পূজার বিষন্নতা

জানালার বাইরে রোদ হাসছে। শরতের মেঘলা আকাশ ভেদ করে সূর্য আজকাল তেমন আর বেড়াতে আসতে পারে না আমাদের পাড়ায়। তবুও যখন রোদ উঠে আর সূর্যকে স্বাগত জানায় লাল-হলদে পূজার পোষাকে স্বজ্জিত প্রকৃতি, মনটা ভরে যায়। মনে হয়, শারদীয়া উৎসবটা বঙ্গ দেশে না হয়ে এই রঙে রঙে রঞ্জিত মস্কোয় হলেই বেশ হতো। 

অনেক আগে, যখন ছোট ছিলাম, সারা বছর অপেক্ষা করতাম পূজার দিনগুলোর জন্য। ছোট ছিলাম বলেই হয়তো করতাম। বিশ্বাস করতাম নির্মল আনন্দকে। বড় হলে মানুষ যখন প্রশ্ন করতে শেখে, প্রশ্নাতীত বিশ্বাসগুলো যখন একটু একটু করে ভাঙতে শুরু করে, তখন আনন্দের নির্মলতায় খাঁদ পরে।  

আমার ছোট বেলায় আমাদের বাড়ীতে দূর্গা পূজা হতো। ওটা হতো বাড়ী থেকে একটু দূরে বড় খালের অন্য দিকে রামার ভিটায়।  রাম  বসাক অনেক আগেই ভারত চলে গেছিলো, তার কাছ থেকে বাড়ীটা  বাবা কিনে রেখেছিলো, তবে ওটা কখনোই আমাদের বাড়ী হতে পারে নি, রামার ভিটাই  রয়ে গেছিলো। দক্ষিণের চক দিয়ে বড় খালে যখন জল আসতো, বুঝতাম পূজা আসন্ন। বদু ভাই, নালু ভাই সবাই লেগে যেত খালের উপর কাঠের সাঁকো মেরামতে। তারপর একদিন নিয়ে আসতো আঠা মাটি, শন, কুচি কুচি করে কাটতো পাট। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কুমোর এক দিকে শন্ দিয়ে তৈরী করতো প্রতিমার কাঠামো আর বলতো কিভাবে মাটি আর পাট মিশিয়ে তৈরী করতে হবে দেবতাদের মাংস। এর মধ্যেই সালাম ভাই অন্যদের নিয়ে লেগে পড়তো  কাঠাম তৈরীর কাজে। আমরা ছোটরা ঘুরতাম আশেপাশে, কখনো মাটি দিয়ে খেলতাম। এক সময় শুরু হতো রং করার কাজ আর সব শেষে চোখ ফুটানো হতো। এর পর থেকে আমাদের আর ঢুকতে দেয়া হতো না মণ্ডপে, পুরোহিত নিজেই ভার নিতেন ঠাকুরের দেখাশুনার।

শৈশব পেরিয়ে যখন কৈশোর এলো দেবতা হারালেন তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতা। ততদিনে বুঝে গেছি নিজে পড়াশুনা না করলে সারা জীবন স্বরস্বতী মায়ের পায়ে ধন্না দিলেও পাশ করা যাবে না।  তারপর এইসব দেশীয় ঠাকুর দেবতাকে পাশে ঠেলে মার্ক্স্ আর লেনিন শুনালেন বিপ্লবের বাণী, পূজার মণ্ডপে যাওয়া তখন হয়ে উঠলো পশ্চাৎপদতার প্রতীক। দেশের শেষ দিনগুলো কাটলো ছাত্র ইউনিয়ন, খেলাঘর, উদীচী করে।  ঠাকুর দেবতারা নিজেরাই চলে গেলেন অপেক্ষা করতে করতে ধৈর্য হারিয়ে।  এরপর শুরু হলো নতুন জীবন - নতুন দেশে। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৮ পর্য্যন্ত পূজার কথা মনেই ছিল না।  ১৯৮৯ এ যখন দেশে গেলাম অনেক দিনের জন্য, মায়ের পীড়াপীড়িতে ঘুরলাম মণ্ডপে, মণ্ডপে - মূলতঃ  ছবি তুলার জন্য। ১৯৮৯ সল্ থেকেই শুরু হলো মস্কোয় দূর্গা পূজা, আবার শুরু হলো অপেক্ষার পালা, যতটা না পূজার জন্য, তার চেয়েও বেশি এই উপলক্ষে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের দেখা পাবার জন্য।

ইদানিং অবশ্য পূজার দিনগুলোর অপেক্ষা করতে গিয়ে শুধু যে খুশির অপেক্ষা করি, তাই নয়, অপেক্ষা করি দুঃসংবাদের। খবরের কাগজ ভরে থাকে গ্রামে গঞ্জে মূর্তি ভাঙার সংবাদ। ধর্ম নিয়ে মাথা ব্যাথা না থাকলেও এটা আমাকে ব্যথিত করে। ভাঙা মন্দির বা মসজিদ বা গির্জা দেখে ভাবি সর্ব শক্তিমান ঈশ্বর তার ভক্তদের অন্ধ বিশ্বাসের ধাক্কায় এতই দুর্বল হয়ে পড়েছেন যে নিজেকেও ভক্তদের রোষানল থেকে রক্ষা করতে পারছে না। এই প্রতিটি ভাঙ্গা প্রতিমা, প্রতিটি ভাঙ্গা মন্দির বা মসজিদ বা গির্জা ছোট বেলায় পড়া ঈশ্বরের মাহাত্বের ভিত  ভেঙে দেয়।
ধর্ম বইয়ে লেখা ছিল, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু আজ যখন ভগবান, আল্লাহ আর গডকে নিয়ে এতো হানাহানি, তখন কি মনে হয়না এগুলো শুধু  ঈশ্বরের বিভিন্ন নামই  নয়, বিভিন্ন স্বত্বাও।

১৯৮৩ সালে যখন সোভিয়েত  ইউনিয়নে আসি, দিকে দিকে লেনিনের মূর্তি দেখে আমার মনে হয়েছে শিবলিঙ্গের কথা। তীর্থ স্থানগুলোতে সারি সারি শিবলিঙ্গ থাকতো - মাকে  বলতাম, তুমি যদি সবার মাথায় এক ফোঁটা  করে দুধও ঢাল, কয়েক লিটার লেগে যাবে। সোভিয়েত দেশ থেকে তখন ঈশ্বর নির্বাসিত ছিলেন। কিন্তু লেনিনের মূর্তি দেখে আমার মনে হতো, এটাও তো এক ধরণের পূজা। আশির দশকে, যখন ছাত্র ছিলাম, আমার রুমমেট ছিল ইয়েভগেনি। ও একদিন বলেছিলো, "যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতাম, লেনিনই হতো আমার ঈশ্বর।" আমার মনে হয় শুধু ইয়েভগেনি নয়, সোভিয়েত দেশের অনেক মানুষই এমনটা ভাবতো।

প্রায় চৌদ্দ বছর পর ২০১১ সালে যখন দেশে বেড়াতে যাই, অবাক হয়েছিলাম প্রতিটি আনাচে-কানাচে শেখ মুজিব - শেখ হাসিনা, জিয়াউর রহমান - খালেদা জিয়া ছবি সম্বলিত পোষ্টার দেখে। তখন আমার মনে হত  ইয়েভগেনির কথা আর ভাবতাম, আচ্ছা এরাতো ঈশ্বর বিশ্বাস করে, ইয়েভগেনির মতো এরাও কি নিজেদের নেতাদের ঈশ্বরের মতোই শক্তিশালী মনে করে? এটাও কি এক ধরণের পূজা নয়? কে জানে, হয়তো এমন এক দিন আসবে, যখন শুধু ছবি নয়, লেনিনের মতোই এদের মূর্তিতে ছেয়ে যাবে দেশ? কে যেন তো বলেইছিলো, খালেদা জিয়া নাকি দুর্গার  মতো। তাই কোনো এক দিন যদি এইসব মানুষ তাদের নেত্রীদের আদলে প্রতিমা তৈরী করে, অবাক হবার কিছুই থাকবে না।  যে মানুষ প্রশ্ন করতে জানে না, ভালো-মন্দ বিচার করতে জানে না, জানে শুধু অন্ধভাবে নিজেকে সমর্পন করতে - তাদের পক্ষে সবই সম্ভব। 

দুবনা, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬      


  

Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি