গল্প নিয়ে গল্প
আমরা যারা সোভিয়েত দেশে পড়েছি, ছাত্র জীবনে ওই দেশ সম্পর্কে যে মতই পোষণ করিনা কেন, এখন ওই নামটা শুনলে সবাই কেন যেন চাঙ্গা হয়ে উঠি, মনে হয় যেন নতুন করে চুমুক দিচ্ছি ভদকার গ্লাসে, এক ধরণের রোমাঞ্চে আর নষ্টালজিয়ায় ভরে উঠে মন। জানি না যারা অন্য কোনো দেশে পড়াশুনা করেছে, তাদেরও ঠিক এমন হয় কি না? হয়তো বা হয়। হয়তো বা ওরাও আমাদের মতো বলে ওঠে, "মনে আছে সেই ক্যাফেটেরিয়ার কথা, যেখানে আমরা প্রায়ই আড্ডা দিতাম, আর এক মুখ হাসি নিয়ে আমাদের এগিয়ে আসতো "সু" নামের মেয়েটি।" কে জানে? তবে সোভিয়েত দেশের কথা আলাদা। এখনো কোনো কোনো বন্ধু আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে,
"আচ্ছা বিজন, এখনো কি নাতাশার ঘুরে বেড়ায় পার্ক কুলতুরীতে?"
"ঘুরবে না কেন, ঘুরে। তবে ওরা আর আমাদের জন্য অপেক্ষা করে না। আমাদের সামনে দিয়ে কোনো এক যুবককে বগলদাবা করে নাক উঁচিয়ে হেটে যায়। বুঝলি, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছি।"
জানি না আমার বন্ধুরা অন্য প্রান্তে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কি না।
ভালোবাসা, সংসার আর কাজের মায়ায় আমার আর এ দেশ থেকে কোথাও যাওয়া হয় নি। চোখের সামনে বদলে গেছে দেশ, বদলেছে সময়। তাই অনেকের মত আমিও সোভিয়েত দেশের নাম শুনলে কান খাড়া করে রাখি, যদি কেউ নতুন কিছু বলে।
গত ২২ বছরের চাকরি জীবন আমার কাটছে দুবনা নাম ছোট এক শহরে। মস্কো থেকে ১২০ কি মি দূরে। আগে ছিল নিষিদ্ধ শহর, তাই সোভিয়েত প্রভাব এখন থেকে বিদায় নিয়েছে বেশ পরে। মেলা মেশা শুধুই স্থানীয় লোকদের সাথে যার অধিকাংশই পদার্থবিদ, বিজ্ঞাণী , বুদ্ধিজীবী। আর বুদ্ধিজীবীরা রাজনীতির প্রতি সব সময়ই উন্নাসিক, ক্রিটিক্যাল। তাই সোভিয়েত দেশ নিয়ে আমাদের যে আবেগ, ওদের মধ্যে তেমনটা দেখি না। প্রায় সবাই সমালোচনা করে সে সময়কে, যদি এই সময় নিয়েও কেউই তেমন উৎসাহী নয়। গবেষকরা বাস করে নিজেদের জগতে, কল্পনার জগতে। যেখানে থিওরী আর প্র্যাকটিক্যাল খুব বেশি মেলে না। তাই অনেক সময়ই প্রশ্ন করি, আচ্ছা, ওদের দেশ, ওদের অতীত নিয়ে এই যে আমরা এতো উচ্ছাসিত, তাহলে ওরা নিজেরা এমন শীতল কেন? মনে হয় আমরা যারা পড়তে এসেছিলাম, আমরা শুধু সমাজতন্ত্রের সুফল গুলোই পেয়েছিলাম, বিনা বেতনে পড়া, বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ানো, অনেক মানুষের ভালোবাসা। আমরা ছিলাম ক্যামেরা সামনের দিকে, যারা সমাজতন্ত্রের আনন্দচিত্রের যে নাটক রচনা হচ্ছিলো, তাতে অভিনয় করতাম। এ দেশের মানুষরা ছিল ক্যামেরার অন্য দিকে, যারা এই নাটকটি সফল করার কঠিক কাজে নিমগ্ন ছিল। তাই সোভিয়েত দেশ নিয়ে ওদের আর আমাদের মূল্যায়ন ঠিক এক হয় না।
তাছাড়া আমাদের, বিশেষ করে আমরা যারা সোভিয়েত সীমানার বাইরে আছি, তাদের জন্য ১৯৯১ এর পর সেই দেশটা একটা রূপ কথার দেশে পরিণত হয়েছে। দেশটা এমনিতেও ছিল রূপ কথার দেশের মতোই, অন্য সব দেশ থেকে আলাদা। তার উপর যখন দেশটি এক দিন নাই হয়ে গেলো, আমাদের যৌবণ, জীবনের সেরা দিনগুলো, আমাদের ভালোবাসা, ভালোলাগা, স্বপ্ন আর স্বপ্নের মানুষগুলো যেন জমে বরফ হয়ে গেলো। লৌহ যবনিকা ভাঙলো ঠিকই, কিন্তু সময় যে নতুন দেয়াল তুলে দিল সোভিয়েত সমাজের থাকা আর না থাকার মধ্যে - সেই দেয়াল টপকে আমাদের কল্পনা অনেক ক্ষেত্রেই ছুতে পারলো না ফেলে যাওয়া সেই স্বপ্ন গুলো। হয়তো তাই আজ আমাদের মন নিজের অজান্তেই কাঁদে সেই দেশে জন্য, সেই সময়ের জন্য। তাই কেউ যদি সেই সময়ের গল্পের ঝাঁপি নিয়ে বসে আমরা গোগ্রাসে তা গিলে যাই, ফিরে যাই অতীতে।
তাই যখন কোনো রানা বা কোনো লিপি বা কোনো শিহাব বলে যায় তাদের হারানো দিনের গল্প, সব ফেলে বসে পড়ি গল্পের আসরে, যেমনটা ছোট বেলায় কাকা বা মার গা ঘেঁষে বসে শুনতাম রামায়ণের গল্প। এরেভান কখনো না গেলেও লিপির চোখ দিয়েই দেখি সেই শহরের রাস্তা ঘাট, মনে হয় আমিও হেটেছিলাম লিপির হাত ধরে ওই রাস্তা দিয়ে। মনে আছে এলদার রিয়াজানভের "ইরোনিয়া সুদবি ইলি স লগ্কিম পারম" (Ирония судьбы или С легким паром) ছবিটার কথা ? যেখানে মস্কোর নায়ক আর লেনিনগ্রাদের নায়িকার বাড়ীর ঠিকানা ছিল একই - উলিৎসা স্ট্রোইটেলেই ১২, শুধু কি তাই? ঘরের চাবিও ছিল এক, এমন কি আসবাব পর্যন্ত। দুই শহরের মধ্যে ৬০০ র বেশি কি মি দূরত্ব কোনো বাধাই হয় না। আজ বন্ধুদের (বান্ধবীদের, যাতে আমার নারীদের সম অধিকারে বিশ্বাসে কেউ প্রশ্ন না তোলে) লেখা পড়ে মনে হয় এ দেশে শুধু একই প্যাটার্নে বাড়ী-ঘর রাস্তা ঘাটই ছিল না, একই রকম ছিল মানুষের জীবন। আর তাই তো নিজেদের এতো সহজে খুঁজে পাই গল্পের পাতায়।
লিপির লেখা ছিল মূলতঃ ডাইরীর মতো, নিজের জীবনকে কেন্দ্র করে। খুবই উপভোগ্যও লেখা। একই সাথে বিতর্কিত বিষয় এড়ানো। সেটা লেখায় ক্ষতি করে নি, পড়তে গিয়ে মন হয়নি বসে বসে পরনিন্দা, পরচর্চা করছি, যেটা আমাদের অনেকটা স্বভাবগতঃ। তাছাড়া ওই লেখায় সবাইকে নিজ নিজ নামে হাজির করায় লেখিকার একটা বাড়তি দায়িত্ব ছিল কাউকে বিতর্কে জড়িয়ে না ফেলার। রানার লেখায় সরাসরি কারো নাম ছিল না, আবার "চরিত্র গুলো কাল্পনিক" এমন কোনো কৈফিয়ৎ ও দেয়া ছিল না। যারা চরিত্র গুলোকে কাছ থেকে চিনতেন, তারা বুঝেছেন কাদের নিয়ে কথা হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রেও আবেগকে বশ মানানোর ফলে ঝড় ওঠেনি চায়ের কাপে বা ফেইসবুকের পাতায়। শিহাবের লেখাটা সে দিক থেকে অন্য রকম। "চরিত্র গুলো কাল্পনিক" এই কৈফিয়ৎ হয়তো মানুষের মনে একটু বেশি কৌতূহলের তৈরী করেছে। যে নামের আড়ালেই থাকুক, যে পোশাকেই থাকুক, অনেকেই ফটোশপে চরিত্র গুলোর কাঁধে ঠিক ঠাক মাথাগুলো জুড়ে দিতে পেরেছে, শুধু তাই নয় কমেন্ট করতে গিয়ে কেউ কেউ গল্পের আর সোভিয়েত দেশের সময়কে অতিক্রম করে নায়ক-নায়িকাদের গল্প পরবর্তী বাস্তব জীবনের চরিত্র আঁকতে দ্বিধা করেনি। অনেকটা সেই "লাস্ট টেম্পটেশন অফ জেসাস " এর মতো। আর এখানেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। কেউ ভাবছেন এটা কারো ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ। পক্ষের আর বিপক্ষের বৈরী বাতাসে উঠেছে তুমুল ঝড়, আর শিহাব এই ঝড়ের রাতে হাল ছেড়ে দিয়ে যাত্রীদের করেছে দিশেহারা। ওর শেষ লেখাটা দেখে তাই অন্ততঃ মনে হয়েছে আমার।
অনেক আগে, ১৯৮৯এ ২ সপ্তাহের জন্য পেরেস্ল্যাভল-জালেস্কি গেছিলাম আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলেক্ট এর উপর ইউনেস্কোর এক সেমিনারে। পাসপেলভ, ওসিপোভ সহ তখনকার অনেক অনেক বাঘা বাঘা বিশেষজ্ঞরা লেকচার দিতেন। ওদেরই এক জন বলেছিলো মানুষ নতুন যাই করুক, শুধু নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই করতে পারে। যদি কাউকে এক নতুন জীবের ছবি আঁকতে বলা হয়, দেখবে সে ঠিকই কোনো একটা পরিচিত জীবের অনুকরণে সেটা করছে, হয়তো লেজ এক প্রাণীর, মাথা অন্যের। কয়েকদিন আগে গেলাম ইউরিয়েভ পোলস্কি বলে এক জায়গায়। সেখানে ১৩০০ সালের দিকে এক শিল্পী পাথরে হাতির ছবি এঁকেছিল, লেজটা ছিল খরগোশের লেজের মতো। এ কথাটা বলা এ জন্যেই যে, লেখক যখন কিছু লেখেন, তার কিছু প্রোটোটাইপ থাকে। ফিকশনে সেটা কম হলেও জীবনের গল্পে, যেটা শিহাব লিখছে, এর উপস্থিতি খুব বেশি। তলস্তয়ের যুদ্ধ ও শান্তি তে অনেক ঐতিহাসিক চরিত্র আছে। যদি শরৎচন্দ্র বা অন্য কোনো লেখককে দেখতে যাই, খুঁজলে নিশ্চয়ই কোনো প্রোটোটাইপ পাওয়া যাবে। এদিক থেকে দেখলে আমার মনে হয় সমস্যাটা না যতটা লেখকের তার চেয়ে বেশি পাঠকের। নিজের কথাই বলি, দস্তয়েভস্কির কারামজোভ ব্রাদার্স পড়লে আমার নিজেকে ইভান বলে মনে হয়। শুধু কি আমি, আমরা সবাই যখন কোনো গল্প পড়ি, নিজের অজান্তেই নিজেকে কোনো চরিত্রের সাথে মিশিয়ে ফেলি, আর এখানেই লেখকের সার্থকতা। আমি অবাক হবনা, যারা সোভিয়েত দেশে ছিলাম না, যারা এই চরিত্রগুলোকে জানেন না, তারা যদি নিজেদের ওসব জায়গায় বসায় । আমার সমস্যা, আমি অনেককেই ব্যক্তিগত ভাবে চিনি, তাই নিজেকে ওখানে বসাতে পারি না, আমি হয়ে যাই পার্শ্বদর্শক, যে আস্তে করে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বন্ধুদের আড্ডায় গিয়ে বলছে, "জানিস, ওরা দুজন চুটিয়ে প্রেম করছে। এইতো দেখে এলাম তিন তলার সিঁড়িতে।" আমার এই প্রতিক্রিয়ার জন্য দোষী কে ? লেখক না আমি? আমি যদি গল্পটা গল্পের মতো না পড়ে অন্য ভাবে নেই, তার দায়টা কার? ভেবে দেখুন তা, যদি কেউ বলে "আন্না কারেনিনা" আসলে আন্নার বিরুদ্ধে টলস্টয়ের এক কুৎসা রটনা? আমার মনে হয় রচনার চরিত্র সম্পর্কে আমাদের পূর্ব জ্ঞান আমাদেরকে স্বাভাবিক ভাবে লেখাগুলো নিতে দিচ্ছে না। কিন্তু আমাদের সংখ্যা কত? ২০০, ৫০০, ১০০০, ৫০০০ - আর লেখাতো সবার জন্য, ১৬ কোটি বাংলাদেশির জন্য, যারা চেনে না কোনো ইলিয়াস ভাই বা লিকলিকে মেয়েটাকে? কেন আমি প্রশ্ন করছি? আমি নিজেও লিখি কালে ভদ্রে। ইচ্ছে আছে সোভিয়েত জীবন নিয়েও লেখা। কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয় না এসব লিখা ঠিক হবে। এক সময় মির্চা ইলিয়াড "লা নুই বেঙ্গলি" লিখছিলেন, আর মৈত্রী দেবী তার উত্তর দিয়েছিলেন "ন হন্যতে" লিখে। লেখকের যেমন দায়িত্ব আছে তার প্রোটোটাইপদের প্রটেক্ট দেয়া, পাঠকেরও তেমনি দায়িত্ব থেকে যায় গল্পকে গল্প বলেই নেয়া। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন, "সমস্যা হলো, আমরা অনেকেই কোরানে যা লেখা আছে তাতো পড়িই , যা নেই তাও পড়ি কোরানের ভেতর।"
আসুন আমরা শুধু গল্পটাই পড়ি, গল্পের বাইরের জীবনটা গল্প থেকে আলাদা করে রাখি। কেননা না, আমাদের সবারই শুধু মনে রাখার মতই নয়, ভুলে যাবার মতো অনেক ঘটনাও আছে। গল্পের খাতিরে লেখা এ রকম কিছু ঘটনাকে আমরা যদি লেবুর মতো কচলাই, শেষ পর্যন্ত শুধু গল্প নয়, আমাদের জীবন, আমাদের সম্পর্ক সবই তেতো হয়ে যাবে।
দেশটাকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি, যদি তার গল্পটাকে পারি এটাই বা কম কি?
দুবনা, ২০ অক্টবর ২০১৬
"আচ্ছা বিজন, এখনো কি নাতাশার ঘুরে বেড়ায় পার্ক কুলতুরীতে?"
"ঘুরবে না কেন, ঘুরে। তবে ওরা আর আমাদের জন্য অপেক্ষা করে না। আমাদের সামনে দিয়ে কোনো এক যুবককে বগলদাবা করে নাক উঁচিয়ে হেটে যায়। বুঝলি, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছি।"
জানি না আমার বন্ধুরা অন্য প্রান্তে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কি না।
ভালোবাসা, সংসার আর কাজের মায়ায় আমার আর এ দেশ থেকে কোথাও যাওয়া হয় নি। চোখের সামনে বদলে গেছে দেশ, বদলেছে সময়। তাই অনেকের মত আমিও সোভিয়েত দেশের নাম শুনলে কান খাড়া করে রাখি, যদি কেউ নতুন কিছু বলে।
গত ২২ বছরের চাকরি জীবন আমার কাটছে দুবনা নাম ছোট এক শহরে। মস্কো থেকে ১২০ কি মি দূরে। আগে ছিল নিষিদ্ধ শহর, তাই সোভিয়েত প্রভাব এখন থেকে বিদায় নিয়েছে বেশ পরে। মেলা মেশা শুধুই স্থানীয় লোকদের সাথে যার অধিকাংশই পদার্থবিদ, বিজ্ঞাণী , বুদ্ধিজীবী। আর বুদ্ধিজীবীরা রাজনীতির প্রতি সব সময়ই উন্নাসিক, ক্রিটিক্যাল। তাই সোভিয়েত দেশ নিয়ে আমাদের যে আবেগ, ওদের মধ্যে তেমনটা দেখি না। প্রায় সবাই সমালোচনা করে সে সময়কে, যদি এই সময় নিয়েও কেউই তেমন উৎসাহী নয়। গবেষকরা বাস করে নিজেদের জগতে, কল্পনার জগতে। যেখানে থিওরী আর প্র্যাকটিক্যাল খুব বেশি মেলে না। তাই অনেক সময়ই প্রশ্ন করি, আচ্ছা, ওদের দেশ, ওদের অতীত নিয়ে এই যে আমরা এতো উচ্ছাসিত, তাহলে ওরা নিজেরা এমন শীতল কেন? মনে হয় আমরা যারা পড়তে এসেছিলাম, আমরা শুধু সমাজতন্ত্রের সুফল গুলোই পেয়েছিলাম, বিনা বেতনে পড়া, বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ানো, অনেক মানুষের ভালোবাসা। আমরা ছিলাম ক্যামেরা সামনের দিকে, যারা সমাজতন্ত্রের আনন্দচিত্রের যে নাটক রচনা হচ্ছিলো, তাতে অভিনয় করতাম। এ দেশের মানুষরা ছিল ক্যামেরার অন্য দিকে, যারা এই নাটকটি সফল করার কঠিক কাজে নিমগ্ন ছিল। তাই সোভিয়েত দেশ নিয়ে ওদের আর আমাদের মূল্যায়ন ঠিক এক হয় না।
তাছাড়া আমাদের, বিশেষ করে আমরা যারা সোভিয়েত সীমানার বাইরে আছি, তাদের জন্য ১৯৯১ এর পর সেই দেশটা একটা রূপ কথার দেশে পরিণত হয়েছে। দেশটা এমনিতেও ছিল রূপ কথার দেশের মতোই, অন্য সব দেশ থেকে আলাদা। তার উপর যখন দেশটি এক দিন নাই হয়ে গেলো, আমাদের যৌবণ, জীবনের সেরা দিনগুলো, আমাদের ভালোবাসা, ভালোলাগা, স্বপ্ন আর স্বপ্নের মানুষগুলো যেন জমে বরফ হয়ে গেলো। লৌহ যবনিকা ভাঙলো ঠিকই, কিন্তু সময় যে নতুন দেয়াল তুলে দিল সোভিয়েত সমাজের থাকা আর না থাকার মধ্যে - সেই দেয়াল টপকে আমাদের কল্পনা অনেক ক্ষেত্রেই ছুতে পারলো না ফেলে যাওয়া সেই স্বপ্ন গুলো। হয়তো তাই আজ আমাদের মন নিজের অজান্তেই কাঁদে সেই দেশে জন্য, সেই সময়ের জন্য। তাই কেউ যদি সেই সময়ের গল্পের ঝাঁপি নিয়ে বসে আমরা গোগ্রাসে তা গিলে যাই, ফিরে যাই অতীতে।
তাই যখন কোনো রানা বা কোনো লিপি বা কোনো শিহাব বলে যায় তাদের হারানো দিনের গল্প, সব ফেলে বসে পড়ি গল্পের আসরে, যেমনটা ছোট বেলায় কাকা বা মার গা ঘেঁষে বসে শুনতাম রামায়ণের গল্প। এরেভান কখনো না গেলেও লিপির চোখ দিয়েই দেখি সেই শহরের রাস্তা ঘাট, মনে হয় আমিও হেটেছিলাম লিপির হাত ধরে ওই রাস্তা দিয়ে। মনে আছে এলদার রিয়াজানভের "ইরোনিয়া সুদবি ইলি স লগ্কিম পারম" (Ирония судьбы или С легким паром) ছবিটার কথা ? যেখানে মস্কোর নায়ক আর লেনিনগ্রাদের নায়িকার বাড়ীর ঠিকানা ছিল একই - উলিৎসা স্ট্রোইটেলেই ১২, শুধু কি তাই? ঘরের চাবিও ছিল এক, এমন কি আসবাব পর্যন্ত। দুই শহরের মধ্যে ৬০০ র বেশি কি মি দূরত্ব কোনো বাধাই হয় না। আজ বন্ধুদের (বান্ধবীদের, যাতে আমার নারীদের সম অধিকারে বিশ্বাসে কেউ প্রশ্ন না তোলে) লেখা পড়ে মনে হয় এ দেশে শুধু একই প্যাটার্নে বাড়ী-ঘর রাস্তা ঘাটই ছিল না, একই রকম ছিল মানুষের জীবন। আর তাই তো নিজেদের এতো সহজে খুঁজে পাই গল্পের পাতায়।
লিপির লেখা ছিল মূলতঃ ডাইরীর মতো, নিজের জীবনকে কেন্দ্র করে। খুবই উপভোগ্যও লেখা। একই সাথে বিতর্কিত বিষয় এড়ানো। সেটা লেখায় ক্ষতি করে নি, পড়তে গিয়ে মন হয়নি বসে বসে পরনিন্দা, পরচর্চা করছি, যেটা আমাদের অনেকটা স্বভাবগতঃ। তাছাড়া ওই লেখায় সবাইকে নিজ নিজ নামে হাজির করায় লেখিকার একটা বাড়তি দায়িত্ব ছিল কাউকে বিতর্কে জড়িয়ে না ফেলার। রানার লেখায় সরাসরি কারো নাম ছিল না, আবার "চরিত্র গুলো কাল্পনিক" এমন কোনো কৈফিয়ৎ ও দেয়া ছিল না। যারা চরিত্র গুলোকে কাছ থেকে চিনতেন, তারা বুঝেছেন কাদের নিয়ে কথা হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রেও আবেগকে বশ মানানোর ফলে ঝড় ওঠেনি চায়ের কাপে বা ফেইসবুকের পাতায়। শিহাবের লেখাটা সে দিক থেকে অন্য রকম। "চরিত্র গুলো কাল্পনিক" এই কৈফিয়ৎ হয়তো মানুষের মনে একটু বেশি কৌতূহলের তৈরী করেছে। যে নামের আড়ালেই থাকুক, যে পোশাকেই থাকুক, অনেকেই ফটোশপে চরিত্র গুলোর কাঁধে ঠিক ঠাক মাথাগুলো জুড়ে দিতে পেরেছে, শুধু তাই নয় কমেন্ট করতে গিয়ে কেউ কেউ গল্পের আর সোভিয়েত দেশের সময়কে অতিক্রম করে নায়ক-নায়িকাদের গল্প পরবর্তী বাস্তব জীবনের চরিত্র আঁকতে দ্বিধা করেনি। অনেকটা সেই "লাস্ট টেম্পটেশন অফ জেসাস " এর মতো। আর এখানেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। কেউ ভাবছেন এটা কারো ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ। পক্ষের আর বিপক্ষের বৈরী বাতাসে উঠেছে তুমুল ঝড়, আর শিহাব এই ঝড়ের রাতে হাল ছেড়ে দিয়ে যাত্রীদের করেছে দিশেহারা। ওর শেষ লেখাটা দেখে তাই অন্ততঃ মনে হয়েছে আমার।
অনেক আগে, ১৯৮৯এ ২ সপ্তাহের জন্য পেরেস্ল্যাভল-জালেস্কি গেছিলাম আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলেক্ট এর উপর ইউনেস্কোর এক সেমিনারে। পাসপেলভ, ওসিপোভ সহ তখনকার অনেক অনেক বাঘা বাঘা বিশেষজ্ঞরা লেকচার দিতেন। ওদেরই এক জন বলেছিলো মানুষ নতুন যাই করুক, শুধু নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই করতে পারে। যদি কাউকে এক নতুন জীবের ছবি আঁকতে বলা হয়, দেখবে সে ঠিকই কোনো একটা পরিচিত জীবের অনুকরণে সেটা করছে, হয়তো লেজ এক প্রাণীর, মাথা অন্যের। কয়েকদিন আগে গেলাম ইউরিয়েভ পোলস্কি বলে এক জায়গায়। সেখানে ১৩০০ সালের দিকে এক শিল্পী পাথরে হাতির ছবি এঁকেছিল, লেজটা ছিল খরগোশের লেজের মতো। এ কথাটা বলা এ জন্যেই যে, লেখক যখন কিছু লেখেন, তার কিছু প্রোটোটাইপ থাকে। ফিকশনে সেটা কম হলেও জীবনের গল্পে, যেটা শিহাব লিখছে, এর উপস্থিতি খুব বেশি। তলস্তয়ের যুদ্ধ ও শান্তি তে অনেক ঐতিহাসিক চরিত্র আছে। যদি শরৎচন্দ্র বা অন্য কোনো লেখককে দেখতে যাই, খুঁজলে নিশ্চয়ই কোনো প্রোটোটাইপ পাওয়া যাবে। এদিক থেকে দেখলে আমার মনে হয় সমস্যাটা না যতটা লেখকের তার চেয়ে বেশি পাঠকের। নিজের কথাই বলি, দস্তয়েভস্কির কারামজোভ ব্রাদার্স পড়লে আমার নিজেকে ইভান বলে মনে হয়। শুধু কি আমি, আমরা সবাই যখন কোনো গল্প পড়ি, নিজের অজান্তেই নিজেকে কোনো চরিত্রের সাথে মিশিয়ে ফেলি, আর এখানেই লেখকের সার্থকতা। আমি অবাক হবনা, যারা সোভিয়েত দেশে ছিলাম না, যারা এই চরিত্রগুলোকে জানেন না, তারা যদি নিজেদের ওসব জায়গায় বসায় । আমার সমস্যা, আমি অনেককেই ব্যক্তিগত ভাবে চিনি, তাই নিজেকে ওখানে বসাতে পারি না, আমি হয়ে যাই পার্শ্বদর্শক, যে আস্তে করে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বন্ধুদের আড্ডায় গিয়ে বলছে, "জানিস, ওরা দুজন চুটিয়ে প্রেম করছে। এইতো দেখে এলাম তিন তলার সিঁড়িতে।" আমার এই প্রতিক্রিয়ার জন্য দোষী কে ? লেখক না আমি? আমি যদি গল্পটা গল্পের মতো না পড়ে অন্য ভাবে নেই, তার দায়টা কার? ভেবে দেখুন তা, যদি কেউ বলে "আন্না কারেনিনা" আসলে আন্নার বিরুদ্ধে টলস্টয়ের এক কুৎসা রটনা? আমার মনে হয় রচনার চরিত্র সম্পর্কে আমাদের পূর্ব জ্ঞান আমাদেরকে স্বাভাবিক ভাবে লেখাগুলো নিতে দিচ্ছে না। কিন্তু আমাদের সংখ্যা কত? ২০০, ৫০০, ১০০০, ৫০০০ - আর লেখাতো সবার জন্য, ১৬ কোটি বাংলাদেশির জন্য, যারা চেনে না কোনো ইলিয়াস ভাই বা লিকলিকে মেয়েটাকে? কেন আমি প্রশ্ন করছি? আমি নিজেও লিখি কালে ভদ্রে। ইচ্ছে আছে সোভিয়েত জীবন নিয়েও লেখা। কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয় না এসব লিখা ঠিক হবে। এক সময় মির্চা ইলিয়াড "লা নুই বেঙ্গলি" লিখছিলেন, আর মৈত্রী দেবী তার উত্তর দিয়েছিলেন "ন হন্যতে" লিখে। লেখকের যেমন দায়িত্ব আছে তার প্রোটোটাইপদের প্রটেক্ট দেয়া, পাঠকেরও তেমনি দায়িত্ব থেকে যায় গল্পকে গল্প বলেই নেয়া। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন, "সমস্যা হলো, আমরা অনেকেই কোরানে যা লেখা আছে তাতো পড়িই , যা নেই তাও পড়ি কোরানের ভেতর।"
আসুন আমরা শুধু গল্পটাই পড়ি, গল্পের বাইরের জীবনটা গল্প থেকে আলাদা করে রাখি। কেননা না, আমাদের সবারই শুধু মনে রাখার মতই নয়, ভুলে যাবার মতো অনেক ঘটনাও আছে। গল্পের খাতিরে লেখা এ রকম কিছু ঘটনাকে আমরা যদি লেবুর মতো কচলাই, শেষ পর্যন্ত শুধু গল্প নয়, আমাদের জীবন, আমাদের সম্পর্ক সবই তেতো হয়ে যাবে।
দেশটাকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি, যদি তার গল্পটাকে পারি এটাই বা কম কি?
দুবনা, ২০ অক্টবর ২০১৬
Comments
Post a Comment