তরমুজ

শনিবার শেষ পর্যন্ত যখন সুপার মার্কেটে গেলাম, রাত  ৯ টা  পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষন। স্বভাবতঃই  যেটা হয়, কিনতে যাই এক জিনিস, কিনে আনি  অন্য কিছু।  হঠাৎ দেখি এক লোক তরমুজ কিনছে।  ভাবলাম আমাদের কিনলেই বা মন্দ কি? তরমুজ আমরা সাধারণতঃ  কিনি আগস্ট আর সেপ্টেম্বরে - এর আগে তরমুজ খুব একটা ভালো হয়না, প্রায়ই রাসায়নিক উপায়ে পাকায়, আর আগস্ট থেকেই অফিসিয়াল সার্টিফিকেট দিতে শুরু করে বিক্রেতাদের।  তাছাড়া এই সময় ওদের দামও  কমে আসে আমাদের পকেটের কাছাকাছি। সেপ্টেম্বরে কেনা হয় প্রায় প্রতি সপ্তাহেই।  ছুটির দিনে।  আমরা তরমুজ কিনলে একটু বড় দেখেই কিনি, আর সেটা টানতে পারে আন্তন অথবা আমি, তাই কেনা হয় ছুটির দিনে।
যা বলছিলাম, ভদ্রলোককে তরমুজ ওজন করতে দেখে আমারও  কেনার শখ হলো।  গিয়ে দেখি সবগুলো বেশ বড় বড়, একটু ভয়ে ভয়ে একটা উঠলাম।  বেশ কিছুদিন পিঠ ব্যাথা, ভাবলাম, যদি ওঠাতে না পারি, কেলেঙ্কারী  হয়ে যাবে।  কিন্তু ওয়েট মেশিনে বসিয়ে দেখি ওভার ওয়েট।  ডাকলাম দোকানের এক কর্মচারীকে।  ও ভেতরে গিয়ে ওজন করে নিয়ে এলো, ১৬ কেজি।  এতো বড় একটা তরমুজ টানা হাতি টানার চেয়েও বেশী  কষ্টের।  হাতি ব্যাটার তবু পা আছে, তরমুজ - একেবারে চাঁচাছোলা - নিজেও হাটতে পারে না, আবার ধরারও কিছু নেই সারা গায়ে।

তরমুজ কেনার পর আমার আরো দু তিনটে  কাজ করার থাকে, সাবান দিয়ে ঘষে তরমুজকে স্নান করানো, তারপর ভুঁড়ি  বরাবর ওকে ব্যবচ্ছেদ করা আর সব শেষে খেয়ে বলা তরমুজটা  মিষ্টি কি না।  আমি সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তরমুজের হৃদয়ের  একেবারে   মাঝখান থেকে একটুকরা মাংস কেটে খাই, মূলতঃ  ওটাই আমার প্রথম ও শেষ টুকরা।  আজ অবশ্য সেভা  এগিয়ে এলো কাটাকাটিতে, তবে চাকু চালানোতে এখনো অভ্যস্ত নয় কিনা, তাই শেষ পর্যন্ত আমাকেই হাত লাগাতে হলো।

বাসায় তরমুজের মূল খাদক গুলিয়া  আর মনিকা। আমরা ওদের একটু সাহায্য করি এই আর কি।  সেভা একটু খেয়ে চলে গেলো, আমিও আরেক টুকরা  নিলাম।  ক্রিস্টিনা আসি আসি করেও এলো না।  আন্তন চলে গেছে অনেক আগেই।  মনিকাকে ফোন করলাম। ও ১২ টার দিকে কল ব্যাক করে বললো, এই মাত্র কাজ থেকে বেরিয়েছে (ওদের দু সপ্তাহের ট্রেনিং চলছে), আজ আর আসবে না বাসায়, বান্ধবীর সাথে চলে যাবে। গুলিয়া  একে  রইলো অর্ধেকটা তরমুজ নিয়ে, বাকিটা আগামী কালের জন্য।

সকালে উঠেই সেভা  বায়না ধরলো চুল কাটাতে যাবে। গত সপ্তাহেই চেয়েছিলো, তবে আমি বলেছি একটু অপেক্ষা করতে আর পারলে মাকে বলতে চুলটা কেটে দিতে (ও শুধু কানের উপর থেকে একটু চুল কাটতে চাইছিলো।)  বাসা থেকে বেরুনোর পরেই সেভা  শুরু করলো
- যখন টাকার এতো সমস্যা ছিল না, মা আমার চুল কেটে দিতো, আর এখন যখন সমস্যা, কতবার মাকে  বললাম চুলটা কেটে দিতে।  জিরো প্রতিক্রিয়া।  এটা কেমন বোকামি?
এখন আমার মাকে রক্ষা করার পালা। বললাম
- মা খুব ব্যস্ত। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি, তাই করে নি।
- না পাপা, আমাদের বকতে মামার সময় আর শক্তির অভাব হয় না।
- মামাদের কাজই ওটা।
- তাহলে আমাকে জন্ম দেবার কি দরকার ছিল?
- তাই? তোর জন্মের জন্য  মামা কিন্তু এক দায়ী নয়, আমিও মামাকে সাহায্য করেছি।  তাছাড়া, তোর নিজেরও  আপত্তি ছিল না জন্ম নিতে।  না করেছিলি বলে তো মনে পরে না।
- আমিতো তখন কথাই  বলতে পারতাম না, পারলে ঠিকই না করতাম।
- জানিস না, নীরব থাকা সম্মতির লক্ষণ। তুই কথা বলতে পারতি  না, তাই আমরা ভেবেছিলাম, তোর আপত্তি নেই।  কি আর করবি, জন্ম যখন নিয়েছিস, মামার বকাতো  শুনতেই হবে।  মামা তোদের  ভালোর জন্যই  বকে।

এর মধ্যে আমরা চলে এলাম লাইট পোস্টের কাছে। হঠাৎ সেভা  ইশারায় আমাকে বললো কথা না বলতে।  আমি তো অবাক।  আমাদের সামনে ওর সমবয়েসী দুই ছেলে।
- তোর সাথে পড়ে ? - রাস্তা পার হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
- হ্যা।
- তা তুই ওকে হ্যালো বলি না কেন? আমি আছি বলে?
- না।
- তুই কি আমার জন্য তোর বন্ধুদের কাছে আনইজি ফিল করিস?
- না পাপা।  আমার সব বন্ধুরা তোমাকে খুব শ্রদ্ধা করে। সবাই তোমার কথা জানে।
- তাহলে কথা বলি না কেন ওর সাথে?
- ওর সাথে ওর এক বন্ধু ছিল, ও আমাদের স্কুলের না।  আমাদের নিয়ম, এরকম কেউ থাকলে আমরা কথা বলি না।

এখানকার স্কুল গুলোর বিভিন্ন নিয়ম আছে, মানে ছাত্রদের।  এইতো কয়েক দিন মাত্র আগে দেখি সেভা  সুযোগ খুঁজছে আমার সাথে কথা বলতে। গুলিয়া  কি একটা কাজে বাইরে গেলে সেভা  হঠাৎ আমাকে বললো
- পাপা, কথা বলা দরকার।
- বল।
- মা যেন না জানে।
- ঠিক আছে, বলবো না।
তার পর ও স্কুলে ওদের কিছু সমস্যার কথা বললো।  মানে ক্লাসের ছেলেরা কিছু দুস্টুমী করেছে, সেই কথা।
- তুই এই কাজ করলি? তা আমাকে কি করতে হবে।
- শিক্ষককে বলতে হবে যে আমি তোমাকে সব খুলে বলেছি।
- ঠিক আছে, আর কখনো এসব করিস না।
- আচ্ছা।
পরে আমি ভাবলাম, ওর তো এ কাজ  করার কথা না। কেন করলো? হ্যা, ও একা  হতে চায় না। এর আগেও দেখেছি, এমন কি ও যদি জড়িত নাও থাকে, ক্লাসের সবার সাথে দায়িত্ব নেয়। এটা একদিকে ভালো, তবে আমার মনে হয় কিছু কিছু কাজ না করার সৎ সাহসও  থাকা দরকার।

চলছি।  হঠাৎ আবার বললো
- আমার চুলগুলো খুব কালো।  এই রং আমাকে মানায় না।
- কি করবি? মেয়েদের মতো চুল রং করবি?
- না।  আচ্ছা এমন কিছু আছে, যাতে চুল একেবারেই অন্য রঙের হয়ে যাবে, কেমন একটু বাদামী?
- মাইকেল জ্যাকসনের নাম শুনেছিস?
- হ্যা, ও চামড়ার রং সাদা করেছিল।
- আর এর ফলে বিভিন্ন রোগে ভুগে মারা গেছিলো। তাই এসব করার দরকার নেই। যেটা আছে ওটা নিয়েই সুখী হবার চেষ্টা কর।  চুল - চামড়ার রং পরিবর্তন করে নয়, নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়িয়ে নিজেকে বড় করতে হয়। রোনালদো-মেসিকে ওদের চুলের জন্য কেউ পছন্দ করে না, করে ওদের খেলার জন্য।  আর সেটা অন্য জিনিস।

আজকাল অল্প দামের সেলুনগুলো কিরঘিজ দিয়ে ভর্তি।  আগে ওরা  সাধারণতঃ  রাস্তা ঘাট পরিষ্কার করতো, দোকানে কাজ করতো, ইদানিং চুল কাটা থেকে শুরু করে আরো অনেক কাজেই দেখছি ওদের।  খুব করিৎকর্মা। বসার আগেই চুল কাটা শেষ।
-ঠিক আছে?
- এদিকটা একটু ছোট করলে ভালো হয় না?
-তাহলে চুল খাড়া হয়ে থাকবে।  ভালো দেখাবে না।
মনে মনে বলি, ওরা  শুধু চুল কাটতেই পারে না, কথা দিয়েও অনেক কিছুই আদায় করতে পারে।

তরমুজের অর্ধেক সকালেই শেষ হয়ে গেছিলো।  বাকি অর্ধেকটাও একটু একটু করে কমছে। আমি এর মধ্যেই স্নানটা করে নিলাম। বেরিয়ে দেখি সেভা  তরমুজের ভেতরের দিক থেকে বেশ কয়েক টুকরা কেটে বের করেছে।  আমিও ওর দেখাদেখি আরো কয়েক টুকরা কেটে নিলাম, ফলে তরমুজতা এখন অনেকটা বালতির আকার নিলো। খাচ্ছি।  গুলিয়া  এসেই বললো
- কোন বোকা এটা করেছে? (Какой дурак это сделал?)
- আমি আর সেভা।
- দুই বোকা। (Два дурака) এখন পুরা তরমুজতাই নষ্ট হয়ে যাবে।
সেভা  শুনে বলে উঠলো
- তাতে কি? আমাদের যেমন পছন্দ হয়েছে, তেমন করেই কেটেছি।
- ঠিক আছে, এখন থেকে আমিও এভাবেই কাটবো।
- কাটো।  কে মানা  করেছে?
ওরা  যখন কথা বলছিলো, আমি আস্তে করে মনিকার জন্য বেশ কিছু তরমুজ কেটে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিলাম। আর গুলিয়াও  আমাদের দেখাদেখি ভেতর থেকে কেটে কেটে তরমুজ খেতে শুরু করলে।
রাতে যখন বাসায় ফিরলাম, তরমুজ উধাও।  তার জায়গায় পরে আছে হ্যালোউইনের সবুজ এক টুপি।

দুবনা, ১৮ অক্টবর ২০১৬



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা