মরলে কাজে দেবে
- কিরে কি খবর? ভালো আছিস?
অনেক দিন পরে দেখা হওয়া এক বন্ধুর সাদা দাঁতের পাটি ভেদ করে বেড়িয়ে এলো প্রশ্নটা।
- ভালো থাকার কি কোনো বিকল্প আছে? যতই বলিস, খারাপ থেকে তোদের মাগনা আনন্দ দিতে আমি অন্ততঃ রাজি নই।
হেসে বললাম আমি।
অনেক দিন পর দেখা। কথায় কথায় অনেক কথাই হলো, কত মানুষের যে হাড্ডি-মাংস ধুয়ে মুছে বিভিন্ন সেলফে রাখা হলো, তার শেষ নেই।
- তুই তো আমাদের ব্যাচে সবচেয়ে না হলেও সবচেয়ে ট্যালেন্টেড যারা তাদের একজন ছিলি। ভেবে পাইনা, তুই সাইন করতে পারলি না কেন?
- আমি তো বরাবরই একটু কালো। জানিস না কালো বস্তু সাইন করে না? ওহ, ভুলেই গেছিলাম, তুই ফিজিক্স পড়িস নি।
- আবার ঠাট্টা। তুই তোর এই চাকরীতে কত দিন আছিস?
- ১৯৯৪ থেকে, পি এইচ ডি থিসিস ডিফেন্ড করেই জয়েন করেছি। কেন?
- আমি এই সময়ে অনেক গুলো চাকরী বদলিয়েছি। কোনো ভালো অফার পেলেই চলে যাই।
- ভালো অফার মানে?
- ভালো বেতন।
- তাই বল। আমি তো কাজ খুঁজি, মনের মতো কাজ। আর তুই খুঁজিস বেতন। শুধু তুই কেন? নিজের ছেলেমেয়েদের দেখি কাজটা মনের মতো হবে কিনা, মানসিক প্ৰশান্তি দেবে কিনা না দেখে খুঁজে কোথায় বেতন বেশী।
- কেন তুই বেতন খুঁজিস না?
- দেখ, কাজ - এটা জীবন, জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ন একটা সময়। তা কাজ করে যদি আনন্দ না পাই, বেতন দিয়ে কি হবে?
- তা তোর চলে যে বেতন পাস্?
- আমি এ ব্যাপারে উত্তরটা অন্য ভাবে দেই। আমার তো অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। তাই রাশিয়ান বন্ধুরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে ঐ বেতনে চলে কিভাবে। আমি বলি, যে বেতন, তাতে আমি দড়ি কিনলে আর সাবানের পয়সা থাকে না, আর সাবান কিনলে দড়ি কেনা যায়না, তাই আর যাই হোক গলায় দড়ি দেয়া আর হয়ে ওঠে না। এই দেখনা দিব্যি বেঁচে আছি। ওভার ওয়েটের ঝামেলা নেই। তোকে আর কি বলবো নতুন করে। চাল আনতে নুন ফুরায়। জানিসই তো, নুনটা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার করা যায়।
- তা যা বলেছিস। তার মানে তোর হলো এক ডলারের সমস্যা। আমার তো মিলিয়ন ডলারের সমস্যা।
- কেন? কি হলো আবার?
- বলিস না। ছেলেমেয়েকে অনেক আগেই ফ্ল্যাট তৈরী করে দিয়েছি। তা এখন ছেলে শহরের অন্য প্রান্তে চাকরী নিয়েছে, বলছে ওখানে একটা ফ্ল্যাট কিনে দিতে। এটা তো কয়েক লক্ষ ডলারের ব্যাপার। সেদিক দিয়ে তুই কিন্তু ভালোই আছিস।
- আমি কিন্তু খারাপ আছি বলে অভিযোগ করিনি। কথায় বলে না ছোটলোকের (গরীবের) ছোট সমস্যা, বড়োলোকের বড়। (রাশানে বলে ছোট বাচ্চাদের ছোট সমস্যা, বড় বাচ্চাদের বড়)। বড়লোক কিন্তু তুই স্বেচ্ছায়ই হয়েছিস, এখন আর মন খারাপ করে লাভ কি?
- তোর কি গাড়ী?
- বললাম না, আমার অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। তাই রেলগাড়ী কেনার শখ ছিল, দেখা গেলো, ওটা কিনলে রেল লাইনও কিনতে হবে, তাই আর গাড়ী কেনা হয়নি।
- সে কি কথা? চলিস কেমনে?
- বাবামায়ের দেয়া পায়ে হেঁটে। তেলের পয়সা লাগে না, লাইসেন্স লাগে না, ট্যাক্স দিতে হয় না। সব চেয়ে বড় কথা, সব সময় সাথে রাখা যায়, পার্কিং এর ঝামেলা নেই। তাছাড়া শরীরের জন্য ভালো। তোরা ডাক্তাররাই তো বলিস।
- তুই একেবারেই গন কেস। তা ধর্ম কর্ম করিস?
- কর্ম করি। ভালোই কর্মী করি। কথায় আছে কর্মই ধর্ম। ওটা যদি ঠিক হয়, বলতে প্যারিস, ধর্মও করি।
- না, আমি বলছিলাম, পূজা-পার্বন, নামাজ-রোজা।
- ওসব করতে গেলে ধর্মটাই করা হবে, কর্ম আর করা হয়ে উঠবে না। এখানেও আমার সেই দড়ি আর সাবানের অবস্থা।
- ধর্মকর্মে মন দে, দেখবি নুন আর ধার করতে হবে না, গাড়িও কিনতে পারবি।
- দরকার আছে কি?
- গাড়ির দরকার নেই?
- দেখ, তোর ওটা খুব দরকার। মরে গেলে স্বর্গে যাবি, ওখানে কি আর গাড়ী ছাড়া যাওয়া যাও? আমিতো আর ওদিকে যাবো না। হেঁটে হেঁটে নরকে গেলে অনেক সময় নিয়ে যেতে পারবো। পথে কত তারা, কত গ্রহ-নক্ষত্র পরবে, ওদের সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটবে আর হাঁটবো। আর এক সময় নরকের প্রহরী বিরক্ত হয়ে দরজাটা ঠিক বন্ধ করে দেবে। নারে, আমার গাড়ির দরকার নেই।
- তা তুই নরকে যাবি কে বললো? তুই তো খারাপ কিছু করিস না।
- জানি। তবে তোদের ঈশ্বর যদি সেই সব শিক্ষকের মতো হয়, যারা ক্লাসের হাজিরা দেখে মার্ক দেয়, তাহলে আমার আশা নেই। আর যদি উনি আমাদের ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের মতো হন, যারা হাজিরা দেখেন না, দেখেন ছাত্র কতটা জানে, তাহলে সম্ভাবনা একটা থেকেই যায়। তবে কি জানিস? তুইতো ওখানে যাবিই, আমিও যদি যাই - তোর স্বর্গবাস নরকযন্ত্রণার চেয়েও কঠিন হয়ে উঠবে। আমি বরং না ই গেলাম। স্বর্গের দ্বার থেকে নরকের দ্বার পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াবো তারাদের সাথে কথা বলতে বলতে আর এখন যেটা পারিনি, তখন আরো কাছে থেকে দেখে মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য জানতে চেষ্টা করব। আর তুই এক কাজ করিস। আমরা যখন দেশে ছিলাম, বাংলাদেশ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে গরীব দেশ। তুই ছিলি পৃথিবীর সবচেয়ে গরীব দেশের নাগরিক। এখন তুই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশের নাগরিক। সবই তো হলি। এবার একটু মানুষ হবার চেষ্টা করিস। মরলে কাজে দেবে।
মনিকার ছোটবেলার আঁকা ছবিটা
দুবনা, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬
Comments
Post a Comment