অনু পরমাণু

হঠাৎই ফোনটা বেঁজে  উঠলো।
"নমস্কার দাদা।"
আমি এতো দিনেও এই দুটো শব্দের সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি। দেশে আমরা সব সময়ই "কি খবর? কেমন আছেন?" এ ভাবেই কথা শুরু করতাম।  সোভিয়েত  দেশে আসার পর "Привет! Здравствуйте!" এসব শব্দই ব্যবহার করি।  নমস্কারটা এখনও ঠিক রপ্ত  করতে পারিনি। আর ছাত্রজীবনে সবাই, মানে জুনিয়ররা বিজনদা বলেই ডাকতো। দাদাটা বেশ গুরুগম্ভীর, আমাকে ঠিক মানায় না।  তবে বেশ কয়েক বছর হলো অনেকেই দাদা বলেই ডাকে, বুড়ো হয়ে যাচ্ছি মনে হয়। এ ছাড়াও আরেকটা কারণ আছে। বাড়িতেও আমরা তপনদা, শ্যামলদা, এভাবেই ডাকতাম।  ব্যতিক্রম ছিল বড়দা।  তবে দিদি পর্যন্ত এসে ওটাও থমকে দাঁড়ায়।  দিদির পরে কল্যাণ, রতন দুজনেই দিদিকে দিদি না ডেকে ঐ  বলে ডাকতো। আমি ছিলাম আরেক কাঠি সরেস। দিদিকে দিদি বলে ডাকতাম, আর দিদি আমাকে ভাই বলে ডাকতো। ওর পরে যারা ছিল, মানে কল্যাণ, রতন আর চন্দনা (আমার কাকাতো বোন) - ওদের আমি বিদেশী স্টাইলে নাম ধরে ডাকতাম।  বাবা-মা আমার এই বিদ্রোহ মেনে নিলেও আত্মীয়-স্বজন আর পাড়াপড়শীরা  এটাকে বেয়াদপী বলেই মনে করতো। তবে আমার ভুবনে আমিই ছিলাম মন্ত্রী আর রাজা, সেপাই আর প্রজা - তাই ওসব আমাকে কোনো দিনই নড়ায়নি। তবে এটা  নিশ্চয়ই কল্যাণ, রতন আর চন্দনার গাঁয়ে  লাগতো।  তাই ওরা  উল্টো আমাকে দাদা ডাকতে শুরু করলো।  আমি আবারো বিদ্রোহ করলাম। ওরা দাদা ডাকলেই দা, কাঁচি, চাকু, লাঠি যা আছে হাতের কাছে, তাই নিয়ে ওদের তাড়া করতাম। কিছুক্ষন পরে তিন দিক থেকে দাদা ডাক আসতো  কানে, আর আমি এই ডাইনে তো এই বাঁয়ে দৌড়াতাম। শেষ পর্যন্ত মা আসতো  আমার উদ্ধারে, ওদের বকে দাদা ডাকা থেকে বিরত করতো। এই দাদাকাহিনী বলে শেষ করা যাবে না, তাই ফিরে আসি টেলিফোনে।       
"কি খবর? ভালো আছেন?"
কিছুক্ষন কথা বলার পর আসল খবরে চলে এলাম।
"আগামীকাল একটা অনুষ্ঠানে দাওয়াত আছে।  কি বলেন, যাবো কি?"
"কেন যাবেন না। এই অনুষ্ঠানে না যাওয়া ভালো দেখাবে না।"
"তা ঠিক।  তবে যারা আয়োজন করছে, ওরা কয়েক দিন আগে দলছুট হয়ে নতুন দল করেছে। তাই ভাবছি।"
"আচ্ছা ওরাতো কয়েক দিন আগেও এক সাথে ছিল।  ওদের বন্ধুত্ব বা শত্রুতায় আমাদের হাত নেই।  আমাদের সব অনুষ্ঠানে ওরা আসে, বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে, এখন না গেলে কেমন হয়? তাছাড়া না গেলে তো সব জায়গায়ই যাওয়া বাদ দিতে হয়। এটা কি ঠিক হবে? আমার তো মনে হয়, আদর্শগত দ্বন্দ্ব না থাকলে আমাদের সবার ওখানেই যাওয়া উচিৎ।"

এ এক বিশাল বিড়ম্বনা।  মানুষ দল গড়ে, দল ভাঙে, আর তাদের এই ভাঙা গড়ার, মান অভিমানের ভুক্তভোগী হয় সাধারণ মানুষ। ভাবি, এইতো আমরা যখন সোভিয়েত  ইউনিয়নে এলাম, কত জনের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে, এদের মধ্যে সংসার গড়ে উঠেছে, ভেঙেছেও কিছু কিছু।  ওরা যদি বলতো, আমাদের সাথে সাথে তোমাদেরও  বন্ধুত্বের ডিভোর্স দিতে হবে - কোথায় যেত এই সব বন্ধুত্ব? কে জানে, রাজনীতি রাজাদের ব্যাপার, আমাদের মতো আম জনতা এসব বুঝবে কিভাবে?

এসব ভাবতে ভাবতেই মনে পড়লো অনু-পরমাণুর কথা। না না, ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। এখানে আমি আনবিক বা পারমাণবিক পদার্থবিদ্যা নিয়ে বলবো না।  কয়েকদিন আগে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বাম  দলগুলো ভেঙে অণু-পরমাণুতে পরিণত হয়েছে, কথাটা এ প্রসঙ্গেই। 

পদার্থবিদ্যার জগতে এই অনু-পরমাণু শক্তির এক অনন্য উৎস। তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে সেটা ঠিক বলা যাবে না। তবুও তাদেরও  গুরুত্ব আছে নিঃসন্দেহে।  এই ধরুন বাংলাদেশে রাজনীতি সচেতন মানুষের মধ্যে বাম চিন্তার লোক সর্বসাকুল্যে ১%। সংখ্যাটা খুব কম না হলেও ভোটে জেতার জন্য বা নিজেদের প্রতিনিধিত্বশীল ভাবার জন্য তেমন বেশি নয়। তবে এই ১% লোক যদি একটার বদলে ১০০ টা দল গঠন করে, তা হোকনা  দুই বা তিন সদস্যের দল,  তাতে বাংলাদেশে সর্বমোট দলের ভেতরে এদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০%। তাই এক হিসেবে যা নগন্য, অন্য হিসেবে সেটা এক বিশাল সংখ্যা, আসল কথা কে কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হিসেবটা করছে। তাছাড়া বামদের ক্ষেত্রে কথাটা অনেকটাই খাটে, কেননা ওদের শুধু কর্মীই আছে, সমর্থক নেই। তবে এই ভাঙাভাঙিরও রকম ভেদ আছে, সেটাই এখানে বলবো।

  এই যে ভাগাভাগি বাম দলগুলোর মধ্যে সেটা কিন্তু প্রধানতঃ আদর্শগত কারণে। কেউ মার্ক্সবাদী, কেউ লেনিনবাদী, কেউবা মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী। চীন পন্থীও কম নয়। তবে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের চেয়ে আদর্শগত মতভেদই এর মূল কারণ। বাংলাদেশে যে বড় বড় দলগুলো ভাঙে  নি, তা কিন্তু নয়। ১৯৭৫ এর পর মালেক উকিল আর মিজানুর রহমান দুটো আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব দেন। বিএনপি, জাতীয়দল - এরাও ভেঙেছে, তবে মূলতঃ  নেতৃত্ব প্রশ্নে। তবে এসব দলের ভেতর আরেকটি ধারা দেখা যায় - সেটা হলো দলের আদর্শ ও নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ঘোষণা করে স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন গ্রূপ করা।  এতে দল যতটা না সমস্যায় পরে, তার চেয়ে বেশি সমস্যায় পরে সমর্থক বা অন্য সংগঠনের মানুষ।  এইতো কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কোনো কোনো দল থেকে একাধিক প্যানেল ছিল। আর এই গ্রূপগুলো নিরীহ ভোটারদের বিশেষ করে সংখ্যালঘু ভোটারদের নানা ভাবে নাজেহাল করেছে।

টেলিফোনে যে আলাপটা হচ্ছিলো, এটা ওই পর্যায়েই পরে। একটা সময় ছিল, যখন বিএনপির বিভিন্ন গ্রূপ ছিল। আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ এদেরও একাধিক কিমিটি আছে। কিন্তু এরা কেউই আদর্শগত মতভেদের কথা বলে না। এরা সবাই বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনার অনুগত সৈনিক, আওয়ামীলীগের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রে তাদের বিশ্বাস প্রশ্নাতীত। তার পরেও এই দলাদলি যার মূল কারণ স্থানীয় পর্যায়ে শক্তিশালী নেতার অভাব।  আর যখনই একাধিক সমপর্যায়ের নেতা থাকে, তখন সবাই চায় একমাত্র আসনে নিজেই বসতে। যেহেতু আদর্শগত বিরোধ নেই, এক সময়ে তারা আবার এক হয়ে যায়, আর মাঝখান থেকে আমরা যারা এই সব পার্টির বাইরে তারা বিভিন্ন দলের টানাটানিতে পড়ে যাই। আর এই কারণেই অনুষ্ঠানে যাওয়া উচিৎ কি উচিৎ নয়, এ নিয়ে প্রশ্ন আসে। আমি নিজে জিনিষটা এ ভাবে দেখি না। মনে আছে, আমরা যখন বাংলাদেশ প্রবাসী পরিষদ রাশিয়া গঠন করার সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাকে বলা হলো দূতাবাসে ঘটনাটা জানাতে। রাষ্ট্রদূত আর মিনিস্টার এদেশে পড়াশুনা করেছেন, তাই আমার যাওয়া। 
ওনাদের কথাটা জানাতেই বললেন, "তা তোমরা সংগঠন করবে, তা এই লোকগুলো সেটা করতে দেবে?"

"আমরা তো কারো কাছে অনুমতি চাইতে যাবো না।  আমরা কিছু লোজন মনে করি, মস্কোয় এরকম একটা সংগঠন থাকা দরকার, যেখানে অল্প আয়ের মানুষ আসতে  পারবে, নিজেদের সামর্থ্য মতো নিজেরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান করবে। আমরাতো কারো বিরুদ্ধে নই, বরং সবাইকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত।  শর্ত একটাই, তাদের স্বাধীনতার পক্ষের, একাত্তরের পক্ষের লোক হতে হবে। গঠনতন্ত্র থাকবে, ঘোষণাপত্র থাকবে, যারা ওটা মেনে চলতে চায়, আমাদের সাথে আসবে, যেসব সংগঠন আমাদের আদর্শের সাথে একমত, আমরা তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চলবো।"

আমি তাই কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন করলে বলি, আমরা ওদের স্বীকৃতি দেবার কে? ওরা সংগঠন করবেই, তা আমরা গেলেও, না গেলেও।  তাই সম্ভব মত সব জায়গায়ই যাওয়া দরকার।  দেশে আওয়ামীলীগ বিএনপির ঝগড়ায় আমরা অতিষ্ট, এখানে দেখছি আওয়ামীলীগ-আওয়ামীলীগের বা বিএনপি-বিএনপির কাইজ্যায় নাভিশ্বাস উঠবে। তবে তার দুদিন পরে দেখা গেলো ওই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আমাদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কথা উঠেছে, কেউ কেউ আমাদের প্রোগ্রাম বয়কট করছে। 

"বলছিলাম না বিজনদা।  এখন কি করবেন।"

"২০০১ সনে আমার সাইকেল চুরি হয়। বৌএর প্রশ্নের উত্তরে বললাম -"ওটা চোরের সমস্যা আর তোমার।" "মানে?" এখন চোরকে ভেবে বের করতে হবে সাইকেলটা কোথায় বিক্রি করবে, কেননা শহরে চালালে আমি ঠিক ধরে ফেলবো ওকে।" "চোরের সমস্যা বুঝলাম, কিন্তু আমার সমস্যা কোন দুঃখে?" - জিজ্ঞেস করলো বৌ। "আমি কাল থেকে তোমার সাইকেলটা নিয়ে অফিস করবো।"  হ্যা অমল, সমস্যা ওদের। আমাদের নয়।"

"সমাধান নেই?"

"আছে। একটা নয়, দুটো।"

"বলবেন?"

"দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধু উপাচার্য আছেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি। কমিউনিস্ট পার্টিতেও একজন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, আর সবাই মানে এলাকাতে শুধু সম্পাদক।  একই ভাবে সব আঞ্চলিক কমিটি থেকে সভাপতি পদ বাদ দিলে পদের সমস্যা থাকবে না।" 

"কিন্তু একজন নেতাতো থাকবে, যে নামেই হোক।  ওই পদ নিয়েই আবার ঝামেলা হবে।"

"মনে আছে, প্রধানমন্ত্রী যখন মস্কো এসেছিলেন, তখন শুধু মাত্র বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন।  তখন বৌ-বাচ্চা নিয়ে বিভিন্ন নাম দিয়ে কয়েকটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল। উদাহরনতো  আছেই। পরিবারভিত্তিক কমিটি গঠিত হোক। তাহলে পরিবারের কর্তাই দলীয় ইউনিটের নেতা হবেন।  ভয় নেই, এখানে ফ্যাকড়া দিলে পরিবার ভাঙতে হবে।  সবাই সেটা পারে না। ডিজিটাল বাংলাদেশে এগুলোই হোক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আনবিক-পারমানবিক কমিটি। তাহলে দলও  ভাঙবে না, আমরাও কোথায় যাবো বা যাবোনা এ নিয়ে দুঃশ্চিন্তায়  পরবো না।"

দুবনা, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ 
  



Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি