ঐশ্বরিক ঝামেলা

অনেকদিন আগে, তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, চতুর্থ বা পঞ্চম বর্ষে, ঠিক মনে নেই। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটা প্রব্লেম নিয়ে কাজ করছিলাম। অনেক দিনের চেষ্টাতেও যখন সমাধানটা ঠিক বের করতে পারছিলাম না, আমার সুপারভাইজার ইউরি পেত্রোভিচকে বললাম

 -আমি ওখানে একটা টার্ম অ্যাড করতে চাই।

উনি বললেন, "তুমি ভগবান, যা খুশি তাই যোগ করতে পার।"

কথাটা অবশ্য আক্ষরিক অর্থে বলা নয়।  আমরা যখন গাণিতিক মডেল তৈরী করি, আমরা নিজেরাই তার সৃষ্টিকর্তা। ওই অর্থে সৃষ্টিকর্তা হওয়া  সহজ, কঠিন হচ্ছে ওই সৃষ্টিকে অন্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। 

দুবনায় আমার সাথে ভিক্টর  নাম এক লোক কাজ করে, ও গণিতের লোক, প্রোগ্রাম খুব ভালো করে। একসাথে কাজ করছি দশ বছরেরও বেশী,  কিন্তু এখনো পর্যন্ত একে অন্যকে বুঝে উঠতে পারি না। ওর জন্য সমীকরণই মূল, আমার জন্য আশেপাশের অনেক কিছুই। মানে ফিজিক্যাল কন্ডিশন। সেভাকে আগে যদি জিজ্ঞেস করতাম, মস্কো থেকে দুবনার দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার। মস্কো থেকে একটা গাড়ি চলছে ৮০ কিলোমিটার বেগে, দুবনা থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে - কখন ওরা মিলিত হবে। সেভা বলে দিতো এক ঘন্টা পরে। আমি বলতাম, এটা আংশিক সত্য - যদিও এটার সম্ভাবনা ৯৯.৯৯%. কেননা আমি বলিনি গাড়িগুলো কোন দিকে যাচ্ছে, মানে এক অর্থে প্রশ্নটা সঠিক নয়।  সেদিক থেকে দেখলে আরো তিনটে সম্ভাবনা থেকেই যায়।  যেমন যদি দুজন দুদিকে চলে যায় বা একজন অন্য জনের পেছনে ছুটে।  তবে পৃথিবী যেহেতু গোলাকার, একসময় তাদের দেখা ঠিকই হবে।  কিন্তু যেহেতু দেখা করতে গেলে মানুষ পরস্পরের দিকে এগিয়ে আসে, মনে মনে ধরেই নেই যে অংকের শর্তটা এমনটাই হবে। তবে ভালো, যদি শর্তগুলো আগে থেকেই দেয়া হয়, আর শর্তগুলো দিতে হয় বাস্তবিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে। একই ঘটনা গবেষণার ক্ষেত্রে। তাই  পদার্থবিদরা অনেক সময়ই আগেভাগেই কিছু শর্ত  আরোপ করে দেন, যেটা ভিক্টরের পছন্দ না, তাই শুরু হয় বিতর্ক।  তখন আমি ওকে বলে, "জানো, ইউরি পেত্রোভিচ কি বলেছেন? আমার গবেষণার জগতে আমি ঈশ্বর, তাই যা খুশি তাই করবো।"

তবে সব সময় যে এই কাজটা ভালো লাগে তা নয়। মাঝে মধ্যে যখন রাতে গুলিয়া ফোন করে বলে, মনিকা বা ক্রিস্টিনা বা সেভা  বাসায় ফেরেনি, ফোনও  ধরছে না, ভাবি, আচ্ছা, ওরা মস্কো আর আমি দুবনায় - আমাকে এটা বলে বিরক্ত করার মানে কি? গুলিয়ার ধারণা ছেলেমেয়েরা ইচ্ছে করে ওর ফোন ধরে না, তাই আমি যেন চেষ্টা করি।  হতেও পারে।  মায়ের ফোন ধরলে শুরু হবে কেন এখনো বাসায় ফেরেনি এই নিয়ে এক পশলা বকা, আর আমি ফোন করে জিজ্ঞেস করি "কেমন আছিস? বাড়িতে?" যেন বা আমি জানিই  না যে ওরা  বাসায় নেই। অনেক সময় ওদের ফোন বন্ধ থাকে।  একটু টেনশন হয়, তবে সেটা গুলিয়ার পরবর্তী কলে  কি উত্তর দেব সেই কথা ভেবে।  তখন মনে হয় বেচারা ঈশ্বরের কথা।  সারা দিন কোটি কোটি মানুষ তার কাছে কত অভিযোগ করে যাচ্ছে, এটা দাও, ওটা দাও, ওকে  ভালো রেখো, ওর অসুখ বানিয়ে দিও - হাজারো সব বায়না। আমার মনে হয় গুলিয়া শুধু নিজের ঘাড় থেকে দুঃশ্চিন্তাগুলো  আমার ঘাড়ে তুলে দেবার জন্য আমাকে ফোন করে বাচ্চাদের কথা বলে, যেমনটি আমরা আমাদের সম্যস্যা ভগবানের ঘাড়ে চাপিয়ে হাতপা গুটিয়ে বসে থাকি। আমার একটা ফোন কলেই এতো বিবৃত অবস্থা।  কোটি মানুষের প্রার্থনায় ভগবানের নিশ্চয়ই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। 

দুবনা, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬  


Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি