প্যাচাল


কয়েকদিন হলো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম। তবে যেহেতু ব্যাপারগুলো আপাতঃ দৃষ্টিতে ছন্নছাড়া, তাই ভাবলাম নামটা প্যাচাল হলে কেমন হয়। আবার প্রায় একই রকম শুনতে একটা রুশ শব্দ আছে "পেচাল" (печаль) যার অর্থ দুঃখ বা কষ্ট।  যেহেতু লেখাটা কিছু কষ্টের কথা, সব মিলিয়ে নামটা তাই প্যাচালই  থাক।

দুদিন আগে বন্ধু আহসান একটি পোস্ট দিয়েছে যেখানে দুটো গরু প্রচন্ড ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরেছে তার মালিককে। বাসায় কুকুর বিড়াল থাকায় ঘটনাটা আমার খুবই জানা, কিভাবে লেজ নাড়িয়ে, গায়ে মুখ ঘষে ওরা  ওদের ভালোবাসার কথা জানায়। আর আহসান তাতে লিখেছে

"শিশির ভেজা মেঠো পথে গরু খেয়ে যেত ঘাস, আজ আমাদের খুশীর ঈদ আর গরুর সর্বনাশ।"

গতকাল ঢাকার রক্তাক্ত ছবি দেখে নিজের অজান্তেই আহসানের দেয়া ছবির নিচে লিখলাম

"আজ আমাদের গরুর ঈদ আর খুশীর সর্বনাশ"

হ্যা, ঠিক তাই। জানি কোটি কোটি মানুষ এই ঈদের জন্য অপেক্ষা করে, ছেলে-বুড়ো সবাই দিন গুনে - কবে আসবে ঈদ। দোকানে দোকানে ঝলমলে আলো, রঙ-বেরঙের পোশাক পরে রাস্তায় নামে মানুষের ঢল, আবার এই আনন্দের মধ্যেই হাজার হাজার প্রাণীর রক্ত দেখে কেঁপে উঠে মানুষের মন, হঠাৎই ফানুশের মতো চুপসে যায় আনন্দে ভরা বুক। এখন থেকেই দীর্ঘশ্বাস বেরোয়  কলমের ডগা থেকে

"এক নদী রক্ত ঝরিয়ে
ঢাকার রাস্তায়
ঈদের আনন্দ আনলে যারা
তোমাদের এই কাজ
কোনোদিন ভোলা যাবে না
না না না ভোলা যাবে না"

আর এতে প্রিয় আলোময়দা মন্তব্য করে

"আমার শুধু স্বার্থপর পরিবেশবাদীদের কথা মনে হয়েছে। রামপাল, রূপপুরকে যারা না বলে, তারা কতোবড় হ্যা বলতে পারে। ওরা গোস্তে মজা লুটে, আন্দোলনেও।"

কথাটা অপ্রিয় হলেও সত্য। আমরা কথায় কথায় বলি ভোটের  রাজনীতি। ঢাকার রাস্তার ছবি দেখে অনেককেই দেখি মেয়রের উপর একহাত নিয়ে বক্তব্য রাখেন।  মেয়র নিসঃন্দেহে  দায়ী, কিন্তু কেউ কি বলেছেন, এসব ঘটিয়েছে মানুষ, সাধারণ মানুষ, শিক্ষিত মানুষ। না, পাছে মানুষ রেগে যায়, তাই এ ব্যাপারে জনগণকে কেউ কিছু বলেন নি।  অথচ ঈদ তো এক দিনের, আর মানুষকে হাঁটতে  চলতে হবে বার মাস। যদি আমরা এই পবিত্র দিনেও নিজেদের উঠোন, বাড়ির সামনের রাস্তা পরিষ্কার রাখতে না পারি, অন্য দিনগুলোতে কি করবো আমরা? তাই বৃষ্টি ভেজা রক্তে ধোয়া ঢাকার ছবি দেখে আমার বার বার মনে হয়েছে, এটা  কোরবানীর  পশুর রক্ত নয়, এটা  আমাদের গলে পঁচে যাওয়া সমাজের কুষ্ঠ রোগ, যা থেকে রক্ত পুঁজ বেরিয়ে একাকার করে দিচ্ছে বাংলার বুক, আর ছবির ওই গরুটার মতো দেশও করুন দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে  বলছে "এবার আমাকে রেহাই দাও।"   

এখানে পরিবেশ নিয়ে দুকথা বলাই যায়। কেননা রক্তে ভেসে যাওয়া শহর যদি পরিবেশ দূষণ না করে, তাহলে পরিবেশ দূষণ করবেটা কে? কিন্তু ঈদের সময় এমন ঘটবে জেনেও কাউকে, মানে পরিবেশ নিয়ে যারা সরগরম,  বলতে শুনিনি মানুষের কাছে আবেদন জানাতে কোরবানীর  সময় রাস্তায় বা বাড়ির আশেপাশে কোরবানী  না দিতে।  আমি নিজে সেই আশির দশক থেকেই গ্রীনপীচের কর্মকাণ্ড  অনুসরণ করতাম। পরে এক সময় দেখেছি এটাও পশ্চিমাদের এক রাজনৈতিক হাতিয়ার, যেমনটা WADA. এই ডোপিং নিয়ে এতো হৈচৈ, রাশিয়ার  অনেককেই অলিম্পিকে অংশগ্রহণ  করতে দেয়া হলো না, প্যারাঅলিম্পিক দলটা নিষিদ্ধ করা হলো, আজ দেখা গেলো আমেরিকার নামকরা ও বিজয়ী প্রচুর খেলোয়াড় রেগুলার ডোপিং ব্যবহার করতো, আর করতো তারা WADA র লিখিত অনুমতি সাপেক্ষেই। এসব আবারো প্রমান করে এসব সংগঠনগুলো আসলে পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষাতেই ব্যস্ত। আমেরিকা আর তার রাজনীতিবিদরা স্বার্থ ছাড়া কিছু করে না। আল গোরও ব্যতিক্রম নয়। পরিবেশ আন্দোলন, পরিবেশ সচেতনতা নিঃসন্দেহে ভালো, তবে সেটা যাতে কারো হাতের কলকাঠিতে পরিণত না হয় সে বিষয়টা ভেবে দেখা জরুরী। যে সমাজে মানুষ নির্দ্বিধায় রাস্তা ঘাটে  প্রস্রাব করে, থুথু ফেলে, সেখানে মানুষকে হাইজেন বিষয়ে শিক্ষা না দিয়ে রামপালের বিরুদ্ধে আন্দোলন তাই যতটা না পরিবেশ সংক্রান্ত তার চেয়ে বেশী  রাজনৈতিক। এভাবে হয় না, যে কোন কাজে সফল হতে হলে সেটা করতে হয় নিরলস ভাবে সব ক্ষেত্রে, শুধু মাত্র সিলেকটিভ ইস্যু নিয়ে কাজ করলে সেটা উদ্যোক্তাদের সততা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য।

অনেক দিন দেশের বাইরে থাকায় ঈদ বা পূজা আর দেখা হয় না।  তবে এসব সম্পর্কে স্মৃতিতে যা আছে, তা সত্যি মধুর।  ছোট বেলায় ঈদের দিন সারা দিন মার্বেল আর ড্যাংগুলি খেলা, পূজায় মণ্ডপে মণ্ডপে গিয়ে প্রতিমা দেখা।  তখন মনেই হয়নি কোন প্রতিমা বেশি সুন্দর, কোনটা কম? আসলে মা (আমরা বলতাম দূর্গা মা, লক্ষ্মী মা, স্বরস্বতী মা) যে অসুন্দর হতে পারে, এমনটা কখনো মাথায় আসতো না।  ইদানিং দেখি সবাই প্রতিমার সৌন্দর্য্য নিয়ে ব্যস্ত। একই রকম কোরবানীর গরুটা কত দামি বা কত নাদুস-নুদুস। পালন করবো  আমরা হিন্দু বা ইসলাম ধর্ম, আর ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে পরিণত করবো আমেরিকান ফ্যাশন-শোতে  এটা কেমনে হয়? পোশাকে-আশাকে আমরা হতে চাচ্ছি আরব, আর জৌলুসে আমেরিকান - এতো দেখছি দুমুখো সাপের মতো - একই সঙ্গে আমরা যেতে চাইছি দুই ভিন্ন সমাজে, ভিন্ন সময়ে।  এভাবে চললে আমরা না হব  আমেরিকান, না হব আরব, মাঝখান থেকে বাংগালীত্ব হারাবো। কষ্ট হবে না তখন?          

দুবনা, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ 






(মনিকার ছোট বেলায় আঁকা  একটা ছবি)

Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি