সমস্যা
১৯৮৩ সনে আমি যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে আসি, আমাদের বৃত্তি ছিল তখন প্রতি মাসে ৮০ রুবল। যেহেতু হোস্টেল, টিউশন, লাইব্রেরী আর চিকিৎসা ছিল ফ্রি, আর খাবারের দাম ছিল যথেষ্ট কম, তাই টাকার অংকটা খুব কম ছিল না। অনেকেতো এর মধ্যে থেকে আবার জামা-কাপড়ের জন্য টাকা জমাতো। সোভিয়েত দেশে আমার হাড্ডি ঢাকার উপযুক্ত পোশাক ছিল না বিধায় বাড়ী থেকে নিয়মিত জামা-কাপড় পাঠাত। সাথে ফাও হিসেবে চা, কফি পেতাম। তাই বৃত্তির টাকায় দিন কাটতো বেশ। তবে টাকা জমতো না, বিশেষ করে ক্যামেরা কেনার পর থেকে। কেননা ক্যামেরার হাত ধরে আসতো লেন্স, ফিল্টার,এক্সপোনোমিটার। এ ছাড়া ফিল্ম আর আনুষঙ্গিক জিনিস তো ছিলোই। তাছাড়া বই, এলবাম, রেকর্ড - এসবও কিনতাম নিয়মিত।
রাশিয়া জীবনের প্রথমে খেতাম মেস করে আনোয়ার আর জালালের সাথে, পরে শামীম শুভ সহ অনেকে মিলে একটা বড় ফ্যামিলি গড়ে ওঠে। রান্না করতো সবাই, আমিও করতাম যদিও দেশে চা'র বাইরে কিছু করার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। একদিন রাতে বড় ভাইরা এলো আজান দিতে, মানে রাতে খাবে বলে। ওদের প্ল্যান ছিল না, আমরাই পীড়াপীড়ি করে ধরে রাখলাম। রান্নার লঘু দায়িত্বে আমি। রান্না বসলো, অন্যদের দেখা দেখি আমিও মুরগি কেটে একটু ভেঁজে সমস্ত পদ্মা উজাড় করে জল ঢেলে এসে বসলাম সবার সাথে গল্পে। একটু পর যাই আর দেখে আসি রান্নার কত দূর? কিন্তু ব্যাপারটা কি? হাড়িতে যেন বানের জল, কমছেই না। যেন কেউ এসে একটু পর পর জল ঢেলে দিচ্ছে মুরগির ভেতর। এদিকে রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত মিন্টুদা ওটা দেখে এসে বললো, "কাল সকালেও এই মুরগি হবে না। অনেক ধন্যবাদ। আমরা বরং রুমে গিয়েই খাবো।" ওরা চলে গেলো, সাথে সাথে চলে গেলো আমার হেড কুকের চাকরিটা। অবশ্য পরে যখনই মেসে খাবারের বাড়ন্ত থাকতো আর আজানিদের সংখ্যা হাতের আঙ্গুল ছাড়িয়ে যেত, ঘোষণা করে আমাকে করা হতো হেড কুক। এ যেন ভীষ্মের সামনে শিখন্ডী। সবাই আমার রান্নার নাম শুনলেই শরতের ঝরা পাতার মতো কোথায় যে উবে যেত!
প্রথম বর্ষে মেস করি জালালের সাথে, মাসের প্রথমেই ওকে ১৫ রুবল দিয়ে আসতাম, খেতে তেমন যাওয়া হতো না, ক্যান্টিনে খেয়ে বা আজান দিয়েই চলে যেত দিন, তাই এক সময় বিরক্ত হয়ে জালাল আমাকে মেসের রাজ্য থেকে নির্বাসন দেয়। তার পরেই শুরু হয় এক চলার পালা। কখনো খাই ক্যান্টিনে, কখনো আহসান, বিমল, দিপু, রেজা - ওদের ওখানে। তবে বেশির ভাগই খেতাম রুমা-শাওন আর পরে রুমা-সুস্মির হেঁসেলে।
এখন একা থাকি। আমি নিজেই হেড কুক, নিজেই হেলপার, নিজেই খাবারের ভালমন্দের বিচারক। এখন ভলগা আমার পাশ দিয়ে বয়ে যায়, অনেক জল থাকলেও খাবারে জল কম দেই, তাই ওরা পুড়ে যায় প্রায়ই। রান্না করি প্রায় একই নিয়মে, একই মসলা, একই তেল। তবে একটা জিনিস বুঝে গেছি অনেক আগেই। রান্নাটা আসলে কোয়ান্টাম মেথডে হয়। মানে রান্নার আলজেব্রাটা নন-কমুটেটিভ। মানে যদি সাধারণ জীবনে ২ + ৫ = ৫ + ২, এখানে তেলের আগে মসলা দেবেন না মসলার আগে তেল - এর উপর খাবারের স্বাদ নির্ভর করে। আর যেহেতু তেল, লবন, হলুদ, মরিচ, আদা, পেঁয়াজ, মাংস সহ অনেক ইনগ্রেডিয়েন্ট থাকে, ওদের ফ্রাই প্যানে ছাড়ার অর্ডার চেঞ্জ করে একই জিনিস দিয়ে হাজার রকম স্বাদের (বিস্বাদের) খাবার তৈরী করা যায়।
দিন কাটছিলো চিন্তাহীন ভাবে, পড়াশুনা, ছবিতুলা আর বন্ধুদের (আচ্ছা ওরাও কি আমাকে তাই ভাবতো?) ডিস্টার্ব করে। আশির দশকের শেষ দিকে যখন অনেকেই ব্যবসা শুরু করলো, হাতে এলো কাঁচা পয়সা আর জিনিস পত্রের দাম গেলো বেড়ে, আগেরকার মত ওই সরল পথে সরল গতিতে চলা হলো কঠিন থেকে কঠিনতর। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় প্রায়ই ধার দেনা হতে লাগলো। একবার দিপু বললো ইস্তাম্বুল গিয়ে সোয়েটার আর জ্যাকেট এনে বিক্রি করতে। বললো, তুই গিয়ে নিয়ে আয়, বাকিটা আমরা করে দেব। গেলাম ইস্তাম্বুল, সারাদিন যখন ছবি তুলে কাটলো আর পরে মনে পড়লো কেনাকাটার কথা, দোকানপাট বন্ধের পথে। কোনো মতে কয়েকটা জ্যাকেট কিনলাম, দামী জ্যাকেট। এক দোকানে সোয়েটার কিনলাম, অনেক খোশ গল্প করলো দোকানদার। পরে মস্কো ফিরে দেখি সোয়েটারগুলো ডিফেক্টে ভরা। জ্যাকেট দেখে দিপু বললো - এগুলো লস ছাড়া বিক্রি করা যাবে না, হলো তাই, আমার ইস্তাম্বুল ভ্রমণ আমার ঘাড়ে ৭০০ ডলারের ঋণ চাপিয়ে দিলো। তাই পরে আবার সবাই মিলে পাঠালো সিঙ্গাপুর। আর তার পর থেকেই সিঙ্গাপুর থেকে জিনিস আনা হয়ে উঠলো কঠিন। খোরশেদ ভাই বললো, "অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়।"
এর পর আর কারো কথায় কোনো ব্যবসা সফরে আর যাইনি। ১৯৯৪ তে চলে আসি দুবনায়। শুরু হয় নতুন জীবন। আমার পদার্থবিদ হওয়া আর বিপ্লবী (?) হওয়ার পূর্বকাহিনী একই রকম। বিপ্লবের পথে দীক্ষিত হই মনি সিংহ, অনিল মুখার্জী ও অন্যান্য বিপ্লবীদের কথা পড়ে, যারা আদর্শের জন্য সব জাগতিক সুখ ত্যাগ করেছেন, শুধু মাত্র আদর্শ অর্জনেই খুঁজে পেয়েছেন জীবনের সব সুখ। একই ভাবে সত্যেন বোস, আইনস্টাইন - এদের কথা আমাকে পদার্থ বিদ্যায় দীক্ষিত করেছে, যারা জীবনে ছিলেন খুব সাদাসিধে। ১৯৮৩ তে দেশ ছাড়ার আগে পর্যন্ত কমরেডদের মধ্যে মণিদা আর পুরানো বিপ্লবীদের সরল জীবনের ছাপ দেখেছি। এখানে যখন আসি, দেখেছি আমাদের শিক্ষকদের, যারা সবাই খুব নামকরা বিজ্ঞানী, জীবনে সাধারণ, যারা জামা-কাপড়ের প্রতি ছিলেন উদাসীন। দুবনায় তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এমন কি ১৯৯৬ সালে যখন প্রথম ট্রিয়েস্ট যাই, সবাই মোটামুটি একই রকম ছিলেন। ট্রিয়েস্ট সফরের শেষ এক সেমিনারে অনেক আমেরিকান আসে - ওই প্রথম দেখলাম বিজ্ঞানীরাও ফ্যাশন করে, তারাও অনেক দামী জামা কাপড় পরে।
আসলে সমস্যা এখানে নয়। গত প্রায় দশ বছর আমার একটা প্রজেক্ট আছে, যা থেকে কম্পিউটার ইত্যাদি কেনার জন্য বেশ কিছু টাকা পাই। ডলারের দাম বাড়ায় টাকার পরিমান বেড়ে গেছে, তাই জিনিস কেনা যায় বেশি। সমস্যা হলো কম্পিউটার তো আর ভাত নয়, প্রতিদিন নতুন লাগবে বা জামা-কাপড় যা মাঝে মধ্যে বদলানো যায়। ৩ বছরের মাথায় যখন কম্পিউটার, প্রিন্টার সহ যা আমার কাজে লাগে সব কিছুর আপডেট হয়ে গেলো, পরলাম এক বিরাট ঝামেলায়। কিনি যত সব হাবি-জাবি, কোনটা বাচ্চাদের দেই আর এক ধরণের অপরাধ বোধ পেয়ে বসে, কেননা না টাকাটা ওই জন্যে দেয়া হয় নি। এখন আগামী বছরের জন্য আবেদন করছি। আগে যেখানে বছরে দিতো মাত্র ৩ হাজার ডলার, এবার ১০ থেকে ৪০, অনেক ভেবে ১৫ তে রাখলাম। তার মধ্যে ৩ ট্র্যাভেল, বাকিটা ডিভাইস। ওরা জানতে চাইলো কি কিনবো। শুরু হলো সমস্যা। ভিক্টরকে বললাম, "কম্পিউটার দরকার?" ওর কথা, "যেটা আছে তা দিয়েই কাজ চলবে। আমার দরকার নেই।" কিছুতেই বুঝাতে পারি না, দরকার হোক না হোক কিনতে হবে, নইলে আর কখনো কিছু দেবে না। অনেক সময় এমন হয়, বাচ্চাদের ৫০০ টাকার আবদার রাখতে পারি না, অথচ ১ লক্ষ টাকার কম্পিউটার কিনে আনি। আর তখন হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হয় বৌ বাচ্চাকে।
বুদ্ধ বলেছিলেন, সুখী হতে চাও? নিজের চাহিদা কমাও।
আমি সুখী মানুষ। একটু ভালো বই পড়া, কিছু ভালো ছবি তোলা, ভালো পেপার লেখা - এর বাইরে তেমন কোনো কিছু চাওয়ার নেই। কিন্তু দেখি চাহিদা না থাকলে আজকের দুনিয়ায় পদে পদে সমস্যায় পড়তে হয়।
আচ্ছা সমস্যা কোনটা? চাহিদা না থাকা নাকি চাহিদা না থাকা মানুষগুলি?
মনে হয়, পরের টাই। কেননা ওরা বর্তমান বিজনেস কনসেপ্টের সাথে ঠিক মেলে না।
দুবনা, ২৫ অক্টবর ২০১৬
রাশিয়া জীবনের প্রথমে খেতাম মেস করে আনোয়ার আর জালালের সাথে, পরে শামীম শুভ সহ অনেকে মিলে একটা বড় ফ্যামিলি গড়ে ওঠে। রান্না করতো সবাই, আমিও করতাম যদিও দেশে চা'র বাইরে কিছু করার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। একদিন রাতে বড় ভাইরা এলো আজান দিতে, মানে রাতে খাবে বলে। ওদের প্ল্যান ছিল না, আমরাই পীড়াপীড়ি করে ধরে রাখলাম। রান্নার লঘু দায়িত্বে আমি। রান্না বসলো, অন্যদের দেখা দেখি আমিও মুরগি কেটে একটু ভেঁজে সমস্ত পদ্মা উজাড় করে জল ঢেলে এসে বসলাম সবার সাথে গল্পে। একটু পর যাই আর দেখে আসি রান্নার কত দূর? কিন্তু ব্যাপারটা কি? হাড়িতে যেন বানের জল, কমছেই না। যেন কেউ এসে একটু পর পর জল ঢেলে দিচ্ছে মুরগির ভেতর। এদিকে রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত মিন্টুদা ওটা দেখে এসে বললো, "কাল সকালেও এই মুরগি হবে না। অনেক ধন্যবাদ। আমরা বরং রুমে গিয়েই খাবো।" ওরা চলে গেলো, সাথে সাথে চলে গেলো আমার হেড কুকের চাকরিটা। অবশ্য পরে যখনই মেসে খাবারের বাড়ন্ত থাকতো আর আজানিদের সংখ্যা হাতের আঙ্গুল ছাড়িয়ে যেত, ঘোষণা করে আমাকে করা হতো হেড কুক। এ যেন ভীষ্মের সামনে শিখন্ডী। সবাই আমার রান্নার নাম শুনলেই শরতের ঝরা পাতার মতো কোথায় যে উবে যেত!
প্রথম বর্ষে মেস করি জালালের সাথে, মাসের প্রথমেই ওকে ১৫ রুবল দিয়ে আসতাম, খেতে তেমন যাওয়া হতো না, ক্যান্টিনে খেয়ে বা আজান দিয়েই চলে যেত দিন, তাই এক সময় বিরক্ত হয়ে জালাল আমাকে মেসের রাজ্য থেকে নির্বাসন দেয়। তার পরেই শুরু হয় এক চলার পালা। কখনো খাই ক্যান্টিনে, কখনো আহসান, বিমল, দিপু, রেজা - ওদের ওখানে। তবে বেশির ভাগই খেতাম রুমা-শাওন আর পরে রুমা-সুস্মির হেঁসেলে।
এখন একা থাকি। আমি নিজেই হেড কুক, নিজেই হেলপার, নিজেই খাবারের ভালমন্দের বিচারক। এখন ভলগা আমার পাশ দিয়ে বয়ে যায়, অনেক জল থাকলেও খাবারে জল কম দেই, তাই ওরা পুড়ে যায় প্রায়ই। রান্না করি প্রায় একই নিয়মে, একই মসলা, একই তেল। তবে একটা জিনিস বুঝে গেছি অনেক আগেই। রান্নাটা আসলে কোয়ান্টাম মেথডে হয়। মানে রান্নার আলজেব্রাটা নন-কমুটেটিভ। মানে যদি সাধারণ জীবনে ২ + ৫ = ৫ + ২, এখানে তেলের আগে মসলা দেবেন না মসলার আগে তেল - এর উপর খাবারের স্বাদ নির্ভর করে। আর যেহেতু তেল, লবন, হলুদ, মরিচ, আদা, পেঁয়াজ, মাংস সহ অনেক ইনগ্রেডিয়েন্ট থাকে, ওদের ফ্রাই প্যানে ছাড়ার অর্ডার চেঞ্জ করে একই জিনিস দিয়ে হাজার রকম স্বাদের (বিস্বাদের) খাবার তৈরী করা যায়।
দিন কাটছিলো চিন্তাহীন ভাবে, পড়াশুনা, ছবিতুলা আর বন্ধুদের (আচ্ছা ওরাও কি আমাকে তাই ভাবতো?) ডিস্টার্ব করে। আশির দশকের শেষ দিকে যখন অনেকেই ব্যবসা শুরু করলো, হাতে এলো কাঁচা পয়সা আর জিনিস পত্রের দাম গেলো বেড়ে, আগেরকার মত ওই সরল পথে সরল গতিতে চলা হলো কঠিন থেকে কঠিনতর। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় প্রায়ই ধার দেনা হতে লাগলো। একবার দিপু বললো ইস্তাম্বুল গিয়ে সোয়েটার আর জ্যাকেট এনে বিক্রি করতে। বললো, তুই গিয়ে নিয়ে আয়, বাকিটা আমরা করে দেব। গেলাম ইস্তাম্বুল, সারাদিন যখন ছবি তুলে কাটলো আর পরে মনে পড়লো কেনাকাটার কথা, দোকানপাট বন্ধের পথে। কোনো মতে কয়েকটা জ্যাকেট কিনলাম, দামী জ্যাকেট। এক দোকানে সোয়েটার কিনলাম, অনেক খোশ গল্প করলো দোকানদার। পরে মস্কো ফিরে দেখি সোয়েটারগুলো ডিফেক্টে ভরা। জ্যাকেট দেখে দিপু বললো - এগুলো লস ছাড়া বিক্রি করা যাবে না, হলো তাই, আমার ইস্তাম্বুল ভ্রমণ আমার ঘাড়ে ৭০০ ডলারের ঋণ চাপিয়ে দিলো। তাই পরে আবার সবাই মিলে পাঠালো সিঙ্গাপুর। আর তার পর থেকেই সিঙ্গাপুর থেকে জিনিস আনা হয়ে উঠলো কঠিন। খোরশেদ ভাই বললো, "অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়।"
এর পর আর কারো কথায় কোনো ব্যবসা সফরে আর যাইনি। ১৯৯৪ তে চলে আসি দুবনায়। শুরু হয় নতুন জীবন। আমার পদার্থবিদ হওয়া আর বিপ্লবী (?) হওয়ার পূর্বকাহিনী একই রকম। বিপ্লবের পথে দীক্ষিত হই মনি সিংহ, অনিল মুখার্জী ও অন্যান্য বিপ্লবীদের কথা পড়ে, যারা আদর্শের জন্য সব জাগতিক সুখ ত্যাগ করেছেন, শুধু মাত্র আদর্শ অর্জনেই খুঁজে পেয়েছেন জীবনের সব সুখ। একই ভাবে সত্যেন বোস, আইনস্টাইন - এদের কথা আমাকে পদার্থ বিদ্যায় দীক্ষিত করেছে, যারা জীবনে ছিলেন খুব সাদাসিধে। ১৯৮৩ তে দেশ ছাড়ার আগে পর্যন্ত কমরেডদের মধ্যে মণিদা আর পুরানো বিপ্লবীদের সরল জীবনের ছাপ দেখেছি। এখানে যখন আসি, দেখেছি আমাদের শিক্ষকদের, যারা সবাই খুব নামকরা বিজ্ঞানী, জীবনে সাধারণ, যারা জামা-কাপড়ের প্রতি ছিলেন উদাসীন। দুবনায় তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এমন কি ১৯৯৬ সালে যখন প্রথম ট্রিয়েস্ট যাই, সবাই মোটামুটি একই রকম ছিলেন। ট্রিয়েস্ট সফরের শেষ এক সেমিনারে অনেক আমেরিকান আসে - ওই প্রথম দেখলাম বিজ্ঞানীরাও ফ্যাশন করে, তারাও অনেক দামী জামা কাপড় পরে।
আসলে সমস্যা এখানে নয়। গত প্রায় দশ বছর আমার একটা প্রজেক্ট আছে, যা থেকে কম্পিউটার ইত্যাদি কেনার জন্য বেশ কিছু টাকা পাই। ডলারের দাম বাড়ায় টাকার পরিমান বেড়ে গেছে, তাই জিনিস কেনা যায় বেশি। সমস্যা হলো কম্পিউটার তো আর ভাত নয়, প্রতিদিন নতুন লাগবে বা জামা-কাপড় যা মাঝে মধ্যে বদলানো যায়। ৩ বছরের মাথায় যখন কম্পিউটার, প্রিন্টার সহ যা আমার কাজে লাগে সব কিছুর আপডেট হয়ে গেলো, পরলাম এক বিরাট ঝামেলায়। কিনি যত সব হাবি-জাবি, কোনটা বাচ্চাদের দেই আর এক ধরণের অপরাধ বোধ পেয়ে বসে, কেননা না টাকাটা ওই জন্যে দেয়া হয় নি। এখন আগামী বছরের জন্য আবেদন করছি। আগে যেখানে বছরে দিতো মাত্র ৩ হাজার ডলার, এবার ১০ থেকে ৪০, অনেক ভেবে ১৫ তে রাখলাম। তার মধ্যে ৩ ট্র্যাভেল, বাকিটা ডিভাইস। ওরা জানতে চাইলো কি কিনবো। শুরু হলো সমস্যা। ভিক্টরকে বললাম, "কম্পিউটার দরকার?" ওর কথা, "যেটা আছে তা দিয়েই কাজ চলবে। আমার দরকার নেই।" কিছুতেই বুঝাতে পারি না, দরকার হোক না হোক কিনতে হবে, নইলে আর কখনো কিছু দেবে না। অনেক সময় এমন হয়, বাচ্চাদের ৫০০ টাকার আবদার রাখতে পারি না, অথচ ১ লক্ষ টাকার কম্পিউটার কিনে আনি। আর তখন হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হয় বৌ বাচ্চাকে।
বুদ্ধ বলেছিলেন, সুখী হতে চাও? নিজের চাহিদা কমাও।
আমি সুখী মানুষ। একটু ভালো বই পড়া, কিছু ভালো ছবি তোলা, ভালো পেপার লেখা - এর বাইরে তেমন কোনো কিছু চাওয়ার নেই। কিন্তু দেখি চাহিদা না থাকলে আজকের দুনিয়ায় পদে পদে সমস্যায় পড়তে হয়।
আচ্ছা সমস্যা কোনটা? চাহিদা না থাকা নাকি চাহিদা না থাকা মানুষগুলি?
মনে হয়, পরের টাই। কেননা ওরা বর্তমান বিজনেস কনসেপ্টের সাথে ঠিক মেলে না।
দুবনা, ২৫ অক্টবর ২০১৬
Comments
Post a Comment