ক্যাপিটলিয়ায় বিপ্লব


সকালে ঘুম ভাংতেই দেখি ফেসবুকের পাতা ভরে গেছে ক্যাপিটলিয়ার তাণ্ডবে। আমাদের মত অর্ধ-শিক্ষিত মানুষেরা প্রাণ খুলে ঢালাও ভাবে কমেন্ট করছে ঘটনার। না না, আমাদের যাদের কথা বলছি তাঁদের প্রায় সবাই উচ্চ শিক্ষিত, জীবনে প্রতিষ্ঠিত, কেউ কেউ বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তাহলে অর্ধ-শিক্ষিত কেন? কেননা, আমরা আজকাল প্রায়ই আগে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে এরপর স্বাক্ষী প্রমাণ দিয়ে সেটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করি। আর যেহেতু রায় আগেই বেরিয়ে গেছে প্রমাণ করতেই হবে। অনেকটা ক্রস ফায়ারের রাজনীতির মত। যতই দিন যাচ্ছে নিরপেক্ষ ভাবে কিছু বিচার করার ক্ষমতা আমরা ততই হারাচ্ছি। লর্ড হোক আর লুসিফার হোক, একবার যদি কেউ নিজের বিবেক এদের কাছে বিকিয়ে দেয় সে আর নিজেকে মুক্তমনের মানুষ বলে দাবি করতে পারে না। কিন্তু আজ আমরা সেটাই করছি। অন্ধভাবে কোন দল, গোষ্ঠী বা আদর্শকে বিশ্বাস করে শুধু তার ভিত্তিতে সব বিচার করি। আমরা ভুলে যাই কার্য কারণ সম্পর্কের কথা।

ছোটবেলা থেকেই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতাম যার সূত্র ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নে আসা। এখানে পরিচয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সাথে। শিখি সব কিছুকে সন্দেহের চোখে দেখতে, প্রশ্ন করতে। এটা শুধু পদার্থবিজ্ঞানের ক্লাসেই নয়, পদার্থবিদ্যা ও ফিলসফি নামে এক বিশেষ ক্লাস ছিল, সেখান থেকেও। ধীরে ধীরে চোখে পড়ে সমাজতন্ত্রের ত্রুটিগুলো। বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অভাব। আশির দশকের শেষ দিকে মনে হতে থাকে অনেক অপূর্ণতা থাকার পরেও গণতন্ত্র তুলনামুলক ভাবে উৎকৃষ্ট সমাধান। তবে সমাজতান্ত্রিক বণ্টন ব্যবস্থা আর গণতান্ত্রিক বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা প্লাস জবাবদিহিতা যদি বাস্তবে কায়েম করা যায় সেটাই হবে অনেক প্রশ্নের একমাত্র না হলেও অন্যতম প্রধান উত্তর। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অনেক আশা ছিল, তবে কিছুই হয়নি। এরপর একের পর এক বিভিন্ন দেশ আক্রান্ত হয়েছে। রং বেরঙের বিপ্লবে পিপিলিকার মত মরেছে লাখ লাখ মানুষ। সাদ্দাম, গাদ্দাফী, মিলশেভিচ এদের নিন্দা করলেও এর চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েও ক্লিনটন, বুশ, অবামারা দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান। মুক্ত বিশ্বের মুক্ত মানুষ এদের দিকে আঙ্গুল তুলে না। আমেরিকা নিজে যেমন বিনা বিচারে বিভিন্ন দেশে সরকার বদলায়, প্রয়োজনে খুন করতেও পিছ পা হয়না, ঠিক একই আদর্শে তৈরি করে আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেটের মত সংগঠন। এক সময় একটা চুটকি ছিল। “আমেরিকায় কি বিপ্লব সম্ভব?” “না।” “কেন?” “ওদেশে আমেরিকান দূতাবাস নেই।” তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বিপ্লব আমেরিকার দ্বারে। এতদিন পর্যন্ত এই বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি অভিবাসীরা হলেও ট্রাম্প শ্বেত আমেরিকানদের এই ভাইরাসে সংক্রামিত করেছেন বলেই মনে হয়।

একটা সময় আমেরিকান গণতন্ত্রের যে ব্যাপারটা সবচেয়ে ভালো লাগত, সেটা হল শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর। মাঝে মধ্যে এ ব্যাপারে কিছুটা টানাপোড়ন দেখা দিলেও তা কখনোই সীমা ছাড়িয়ে যায়নি। তখন ভাবতাম, কেন আমাদের দেশে বিরোধী দল ভোটের ফলাফল মেনে নিতে পারে না। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য তো শুধু জেতার আনন্দেই নয়, পরাজয়কে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যেও। কিন্তু ২০১৬ সালে ট্রাম্প জেতার পর সবাই যেন গণতন্ত্রের মূল মন্ত্র ভুলে গেল। দেশের এক বিশাল অংশ বস্তুত তাঁকে প্রেসিডেন্ট বলে মানতে পারল না। শুরু হল রুশ হস্তক্ষেপের অন্তহীন সাগা। আমি বলতে পারব না যে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ ছিল না, কিন্তু সে সময় হিলারি ক্লিনটনের উপর যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তা কি মিথ্যে ছিল? একদিন আমার এক সহপাঠী বলল, “তুই আমাদের মন্ত্রীদের এত সমালোচনা করিস কেন?” “দেখ, আমি ওরা তোদের মন্ত্রী বলে সমালোচনা করি না। করি ওরা দুর্নীতি করে বলে।” “কাজটা ভালো করিস না।” “তুই আমাকে না বলে বরং মন্ত্রীদের বল দুর্নীতি না করতে। তাহলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।” অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সেটা বলার সাহস বা স্বদিচ্ছা কারই নেই।

আমি ট্রাম্প সমর্থকদের ক্যাপিটলিয়া অভিযান মোটেই সমর্থন করি না। কিন্তু মনে রাখতে হবে বিগত চার বছরে আমেরিকান এস্টাব্লিসমেন্ট আর মিডিয়া অনবরত ট্রাম্প বিরোধী উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এতে করে ট্রাম্পের সমর্থকরাও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ভাববার কারণ নেই শুধুমাত্র রাশিয়ার কারণে ট্রাম্প জিতেছে। সেটা হবে মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়া। বৃহৎ পুঁজি নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের আভ্যন্তরীণ সমস্যার ফল এই ট্রাম্প। সিনেট ও কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় ভোট ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার ইচ্ছে জাগতেই পারে। এতদিন পর্যন্ত ক্ষমতার মনোপলি কারও হাতে ছিল না, বা থাকলেও মূল দু দলের মধ্যে এক ধরণের বোঝাপড়া থাকায় এনিয়ে কেউ ভাবেনি। তবে বর্তমান বাস্তবতায় সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনুসরণে আমেরিকাও কর্তৃত্ববাদী পথে যে এগুবে না সেই গ্যারান্টিই বা কে দেয়। আশা করব নতুন প্রশাসন গত চার বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তার আভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনবে। সময়ের সাথে নিজেকে বদলাতে না পারলে যেকোনো সিস্টেমই ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। মনে রাখতে হবে গণতন্ত্র শত শত অজানা রাশির শত শত সমীকরণের একটা জটিল সিস্টেম। এই আজানা রাশিগুলো আবার বিভিন্ন ভাবে পরস্পরের সাথে জড়িত। শুধুমাত্র সমস্ত শর্ত পূরণ হলেই এই সিস্টেমের গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়া যায়। যদি এর দু’একটা শর্তও অপূর্ণ থাকে তাহলে সিস্টেম তার স্থিতিশীলতা হারাতে পারে। সাম্রাজ্য আসে, সাম্রাজ্য যায়। কোন কিছুই চিরন্তন নয়। প্রশ্ন হচ্ছে এই বিদায় কতটুকু বেদনাদায়ক হবে সেটা। তবে এই বিদায় মানে এই নয় সোভিয়েত ইউনিয়নের মত আমেরিকারও নাই হয়ে যাওয়া। নিজেদের রাজনীতির আমুল পরিবর্তন করেও পুরানোকে বিদায় দেওয়া যায়। সিনেটর স্যান্ডারসের সমর্থকরা সেটা করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

দুবনা, ০৭ জানুয়ারি ২০২১




                  


 

 

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি