গন্ডার

কয়েকদিন আগে সুমিত আমাকে (আদর করে) গন্ডার বলে ডেকেছে।  ও ইঞ্জিনিয়ার মানুষ, কন্সট্রাকশনটা তাই ভালো বোঝে। ও  জানে মাংস আর চর্বির স্নেহাস্পর্শ না পেলে শুধু হাড্ডি আর চামড়ার চাপে স্নায়ুগুলোর দম বন্ধ হয়ে যায়,  আর ভোঁতা  হয়ে যায় ইন্দ্রিয়।

নারে সুমিত, আমি একা  নই, আজ সারা দেশটাই গন্ডার বনে গেছে।  উদ্ভট ঊটের  পিঠে চলতে চলতে দেশটা ঠিক গন্ডার হয়ে গেছে।  বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিটেন্সে  আর গার্মেন্টস কর্মীদের রক্ত-ঘাম ঝরানো টাকায়  সমাজটা গন্ডারের মত গায়ে-গতরে বাড়ছে ঠিকই, তবে তাতে মগজের পুষ্টি হচ্ছে না।

তখন ক্লাস টুতে পড়ি।  বাংলা বইয়ে একটা প্রবন্ধ ছিল

অনেক দিন আগের কথা।  আরবের লোকেরা তখন বর্বর ছিল।

খুব বেশি আরবের লোক দেখার সুযোগ হয়নি, তবে মস্কোয় পড়ার সময় যে কয়জন দেখেছি, তাতেই মনে হয়েছে, সময় ওদের ওখানেই থেমে গেছে।  আজ আমরা উদ্ভট ঊটের  পিঠে চড়ে  ওদিকেই যাচ্ছি।  মগজের আর কি দরকার? কি দরকার চেতনার আর বোধের?

শুনেছি, মহা সম্মেলনে অংশ নিতে আসা  পদদলিত কিছু মানুষের কান্না আর চিৎকার অনেকে সম্মেলনের প্রতি তাদের উচ্ছাসিত সমর্থন বলে মনে করে। তাই কোনো পূজার কান্না সম্মেলনের হাস্যরোল ভেদ করে আর পৌঁছে না কারো কানে।

দেশ যখন স্বাধীন হলো, পতাকাটা ছিল তিন রঙা, সবুজ মাঠে লাল সূর্যের মাঝে পতপত  করে উড়তো হলুদ রঙের  সোনার বাংলা। পরে সোনার বাংলাকে সরিয়ে শুধু মাত্র সবুজ মাঠে লাল সূর্যকে স্থান দেয়া হয়েছে।  লাল আর সবুজ - দুটো কন্ট্রাস্ট কালার, ডিয়াগ্রামে থাকে একে অপরের বিপরীতে।  ঠিক যেমন সাদা আর কালো।  ফলে অনেক মিড্ টোন আমরা আর দেখতে পাইনা।  পতাকার মতোই দেশ, সমাজ - পতাকাতো সমাজেরই বাহ্যিক রূপ। আমাদের দেশে ভালো আর মন্দ হাতে হাত রেখে চলে না, যেমনি হাতে হাত রেখে চলে না সাফল্য আর ব্যর্থতা।  রাজনীতির কথাই বলি। সরকার মনে করে দেশের সমস্ত উন্নয়নের পেছনে শুধুই তারা, আর যত ভাঙচুর, যত  খুন-জখম সব বিরোধীদের কাজ।  আর বিরোধীরা মনে করে   ঠিক তার উল্টোটা।  আর হাড্ডি-চামড়ার এই সংঘর্ষে পিষে মরে  গরীব মানুষ, গরীব  সংখ্যালঘু আর  গরীব  সংখ্যালঘু  নারী।

কেন  এমন হয়? এমন হয়, যদি সব মানুষ সমান হলেও কিছু মানুষ বেশি সমান হয়, রাষ্ট্রের চোখে সব ধর্ম সমান হলেও কোনো ধর্ম বেশি সমান হয়।  অসাম্য বিচারহীনতার জন্ম দেয়,  বিশেষ করে রাষ্ট্র যদি অসমান চোখে দেখে তার নাগরিকদের। আর বিচারহীনতা জন্ম দেয়  অরাজকতার।  একজন মানুষ তখনই  সফল, যখন সে শুধু বড় বড় কাজেই নয়, জীবনের ছোট খাটো কাজেও সফল। দেশের ও দেশের মানুষের  উন্নয়নই শুধু রাষ্ট্রের কাজ নয়, রাষ্ট্রের কাজ  যাতে তার প্রতিটি নাগরিকই সমান বিচার  পায়, রাষ্ট্রের দায়িত্ব যাতে শুধুমাত্র ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা মতাদর্শের (যদি না তা হয় রাষ্ট্রদ্রোহী) কারণে তার কোনো সন্তান,  তার কোনো নাগরিক যাতে অন্যদের হাতে হেনস্থা না হয়।  আজকে চারিদিকে এই অসহিষ্ণুতা, এই বিচারহীনতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ক্যান্সার জন্ম দিচ্ছে, শুধু মাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়ে কি তা রোধ করা যাবে, নাকি ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের মতো আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ মৃত জাতিতে পরিণত হবে? উদাহরণের জন্য খুব দূরে যেতে হবে না।  চিকিৎসা শুরুটা তাই আজ খুব জরুরী।

দুবনা, ২৬ অক্টবর ২০১৬




ছবিটা মনিকার ছোটবেলার আঁকা

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা