের হল। পরে মনিকা খেয়াল করল সেভার জন্ম দিন লেখা যায় ০২.০১.০৩ মানে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস আর ইমারজেন্সি কল। 

সেভা বাড়তে থাকে আমার ছায়ায়। সব সময় ছায়ার মত আমার সাথে ঘুরবে। ছবি তুলতে যাব, সে যাবে। "এটার ছবি তোল।" আমি কেবল ফোকাস ঠিক করছি, দৌড়ে এসে ঘাড়ে উঠে বসলো। কিন্ডার গারটেনে যাব, আমাকে পেছনে ফেলে দৌড়ে চলে যাচ্ছে। একবার আমরা বাচ্চাদের এক অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। সেভা সাইকেলে বসে। হেঁটেই যাচ্ছি। সাথে মনিকা, ক্রিস্টিনা, ওদের বন্ধুরা লিজা, ইউরা, ওদের বাবা আনাতলি আর ছোট্ট ইভান। আমি আর সেভা একটু আগে এসে ওদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। সেভা যে কখন সাইকেল থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেছে খেয়াল করিনি। আমি মনিকাদের বলছি তাড়াতাড়ি করতে। এমন সময় মনিকা বলে উঠল "পাপা ট্রেন আসছে।" আমার তো আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। ওকে ধরতে গেলে যদি দৌড়ুতে শুরু করে নির্ঘাত ট্রেনের নীচে পড়বে। আমি সবাইকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে বলে অপেক্ষায় রইলাম, এমনকি সেভাকে ডাকও দিলাম না। ট্রেন থেকে দু মিটার দূরে ও ঠায় দাঁড়িয়ে রইল আর ট্রেন চলে গেলে হাসতে হাসতে আমার কাছে দৌড়ে এলো। আমি যেন নতুন জীবন ফিরে পেলাম। 

আমরা প্রায়ই ভোলগার তীরে বা বনে ছবি তুলতে যেতাম। আমি সাহস করে নদীতে নামিনি। বরফ গলা শুরু করেছে। ভোলগা তখন বিপদজনক। হঠাৎ দেখি ও নীচে নেমে নদীর উপর জমা বরফে হাঁটছে। উপায় নেই। আমিও নেমে গেছি। অনেক ছবি তুলেছি এভাবে সেভার উদ্যোগে। 

ও মিউজিক স্কুলে যায় চার বছর বয়স থেকে। ওর বয়স তখন পাঁচ। ওকে স্কুল থেকে নিয়ে  বাসায় ফিরব। হঠাৎ মনে হল অফিসে কি যেন ভুলে এসেছি। ওকে গেটের সামনে রেখে ওসব নিয়ে ফিরেছি। সেভা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ভায়োলিন হাতে। 
- পাপা, আমাদের দু জনের মধ্যে কে বেশি বুদ্ধিমান?" 
সত্যি বলতে কি আমি এ ধরণের প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। 
- দেখ, তুই বেহালা বাজাতে পারিস। আমি পারি না। তাই যদি বেহালার কথা আসে, তুমি আমার চেয়ে বুদ্ধিমান। আবার আমি অংক ও ফিজিক্সের অনেক কিছু জানি, তুই জানিস না। এক্ষেত্রে আমি বুদ্ধিমান। তাই কেউ ঢালাও ভাবে বোকা বা বুদ্ধিমান নয়। একটা কাজ একজন ভালো করে, অন্য কাজ আরেকজন। 

সেদিনের উত্তরটা ওর কতটুকু পছন্দ হয়েছিল জানি না, তবে আমার জন্য পাথেয় হয়েছিল। ফলে আমি যেকোনো লোকের কাছ থেকেই কিছু না কিছু শেখার জন্য নিজেকে খোলা রাখি। 

২০০৮ সালে সেভার বয়স পাঁচ পেরিয়েছে। আমাকে ছাড়া ও কাউকে বুঝতে চায়না। সে সময় গুলিয়ার সাথে আমার মনোমালিন্য, বাচ্চাদের নিয়ে ওর মস্কো চলে যাওয়া। এতে আমি তেমন ক্ষতিগ্রস্থ হইনি, বরং নতুন উদ্দমে শুরু করেছি লেখালেখি, ছবি তোলা। আসলে এর আগে পর্যন্ত আমার জীবন ছিল অফিস, বাসার কাজ, বাচ্চাদের এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে নেওয়া। মস্কোর বন্ধুদের সাথেও যোগাযোগ পর্যন্ত ছিল না। বাড়ি যাবার কথা মাথায় আসত না এমন টাইট ছিল আমার সারা দিনের কাজের রুটিন। ১৯৯৬ সালের পর এই প্রথম একটু ফ্রি সময় পেলাম। দেশে গেলাম, মস্কো যাতায়াত শুরু হল, সংগঠন করলাম বন্ধুদের সাথে মিলে। শুরু হল নিজেকে নতুন করে গড়ার পালা। তবে সেভার সাথে শুধু ছুটির দিনে নয়, সব সময় যোগাযোগ ছিল। মনিকা শুক্রবার এলেই দুবনা চলে আসত। সেভার সেই সুযোগ ছিল না। ওকে মোবাইল ফোন কিনে দিলাম। সব সময় ফোন করতে হত। ও কথা বলতে বলে ফোনটা পাশে রেখে খেলত। বিল উঠত অনেক। তারপরেও ফোন ছাড়তে দিত না। ছাড়লে কান্নাকাটি করত। ওর জানার দরকার ছিল যে পাপা পাশে আছে, সাথে আছে। গুলিয়া রাগ করত। মাঝে মধ্যে ওকে ফোন করে পেতাম না। পরে শুনতাম গুলিয়া ভুলে সেটটা ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বললেই বলত সেটা সেভার দোষ, স্কুল থেকে এসে কেন টেলিফোন পকেট থেকে বের করে রাখেনি। ওই সাড়ে তিন বছরে সেভার জন্য কম করে হলেও গোটা দশেক সেট কিনতে হয়েছে। আমাদের বড়দের এই একটা দোষ। স্বামী বা স্ত্রীকে কষ্ট দিতে গিয়ে আসলে সন্তানদের কষ্ট দিই। এ নিয়ে মায়ের উপর সেভার খুব রাগ। সময় পেলে আমাকে শোনায়, অভিযোগ করে আমরা ওকে কষ্ট দিয়েছি বলে। আমি শুধুই অপরাধ বোধে ভুগি। সময় তো ফিরিয়ে আনতে পারব না। 

সেভা যখন মিউজিক স্কুলে যেত শিক্ষকরা খুব আদর করতেন ওকে। আর হাতের গড়ন ছিল পিয়ানো আর ভায়োলিনের জন্য খুবই উপযোগী। শ্রবণশক্তিও খুব ভালো। তবে মায়ের খুব বেশি পিড়াপিড়িতে আগ্রহ চলে যায়। এক সময় অংক খুব পছন্দ করত। আমার কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন করত। এরপর এল ফুটবল। খারাপ খেলত না। তবে প্রায়ই ভায়োলিন আর ফুটবলের সময় একসাথে হত। এ নিয়ে মায়ের সাথে ঝামেলা, শেষ পর্যন্ত মিউজিক বাদ দিল। এখন নিজে এজন্যে দুঃখ করে, তবে আমার কাছে। এরপর শুরু হল কম্পিউটার গেম যা এখনও চলছে। মাঝে কসমোলজি নিয়ে উৎসাহ দেখাল। প্রায়ই বিভিন্ন প্রশ্ন করত। বই দিতাম পড়তে। এর পর বিভিন্ন লেকচার শুনত। ইদানিং মাথায় এসেছে শেয়ার মার্কেট। এ নিয়ে দেখছি পড়াশুনা করতে শুরু করেছে। আমি বাধা দিই না। আমার শিক্ষক কাম শিক্ষা পিতা ইউরি পেত্রভিচ আমাকে উৎসাহ দেন, বলেন জোরাজোরি না করতে, ওকে নিজের মত বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে। আমি নিজেও বাবামা বা কারও কথা শুনিনি এ ক্ষেত্রে। আমার ধারণা মানুষ যাই করুক, সেটা যেন আনন্দের সাথে করে। আমার ছেলেমেয়ারা কেউই আকাডেমিক লাইনে যায়নি। কিন্তু আমি কখনও এ নিয়ে কোন চাপাচাপি করিনি। শুধু বলেছি, তোমাদের যেটা ভালো লাগে তাই কর। তবে যাই কর, ভালো করে কর। আমি পাশে থাকব যতদিন পারি।  অনেকেই বলার চেষ্টা করে আমি নিজে যেহেতু এতটা পড়াশুনা করেছি, আমার সন্তানরা সে পথে যাবে, ভালো রেজাল্ট করবে, ভালো ইউনিভার্সিটিতে পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। অনেক আগে, ওরা যখন ছোট ছিল, আমিও সেভাবেই ভাবতাম। সময়ের সাথে বুঝেছি সেটা হবে আমার নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা ওদের উপর চাপিয়ে দেওয়া। আমি স্বাধীনতার কথা বলি, মুক্তচিন্তার কথা বলি - সেভাবে চলি, তাহলে কোন মুখে আমি নিজের চিন্তা ওদের উপর চাপিয়ে দেব। স্বাভাবিক ভাবেই বাবা হিসেবে আমিও চাই ওরা সুখে থাকুক, স্বচ্ছল থাকুক। তবে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে জানি সুখ নির্ভর করে নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে বিকশিত করার মধ্যে, স্বাধীন ভাবে নিজের আইডিয়া বাস্তবায়িত করার সুযোগের উপর। সমাজ, রাষ্ট্র আমাদের প্রায়ই সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। কিন্তু বাবা হিসেবে আমি যদি সেটা না দিতে পারি, আমি যদি সন্তানের ইচ্ছার মূল্য দিতে না পারি, দিতে না চাই - ওরা কার কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতবে, কার মুখের দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখবে। জানি এটা পথ বন্ধুর, প্রতি পদে পদে বিপদের সম্ভাবনা। কিন্তু জীবন তো বিপদ থেকে পালিয়ে বেড়ানো নয়, বিপদের মোকাবিলা করা, অভিজ্ঞতা দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে একটু একটু করে সামনে এগিয়ে যাওয়া। দিনের শেষে গাড়ি বাড়ি টাকা পয়সা নয়, অভিজ্ঞতাই হবে আমাদের একমাত্র সম্বল। আজ সেভা নতুন জীবন শুরু করল। ও বলে, পাপা আমার ভবিষ্যতের প্রধান অবলম্বন তুমি। ওর এই বিশ্বাসের মূল্য আমি দিতে পারব বলেই ওর বিশ্বাস। আমরা  মাঝে মধ্যে বিভিন্ন ব্যাপারে কথা বলি। ওর মাধ্যে আমি সেই আঠারো বছরের আমিকে দেখি। অনেক ক্ষেত্রে  আরও পরিপক্ক, আরও যুক্তিবাদী, সবচেয়ে বড় কথা যে নিজের মতামত প্রকাশ করতে ভয় পায় না। আমি কি ভয় পেতাম? জানি না। তবে চেষ্টা করতাম না। সেটাই ছিল আমাদের সামাজিক পরিবেশ। তবে এটাও ঠিক এখন ও  ভাবে ওর নিজের মতটাই ঠিক, এটা বয়সের কারণে, অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে। আমিও এক সময় এমনই ছিলাম। সময়, অভিজ্ঞতা আর প্রিয়জনদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা মানুষকে শুধু আত্মবিশ্বাসীই করে না, অন্যের মত শোনার ধৈর্য ও শিক্ষা দেয়। আমি যখন পেরেছি, সেভাও একদিন তা পারবে বলেই আমার বিশ্বাস। এগিয়ে যা। আমি আছি তোর পাশে। 

দুবনা, ০২ জানুয়ারি ২০২০ 





Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি