ওলট-পালট

কিছু কিছু দিন আছে, যা কিনা সব অর্থেই উল্টো পথে চলে। এসব দিনে রাশিয়ানরা বলে "не с той ноги встал" মানে ভুল পায়ে ঘুম থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলে।গতকাল ছিল এমন একটা দিন।সকালটা কাটলো মস্কোয়, কাজের দিনগুলোতে বাচ্চারা সাধারণতঃ সবার আগে ওঠে।গতকালও ব্যতিক্রম ছিলনা।সেভা উঠলো সবার আগে স্কুলে যাবে বলে। আমি থাকলে নিজেই ওদের সকালের খাবারটা করে দেই। রান্না ঘরে গিয়ে দেখি সেভা কম্পিউটার গেইম খেলছে।গতরাতে গুলিয়া  সবার শেষে কম্পিউটার থেকে উঠেছে, ওটা অফ করার কথা। জিজ্ঞেস করা যাবেনা, তাহলে সেভার উপর এক পশলা ঝড় বয়ে যাবে এই সাতসকালে।ওরা অবশ্য কয়েকদিন থেকেই বলছে সেভা কিভাবে যেন কম্পিউটার অন করে।আমি পাসওয়ার্ড বলিনি, ওদের বলার কথাই আসেনা। গুলিয়া কয়েক দিনই বলছে ব্যাপারটা দেখতে।গতকাল চেক করে কোন কিছু পেলামনা।আগে সাধারণতঃ ও আরেকটা ইউজার তৈরি করতো, এখন তা করেনা। তার মানে ও কোনো ভাবে এটা হ্যাক করে। কিন্তু কিভাবে? আমি এক দিকে খুশি যখন বাচ্চারা নিজেরা এইসব করতে শেখে, কিন্তু মুখ খুলে বললে বৌ হবে খড়গহস্ত। আবার ওকে যে পাসওয়ার্ড  বদলাতে শেখাবো, তাতেও সমস্যা।দেখা গেলো বদলাতে বদলাতে নিজেই ভুলে গেছে, তখন আমাকে পুরো সিস্টেমটাই চেঞ্জ করতে হবে।

সেভার ভাষায় মামা আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার জন্য কয়েক ঘন্টা গোপন জায়গা খুঁজে, তারপর যখন জিনিসটার দরকার হয় মাসের পর মাস মনে করে কোথায় রেখেছিলো।  Спрятала, чтобы не терять, но потеряла, так как забыла где спрятала, মানে লুকিয়ে রাখে যাতে না হারায়, কিন্তু হারায়, কেননা ভুলে যায় কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলো। আসলে আমার সমস্যা এখনো বড় হতে পারলাম না।  এই তো ওর বয়সে আমিও বিছানায় মার্বেল খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পরতাম, আবার সকালে উঠেই মার্বেল খেলা শুরু করতাম।  আমাদের যুগে কম্পিউটার ছিলোনা, তাই রক্ষা।  কিন্তু বাকিরা সেটা বুঝবে না।  ভাবে ওরা  ছোট বেলায় অন্যরকম ছিল, আর এখন বড় হওয়ার বদৌলতে সেভার  উপর এক হাত নেয়।  

দিনটা তাই শুরু হলো সেভাকে কভার দেবার মধ্যে দিয়ে। যখন ভাবছি দুবনার দিকে যাবো, বৌ বললো, ক্রিস্টিনা কাপড় শুকানোর লাঠিটা ছিড়ে ফেলেছে, ঠিক না করে যেন যাইনা। তারপর শুরু হলো "এভাবে করতে হবে, ও ভাবে করতে হবে"। আমি এসব পারিনা, মানে হুট করে শুরু করতে পারিনা।তাই দেখতে শুরু করলাম বাকি লাঠিগুলো কিভাবে কাজ করে।আমি দেখছি, আর গুলিয়া  কানের কাছে বলেই যাচ্ছে, 

-এতো দেখার কি আছে, সুতা দিয়ে লাগিয়ে দিলেই তো হয়। 

ইঞ্জিনিয়াররা হয়তো তাই করে, আমাদের দরকার মেকানিজম বোঝা। অনেক ভেবে চিনতে সমাধান একটা পাওয়া গেলো।ওটা ঠিক করে আরো টুকিটাকি কিছু কাজ করে যখন বেরুলাম, দেখি দেড় মিনিট পরে বাস আসবে, তাই দৌড়ে গেলাম বাস স্ট্যান্ডে।  গিয়ে যে বাসটা  পেলাম  দেখি সেটা আমার নয় (মানে এটাতে যাওয়া যায়, তবে মিনিট পনেরো অতিরিক্ত সময় নেয়, ফলে দুবনার বাস ধরতে একটু বেগ পেতে হয়), তাই ড্রাইভারকে  জিজ্ঞেস করলাম আমার বাসটা  গেছে কিনা।  ও বলে, 

-আমি কেমনে জানবো? 

বাস ছাড়ার পর দেখি আমাদের পেছনে আরেকটা বাস আসছে, কিন্তু নামি নামি করেও নাম হলো না পরের স্টপে, যদিও এটা আমি প্রায় সব সময় করি, মানে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেই। যাই হোক,  এই দোদুল্যমানতায় জন্য আক্ষেপ করতে করতে, অনেক উত্তেজনার মধ্য দিয়ে এলাম মেট্রো পর্যন্ত।  যখন সাভলভস্কায়া  স্টেশনে পৌছুলাম, মাত্র দুই মিনিট বাকি। আর এদিকে ভীড়।  শেষ পর্যন্ত বাস স্ট্যান্ডে  যেতে যেতে নাকের ডগা  দিয়ে বেরিয়ে গেলো বাসটা। ভাবলাম ট্যাক্সি নেবো, ওখান থেকে প্রায়ই বাসের দামেই ট্যাক্সি যায়, তবে যদি চারজন লোক পাওয়া যায়।  কিন্তু তিন জনের বেশি রাজি হলো না। 

ঠিক এক ঘন্টা পরে বাস ছাড়লো, দুবনা  যখন পৌছুলাম, বিকেল ৪.৩০ এ, অফিসে আর যাবো না। ভাবলাম ব্যাংকে কিছু কাজ ছিল করে আসি, আবার কাল করবো  বলে কাজটা সরিয়ে রাখলাম।  তাহলে দোকানে গিয়ে কিছু টমেটো কেনা দরকার, কেননা একটু পরে আবার সাঁতার কাটতে যেতে হবে।  দোকানে গিয়ে মুরগি, ডিম্, আগডুম-বাগডুম অনেক কিছুই কেনা হলো, কিন্তু টমেটোটাই আনতে  ভুলে গেলাম।  শুরু হলো ডিম্ রান্নার পায়তারা, কিন্তু চুলায় গিয়ে ওটা মুরগি হয়ে গেলো। সব যেন নিজের মতোই হয়ে যাচ্ছিলো, আমার সম্মতি ছাড়াই। 

এর পর গেলাম সাঁতার কাটতে, সাঁতার কেটে ছাউনাতে গেছি, দেখি কেন যেন সব ঠান্ডা, মাত্র ৯০ ডিগ্রি।  ইগর বললো 
- তোর আসলে আজ মন খারাপ। চুটকি শুনবি? 
- বল  
- ফুটবল খেলা চলছে। খেলোয়াড়রা একের পর এক ফাউল করছে।  বিরক্ত হয়ে রেফারি কার্ড দেখাবে ঠিক করলো, কিন্তু ভুল করে কার্ডের পরিবর্তে বের করলো প্রিজারভেটিভের প্যাকেট। ওই দিন ওর পরে কেউ আর একটি ফাউলও  করে নি। 
সবাই তো হেসেই খুন। 
- তাই মাঝে মধ্যে যদি ভুলে কিছু করেও ফেলিস, টেনশন করিস না, ওটাও কাজে লাগতে পারে। 

সাঁতার আর  ছাউনা শেষ গেলাম পোশাক বদলাতে।  কেন যেন মনে হলো, হাতের ব্যাগটা হালকা, কিন্তু কি নেই কিছুতেই মনে করতে পারছি না। এদিকে আলমারি খুলতে গিয়ে দেখি চাবি কাজ করছে না।  পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোক বললো, 
- দে আমি চেষ্টা করে  দেখি। 
কিছুক্ষন চেষ্টার পরে বললো, 
- কেউ মনে হয় তোর সাথে ইয়ার্কি করে চাবি বদলিয়েছে।
- কিন্তু নম্বরতো এটাই। 
- তাতে কি? চাবির রিং বদলানো কোনো ব্যাপার না। 
কি করা ভাবছি, তখন মনে হলো আমি সুইমিং কাস্ট কোথায় যেন  ফেলে এসেছি।  ওটা বের করার পর গেলাম নিচে চাবির সুরাহা করতে।  
ওরা  চাবি দেখেই বললো, 
-তুমি তো মেয়েদের চেঞ্জ রুমের আলমারীর  চাবি নিয়েছো। দেখছো না, এই চাবির রিং গোলাকার, ছেলেদের স্কয়ার সাইজ।  তুমি ফটোগ্রাফার, তোমার তো মেমরি অন্য রকম, তোমার এই ভুল আশা করি নি। 
- আমি তো শুধু নম্বর মনে রাখা প্রয়োজন মনে করি। এই দেখো আজ আমার নম্বর ছিল ৮৩, আমি শুধু মনে রেখেছি ১৯৮৩ সালে আমি রাশিয়া এসেছি।  তাছাড়া ছেলেদের আর মেয়েদের চাবি রাখার ড্রয়ার তো ভিন্ন, আমি ছেলেদের ড্রয়ার থেকেই নিয়েছি। 
- ঠিক আছে, তুমি ওপরে ড্রয়ের ওখানে অপেক্ষা করো।  কেউ ঠিক তোমার মতো ভুল করে এই চাবিটা খুঁজতে আসবে। 

কি আর করা। উপরে এগিয়ে দাঁড়ালাম ড্রয়ারের কাছে।  দেখি এক ছেলে আসছে, জিজ্ঞেস করলো, 
-তুমি চাবি খুঁজছো? আমার বৌ তোমার চাবি নিয়ে তার আলমারি খুলতে পারছে না।  ও এক্ষুনি আসবে।  
শেষ পর্যন্ত চাবি বিনিময় হলো। ভোলগার পার দিয়ে হাটতে হাটতে বাসায় ফিরলাম।  খাবারটা ততক্ষনে ঠান্ডা হয়ে গেছে। গরম করতে আর ইচ্ছে হলো না।  ওই দিনের মতো সেটাই ছিল শেষ ওলট-পালট। 

দুবনা, ১১ - ১৪ অক্টবর ২০১৬  




Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা