আসা যাওয়ার পথের ধারে
কিছুদিন আগেও একটা অন্যতম স্লোগান ছিল ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। করোনা কালে বোঝা কষ্ট, পৃথিবী আসলে ছোট হচ্ছে না বড় হচ্ছে। একদিকে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সশরীরে দেখা করা যাচ্ছে না, এমনকি মাত্র দু ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত ছেলেমেয়েদের সাথেও দেখা হচ্ছে কালেভদ্রে দেশের কথা সেক্ষেত্রে আর কীই বা বলব। আবার এই করোনার জন্যই গণ মানুষের জন্য আবিষ্কৃত হয়েছে অনলাইন আড্ডা, সেমিনার, ক্লাস এসবের প্রযুক্তি। তাই সব মিলে আমরা দূরে যাচ্ছি না কাছে আসছি - সেটা বিরাট প্রশ্ন। তবে এটা ঠিক, যারা হাঁটা পায়ের দূরত্বে অবস্থান করছেন তাঁদের সাথে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। ইনস্টিটিউটের কলিগদের সাথে দেখা হয়না মাসের পর মাস। যাদের সাথে সরাসরি কোলাবরেশন আছে তাঁদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হয় টেলিফোনে বা ইমেইলে। তবে তাঁদের সংখ্যা তো হাতে গনা কয়েকজন মাত্র। এর বাইরেও অনেকেই আছেন যাদের সাথে অফিসে দেখা হয়, কথা হয় - তারাই চলে গেছেন দৃষ্টির আড়ালে। তাঁদের কোন খবরই পাওয়া যায় না।
আমি খুব মিশুক মানুষ নই। দেখা হলে প্রায় সবার সাথে হাই হ্যালো করা বা মাথা নাড়িয়ে অভিবাদন জানালেও হাতে গনা কয়েকজন লোকের সাথে মন খুলে কথাবার্তা বলি। তাঁদের সাথে কথা বলে আনন্দ পাই। আমার ল্যাবে এরকম লোক মাত্র দুজন। একজন ভিক্তর যে আমাকে নিউমেরিক্যাল এক্সপেরিমেন্টে সাহায্য করে আর একজন ভ্লাদিমির গেরদত। ভিক্তরের জন্ম ১৯৪৯ সাথে, ভ্লাদিমিরের ১৯৪৭ সালে। ভ্লাদিমির পদার্থবিদ্যায় পড়াশুনা করলেও তাঁর কাজ মূলত বিভিন্ন ফিজিক্যাল ও ম্যাথেম্যাটিক্যাল সমস্যার আল্গরিদম ডেভেলপ করার সাথে সম্পৃক্ত। আর এসব করতে গিয়ে তিনি কম্পিউটার আলজেব্রা আর কোয়ান্টাম কম্পিউটেশনের বিভিন্ন বিভাগে বিভিন্ন পাইওনীয়ার পেপার লিখেছেন। তিনি শুধু আমাদের ইন্সটিটিউটেই নয়, একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিশেষজ্ঞ।
ইন্সটিটিউটে আমাদের অফিস পাশাপাশি, তাই আমরা প্রায়ই ভুল করে একে অন্যের অফিসে ঢুকে যাই। আমি সাধারণত বেশ রাতে বাসায় ফিরি। উনি যদি কোন কারণে দেরী করে ফেলতেন, দরোজায় নক করে এসে বলতেন, "সাহা, কাজ তো অনেক হল। চল বাসায় ফিরি।" আমি খুব জরুরি কাজ না থাকলে বেরিয়ে পড়তাম। আমি সাইকেলে করে এলেও সেদিন হেঁটে যেতাম তাঁর পাশে পাশে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে বলতে। ওনার ছিল বহুমুখী আগ্রহ। প্রায়ই কসমোলজি নিয়ে প্রশ্ন করতেন, আমার সর্বশেষ কাজকর্ম নিয়ে জানতে চাইতেন। অনেক আগে একসময় আমি তাঁর গ্রুপে কাজ করার জন্য ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম। কারণ আমাদের ল্যাবেটরি ইনফরমেশন টেকনোলজির উপর আর আমি কাজা করি কসমোলজি নিয়ে। উনি নিজেই বললেন "সাহা, তুমি ডিএসসি করে আমার গ্রুপে আসবে কেন? তাহলে তো তোমাকে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। ল্যাবের থিমে না হলেও তুমি আমাদের ল্যাবের সবচেয়ে সক্রিয় গবেষকদের একজন। এটাই তোমার আসেট। তুমি কারও সাথে তেমন মেলামেশা কর না, কিন্তু কর্তৃপক্ষ তোমাকে পছন্দ করেন। কাজ করার ক্ষেত্রে তোমার যে ফ্রীডম আমাদের ল্যাবের খুব কম লোকেরই সেটা আছে। নিজের মত করে গবেষণা চালিয়ে যাও।" সত্যি বলতে এটা ছিল আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিজ্ঞানীরা তো আর ভিন গ্রহের মানুষ নই। অনেক প্রতিষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ যারা এখন বয়স্ক এবং মূলত অতীত কাজকর্মের জন্য নীতিনির্ধারণী বোর্ড মেম্বার, তাঁরা অনেকেই উড়ে এসে জুড়ে বসা লোকজনদের প্রতি একটু সন্দিহান থাকেন। তাঁরা এদের নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন। সেক্ষেত্রে ভ্লাদিমির ছিলেন ব্যতিক্রম। কারণ একটাই, তিনি সব সময়ই নতুন নতুন আইডিয়া দিতে পারতেন, অতীতের কাজ নয়, বর্তমানের কাজকর্ম দিয়েই নিজের জায়গা পোক্ত রাখতে পারতেন। ফলে তিনি অবলীলায় আমাদের মত অপেক্ষাকৃত তরুণদের উৎসাহ দিতেন। যেকোনো বয়সেই মানুষের দরকার এমন কাউকে যে উৎসাহ বা উদ্দীপনা দিতে পারে। এমনকি আমার পিতৃসম শিক্ষক ইউরি পেত্রভিচ নতুন কোন কাজ শেষ করে আমাকে জানান, মতামত জানতে চান। ভ্লাদিমির নিজেও নতুন কোন পেপার লিখলে আমাকে জানাতেন, যদিও আমি সেসব বিষয় থেকে অনেক দূরে।
করোনা কালে আমাদের তেমন দেখা হয়নি। মার্চ মাসে যখন আমরা অনলাইনে চলে যাই, আমি মস্কো থেকে ফিরে ইনস্টিটিউটে যাচ্ছি, উনি আর এডিক বাসায় ফিরছেন। তখন দুটো কথা হল। এরপর জুলাই মাসে আমার আমাদের সুযোগ দেওয়া হল অফিসে গিয়ে কাজ করার। আমরা দুজনে রেগুলার যেতাম। নভেম্বরের শেষ দিকে আবার একসাথে বাসায় ফিরি গল্প করতে করতে। তারপর ডিসেম্বরের প্রথমে আমার অনলাইনে চলে যাই। এরপর আর দেখা হয়নি। উনি আমাকে একটা ওষুধ দিতে চেয়েছিলেন। সেটা আবার দরকার হওয়ায় গত পরশু ভাবলাম ফোন করি। দেখি ওনার নম্বর আমার কাছে নেই। অযথা বিরক্ত করব না বলে ফার্মেসি থেকেই কিনে ফেললাম। আসলে ব্যাপারটা যতটা না ওষুধে তার চেয়ে বেশি ছিল এই উপলক্ষ্যে একটু কথা বলার ইচ্ছায়।
আজ সকালে কপিল শর্মা মেসেজ করল। কপিল ইন্ডিয়া থেকে। বছর দেড়েক ভ্লাদিমিরের সাথে কাজ করেছে। কপিল আসার আগেই ভ্লাদিমির ওর সম্পর্কে আমাকে বলেছে, বলেছে প্রয়োজনে আমি যেন সাহায্য করি প্রথম দিকে। তবে গত বছর দেশে চলে গেছে যদিও ভ্লাদিমির ওর কাজে খুব খুশি ছিলেন। আমি বলেছিলাম থাকতে। তবে করোনা কালীন সময়ে না থেকে ভালই করেছে। দেশে ওর ছোট বাচ্চা।
"প্রফেসর বিজন, শুনলাম ভ্লাদিমির মারা গেছে। আপনি কিছু জানেন?"
"আমি এখনও মেইল চেক করিনি। এডিককে ফোন করে দেখি ঘটনাটা আসলে কী?"
এডিককে ফোন করলে ও প্রথমেই আমার শরীর সম্পর্কে জানতে চাইল। আমি বলেছিলাম আমার মেডিক্যাল টেস্টের পরে ওকে জানাব, তবে নতুন বছরের শুরুতেই কাউকে বিরক্ত করতে চাইনি বলে জানানো হয়নি। গেরদের কথা জিজ্ঞেস করলাম।
"হ্যাঁ, আজ সকালে মারা গেছেন। ডিসেম্বর থেকেই করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছিল। সুস্থ্য হয়ে ২৮ ডিসেম্বর বাসায় ফেরে। দুদিন আগে আবার অক্সিজেনের সমস্যা। আজ সকালে মারা গেল। আমি তোমাকে নিজেই ফোন করে জানাব বলে ভাবছিলাম। আবার ভাবলাম তোমার শরীর এখন কেমন কে জানে।"
এডিক জানত আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা।
মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। যাদের কথা বলার অনেক মানুষ আছে তারা হয়তো এ অভাব ততটা অনুভব করবে না। কিন্তু আবার যখন অফিস খুলবে, আবার যখন তাঁর অফিসের সামনে দিয়ে যাব, দৃষ্টি বারবার ওদিকে যাবে আগে এমন যেত।
কত দূরদূরান্তের মানুষের অসুখ বিসুখের খবর অনায়াসে পাই আজকাল, আর একজন প্রিয় মানুষ, আমার প্রায় নিত্যদিনের সাথী, যার অফিস ছিল আমার পাশের রুমে, যিনি বাস করতেন আমার পাশের বিল্ডিঙে এভাবেই কিছু না জানিয়ে চলে গেলেন। চলে গেলেন বলা ঠিক হবে না। পেছনে থাকব আমরা তাঁর বন্ধু আর অনুরাগীরা, অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, তাঁর আড়াই শ'র বেশি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, আমাদের জন্য তাঁর শুভকামনা আর তাঁর সদা হাস্যময় মুখ।
Comments
Post a Comment