ইনারভিউ



গত বৃহস্পতিবার সকালে ভ্রমর ফোন করলো অস্ট্রেলিয়ার সিডনী থেকে। ভ্রমর আমার সুধীরদার একমাত্র মেয়ে। অস্ট্রেলিয়ায় মাইগ্রেট করেছে বছর দশেক আগে। ওখানে দুই ছেলেকে নিয়ে তপন আর ভ্রমরের চার জনের ছোট সংসার। গত বছর ডিসেম্বরে সবাই এক সাথে দেশে বেড়াতে গেলে ১৯৯৭র পর ভ্রমরের সাথে দেখা, পরিচয় তপন আর ওদের দুই ছেলে ঈশান আর ঈরেশের সাথে। তবে ফেসবুক, ইমো আর ভাইবারের কল্যানে দেখা না হলেও ওদের সাথে যোগাযোগ হয় রেগুলার। তাই সেদিনের কল আসা ছিল মামুলি ব্যাপার। তবে যেটা অস্বাভাবিক সেটা হোল, ভ্রমর কেমন আছো জিজ্ঞেস করেই বলল, ঈশান তোমার সাথে কথা বলতে চায়। এবার আমার অবাক হবার পালা। ঈশান একটু ইনট্রোভার্ট, কথা কম বলে। আমি ভাবছি  হয়তো এটা বুঝতে পেরে ভ্রমর বলল,
-   ঈশান তোমার ইন্টারভিউ নেবে।          
-   তাই! ঠিক আছে। দে ওকে।
আমি বললাম বটে, তবে ভাবনাটা আরও বেড়ে গেলো। ইন্টারভিউ দেবার অভ্যেস তো নেই। এর আগে যা দুএকটা দিয়েছি, তাও দুবনার পত্রিকায় আর মস্কোর এক জার্নালে – ফটোগ্রাফির উপর। ওগুলোকে ইন্টারভিউ না বলে বরং বন্ধুদের সাথে মন খুলে গল্প করা বলা চলে। দেশেও বার দুয়েক ইন্টারভিউ দেবার চেষ্টা করেছি, শেষ পর্যন্ত সেটা হয়েছে কি না সেটা আমার জানা নেই। এর একটা ছিল ২০১২ সালে প্রথম আলোর অফিসে। জাহীদ রেজা নূর কথা বলতে ডেকেছিল। বেশ কিছুক্ষন গল্পগুজব করার পর বললো এটা ইন্টারভিউ হিসেবে প্রকাশ করবে। তবে যেহেতু দেশে থাকি না আর প্রথম আলো রেগুলার দেখা হয় না, সেই ইন্টারভিউ-এর ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা জানা নেই। আরেকবার একজন ইন্টারভিউ নিতে চাইলো ২০১৪ সালে। সময় দিতে না পারায় প্রশ্ন পাঠিয়েছিলো, লিখিত উত্তর পাঠিয়েছিলাম কয়েকদিন পরে। প্রথম আলোর মত সেটার খবরও জানা হয়নি। তাই ইন্টারভিউ দেবার অনেকটা জেরো অভিজ্ঞতা নিয়ে ঈশানের মুখোমুখি হলাম। এখানে আরেকটা সমস্যা ছিল। ঈশান বাংলা ভালো পারে না। অন্যদিকে ওর অস্ট্রেলিয়ান ইংলিশের সব কিছু আমি বুঝি না। ভাবলাম, আট বছরের এই বাচ্চাটার কাছে এখন নাস্তানাবুদ না হই। যাই হোক, এখন আর পেছনে ফেরার উপায় নেই। দাদু বলে কথা।
-   কি খবর তোমার ঈশান? ভালো আছো?
-   ভালো। টুমি ক্যামন আছো?
-   আমি ভালো আছি। তুমি কি কিছু জানতে চাচ্ছো?
-   হ্যাঁ। Where did you live when you were eight?
ওর eight উচ্চারণ একটু অন্যরকম। তাছাড়া আট বছর বয়েসে আমি কোথায় বাস করতাম এটা তো ভ্রমর নিজেই জানে। একটু খটকা লাগলো। তাই আবারো প্রশ্নটা রিপিট করতে বললাম। তারপর এক এক করে প্রশ্ন আসতে লাগলো। আমি চলে গেলাম একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে। যুদ্ধের পর এক দিকে বাড়ি ফেরার আনন্দ, অন্য দিকে লুট হয়ে যাওয়া ঘরদোর আর অনেক পরিচিত মানুষের ফিরে না আসার বিষাদ।
-   আমি তরা ছিলাম, বাবামা আর ভাইবোনদের সাথে, তোমার দাদুর সাথে।
-   তখন তোমার কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল? কি নাম ছিল তার?
বাদলের নাম বলতে গিয়ে মনে হোল তখন তো আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল মন্টু। পরে ওর সাথে ঝগড়া, কথাবলা বন্ধ, যা দেশত্যাগের আগে পর্যন্ত ছিল। না, এত ছোট এক বাচ্চা ছেলে ইন্টারভিউ নিচ্ছে, ওকে তো মিথ্যে বলা যায় না। তাই বললাম
-   হ্যাঁ, ছিল তো। ওর নাম ছিল মন্টু, ভালো নাম মনতোষ।
-   তোমার কোন ফেভারিট টয় ছিল?
-   আমরা তো খেলতাম মার্বেল, ডাংগুলি এই সব।
বলতে বলতে মনে পড়ে গেলো ছোট্ট হলুদ সেই গাড়িটার কথা। যুদ্ধের পর বিদেশ থেকে সাহায্য হিসেবে পাওয়া। মনে হোল, আমি যেন এখনও বসে বসে ঐ গাড়ি নিয়ে খেলছি।
-   আর ছিল একটা ইয়েলো কার।
-   তুমি এক্সট্রাকারিকুলাম ওয়ার্ক করতে?
-   হ্যাঁ, বর্ষায় আমরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বাঁশ তুলে সাঁকো তৈরি করতাম, রাস্তায় মাটি ফেলতাম।
-   বাড়িতে কী ডিউটি ছিল তোমার?
-   পড়াশুনা করা।
-   আমি বলছিলাম এর বাইরে।          
এবার আমার লজ্জা পাবার পালা। ঐ সময়ে বাড়িতে আমার অন্য কাজ ছিল না। তবে বৃষ্টি নামলে জামাকাপড় উঠানো বা ধান বা পাট ঘরে তুলা – এসব কাজে সাহায্য করতাম। তাই বললাম
-   তেমন কিছু ছিল না, তবে দরকারে বাবামা, ভাইবোনদের কাজে সাহায্য করতাম।
-   তোমার সময়ের আট বছর আর এখনকার আট বছরের বাচ্চাদের মধ্যে কি কোন মিল আছে?
-   খুব কষ্ট বলা। শুধু মাত্র আট বছর বাদে আর কোথাও মিল আছে বলে মনে হয় না। আসলে বর্তমানের আট বছরের বাচ্চাদের যা আছে, সেটা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। তবে হ্যাঁ, তখনও আট বছরের বাচ্চারা তোমাদের মতই খেলতে পছন্দ করতো, তোমাদের মতই কৌতূহলী ছিল, তোমাদের মত তারাও সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতো।
ঈশান সব মিলিয়ে কুঁড়িটি প্রশ্ন করে। সেগুলো আমার সাংবাদিক বন্ধুদের প্রশ্নের মত কঠিন বা জ্ঞানগর্ভ ছিল না। সেগুলো ছিল সহজ সরল। আর সরল বলেই এত কঠিন। সাংবাদিকদের কঠিন প্রশ্নের জবাব আরও কঠিন ভাবে দেয়া যায়, প্রয়োজনে একটু বানিয়েও বলা যায়, তবে বাচ্চাদের কাছে মিথ্যে বলা যায় না। তাই ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বার বার ফিরে যেতে হয়েছিলো ১৯৭২এ, যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে, স্মৃতির উপর জমে থাকা পুরু ধূলার স্তর সরিয়ে খুঁজতে হচ্ছিলো সহজ কিন্তু সঠিক উত্তর। ঈশানের জন্য এটা ছিল ইন্টারভিউ, আর আমার জন্য ইনারভিউ।

দুবনা, ১৫ জুলাই ২০১৭     


                      

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি