সেভার অ্যামেরিকান ড্রিম
গত শনিবার মানে ২২ জুলাই ২০১৭
গেলাম বলশয় ভোল্গার খোলা বাজারে। ওখানে এখন যাই কালেভদ্রে, মূলত বাবুশকা মানে স্থানীয়
বুড়ীদের কাছ থেকে তাদের নিজেদের বাগানের শশা, টমেটো আর বিভিন্ন বেরি কেনার জন্য। এছাড়া আরও কয়েক
জায়গায় ওনারা বসেন – ভোল্গার অন্য পাড়ে বিশাল এক বাজারে আর আমাদের বাড়ির কাছেই
পেরেক্রেস্তক আর রাশিয়ানিন দোকান দুটোর সামনে। তবে নদীর অন্য দিকে যাওয়া সময়
সাপেক্ষ আর অন্য দুই জায়গায় দাম বেশি। তাই আমি সাধারণত এসব কিনতে বলশয় ভোল্গার খোলা বাজারেই
যাই। ১৯৯৬ সালে
গুলিয়া যখন আন্তন আর মনিকাকে নিয়ে দুবনা আসে এখানে থাকবে বলে – তখন থেকেই ওখানে
যাওয়া শুরু। ঐ সময় ক্যাপিটালিজম মস্কো বা অন্য কিছু বড় শহরের বাইরে তেমন যায়নি। তাই ১৯৯৪ সালে
মস্কো ছেড়ে যখন দুবনা আসি কাজ করতে, মনে হয়েছিলো যেন আবার সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরে
এলাম। রাস্তাঘাট
তেমনি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, লোকজন কথায়বার্তায় সেই সময়ের মতই বিনয়ী আর পন্যের অভাবে
অপুষ্টিতে ভোগা বিশাল বিশাল দোকান সব। তাই ঐ বাজারই ছিলো অন্ধের যষ্ঠী। তাছাড়া সময় ছিলো উত্তাল। মুদ্রাস্ফীতির
ধাক্কায় দিনকে দিন চুপসে যাচ্ছিলো আমাদের মত সাধারণ মানুষ। বাজারে আসাযাওয়ার যে পথটা বনের ভেতর
দিয়ে চলে গেছে, আমরা সেখান দিয়ে শুধু যেতামই না, কুড়াতাম মাশরুম আর বুনো ফল। তাই ঐ
দিনগুলোতে বন শুধু আমাদের নির্মল বাতাসই যোগাতো না, যোগাতো খাবারও। তাই এখনো সুযোগ
পেলেই যাই ওদিকে আর মনে মনে ভাবি সেই সব দিনগুলোর কথা – জীবনকে ভালবাসার কথা।
ইদানীং ওদিকে যাওয়ার আরও একটা
কারন এই সুযোগে সেভার সাথে একটু ঘোরা। আগে ও বাসায় থাকতে চাইতো না। সারাদিন ফুটবল নিয়ে পরিচিত
অপরিচিত সবার সাথে খেলতো। এখন একটু বড় হয়েছে। পরিচিত ছাড়া কারো সাথে মিশতে চায় না। এমন কি আমি যখন
ভোল্গায় যাই ঘুরতে বা সাতার কাঁটতে তখনও যেতে চায় না। বাজারে যায়, যেতে হয় – কারন বলে
দিয়েছি – আমার পিঠে ব্যথা, কিছু কিনলেও টানতে পারবো না। তাই ভারী কিছু থাকলে আন্তন বা
সেভা যায়।
- পাপ, গত কয়েকদিন স্বপ্ন দেখছি আমাদের প্রচুর টাকা হয়েছে।
আমি মনে মনে ভাবি, দুদিন আগে
লটারির টিকেট কিনলাম, এ তার জেতার সঙ্কেত কি না কে জানে।
- তাই? তা কোত্থেকে এলো টাকাগুলো।
- জানি না। তারপর দেখলাম পুলিশ তাড়া করছে। আমিও সে কী দৌড়। পুলিশ ধরতে
পারেনি।
- ব্যাঙ্ক ডাকাতি?
- না। আসলে গত কয়েক রাত অনেক অ্যামেরিকান মুভি দেখলাম। মনে হয় এজন্যে।
- কে জানে? হয়তো বা তাই।
- তোর মনে আছে এই বাজারের কথা? আগে আসতাম এদিকে।
- খুব একটা মনে নেই। তবে কয়েকদিন আগে আমি আর স্তেপা এসেছিলাম এদিকে হাঁটতে
হাঁটতে।
- স্তেপা কবে আসবে? তুই তো এখানকার ছেলেদের সাথে মিশলেই
পারিস। তোর সাথে যারা
কেজিতে যেতো, ওদের নম্বর যোগার করে দেবো তোকে?
- দরকার নেই। স্কুলে যাওয়া শুরু করলে এমনিতেই আলাপ হবে।
- তাই বলে সারাদিন ঘরে বসে থাকবি? ভোল্গার পাড়ে কত
ছেলেমেয়ে ঘুরে বেরায়, ওদিকে গেলেই তো পারিস। সাঁতার কাটতে পারিস।
- আমার ভালো লাগে না। দেখ না আমার হাতগুলো কত সরু!
- আমার হাতও ঐ রকম। নিজেকে ভালবাসতে হয়। এতো কমপ্লেক্স কেন তোর?
এটা এক নতুন সমস্যা। আমারও এক সময়
নিজেকে খুব রোগা মনে হতো। এরপর যখন লেনিন লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়াশুনা করতে শুরু করি, দেখি কত লোক -
কারো মাথায় চুল নেই, কেউ খোঁড়া, কেউ চোখে তেমন দেখে না। এর পর থেকে আমি আর কখনও আমার
শরীরের গড়ন নিয়ে ভাবি না। কেউ কিছু বললে বলি, বাবা মা এটা স্পেশাল অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়েছিলেন,
যেমনটা দেশে আমার কাঁচাপাকা চুল নিয়ে কেউ কিছু বললে বলি এটা স্পেশালি রঙ করা। তবে এটা বলে বোঝানো
যায় না, নিজের জীবন থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে এসব কমপ্লেক্স থেকে মুক্তি পেতে হয়।
বাজার থেকে সাপটা ব্যাঙটা কেনার
পর বাড়ি ফিরছি।
- যাই বল, রাশিয়াতে সব কেমন যেন অন্য রকম। অ্যামেরিকায় সব
অনেক ভালো। জার্মানিতে আরও ভালো।
সেভা গত কয়েক দিনে দ্বিতীয় বারের
মত এটা বললও। শুক্রবার গুলিয়া এসেছিল ঘণ্টা দুয়েকের জন্য। তখনও এই কথা। এটা আমাদের
কাছে নতুন। বাড়িতে রাজনীতি নিয়ে কথা বললেও এসব কখনও বলা হয় না।
- তাই? কে বললো রাশিয়াতে সব অন্য রকম। তুই তো বাইরে কোথাও যাসনি।
- নাভালনি বলে। বলে এ দেশে দুর্নীতি প্রচুর।
- তা ঠিক। তবে নাভালনি নিজেও যে গঙ্গা জলে ধোঁয়া তুলসী পাতা, তা
কিন্তু নয়। তা ছাড়া ও এটা বলে ক্ষমতায় যাবার জন্য। একবার ওখানে গেলে দেখবি দুর্নীতি
নিয়ে কথা বলবে না। সারা পৃথিবীতেই এমন।
- আমারও তাই মনে হয়।
এটাও নতুন খবর। ইদানিং নাভালনিরা
স্কুলের বাচ্ছাদের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি করতে চাইছে। ১২ জুন
এমন একটা প্রচেষ্টা করেছে মস্কোর সেন্টারে।
- যাক, এসব কথা শুনে কিছু করার আগে আমাকে বলিস। ওরা তোদের ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার
করতে চায়।
- আমার মনে হয় অ্যামেরিকায় নিয়মকানুন এতো কড়া নয়। ফিল্মে দেখলাম
এক লোক ৭ মিলিয়ন ডলার চুরি করলো, তাতে সাজা পেলো মাত্র তিন বছরের জেল।
- অ্যামেরিকায় আইন বিভিন্ন রকম। তবে আইনের ভেতরে থেকেই অনেক কিছু
করার সুযোগ আছে। কিন্তু আইন ভাংলে ওখানে শাস্তিও
কঠিন। যে দেশ যত
উন্নত সে দেশে জীবনে সফল হবার পথে
বাধানিষেধ তত কম। তবে যেটুকু আছে, তার প্রয়োগ খুব কড়া। এই ধর তৃতীয় বিশ্বের
দেশগুলোর কথা। সেখানে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত আছে। কিন্তু
পরিচিতদের মধ্যে কেউ হোমরাচোমরা থাকলে অনেক গুরুতর অপরাধ করেও মানুষ পার পেয়ে যায়,
আবার অনেক সময় সামান্য অপরাধে কঠিন শাস্তি ভোগ করে। কিন্তু ইউরোপ অ্যামেরিকায় এমনটা
কম হয় যদিও অ্যামেরিকায় প্রায়ই পুলিশের গুলিতে অকারনে অনেকে মারা যায়।
- হ্যাঁ, আমি সেটাও জানি। তারপরেও মনে হয় ইউরোপ বা
অ্যামেরিকায় যারা আছে, আমাদের চেয়ে ভালো আছে। ও সব দেশে লোকজন অনেক বেশি বেতন পায়।
- সেটা ঠিক। তবে এটাও ঠিক - ভালো থাকাটা খুব কঠিন, মানে
ভালো থাকার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। চাইলে তুইও ভালো থাকতে পারিস। তবে এ
জন্যে অনেক পড়াশুনা করা দরকার।
হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি
বাসার কাছে।
- পাপ, অ্যামেরিকায় বাড়ির দাম অনেক?
- জানি না, তবে যে বেতন পায়, তাতে অধিকাংশ মানুষই বাড়ি
কিনতে পারে।
- মস্কোর বাসা বিক্রি করে ওখানে বাড়ি কেনা যাবে না?
- যাবে হয়তো। তবে বাড়ি থাকলেই তো শুধু হবে না। খেতে পড়তে
হবে। তার জন্য কাজের দরকার। আর ভালো কাজ পেতে হলে ভালো পড়াশুনা করা দরকার। এখনও
সময় আছে। ভালো পড়াশুনা কর। রাশিয়া থেকে ভালো ছাত্রদের ওরা ডেকে নিয়ে যায়।
বাসায় এসে জিনিষপত্র রেখে বাজারে
কেনা চেরিগুলো ধুয়ে সেভাকে খেতে দিলাম। ও আবার এসে হাজির।
- পাপ, আমি যদি অ্যামেরিকায় বাড়ি কিনি তুমি থাকবে তো আমার
সাথে?
- আমি অ্যামেরিকায় গেলে কাজ করবে কে? আমার কাজ আছে না?
- আমি যখন যাবো, তুমি তো পেনশনে যাবে, কাজ করতে হবে না
তোমাকে।
- নারে। কাজ ছাড়া আমার চলবে না। আমি তো শুধু বেতনের জন্যে
কাজ করি না, কাজ করি কাজকে ভালবাসি বলে। তুই বরং মাকে নিয়ে যাস।
- মাকেও নিয়ে যাবো। তুমিও যাবে।
- ঠিক আছে, আগে বাড়ি হোক, তারপর দেখা যাবে।
পরের দিন, মানে রবিবার গুলিয়া
এলো। ওকে বললাম সেভার গল্প। নাভালনির কথা।
- যদি বাবা মা সন্তানদের সাথে কথা না বলে, ওরা নাভালনিদের
কথাই শুনবে। তোমার ওর সাথে মাঝেমধ্যেই কথা বলা দরকার।
- বলবো না কেন, বলি তো। তবে জানোই তো আমি সাধারণত প্রশ্নের
উত্তর দেই। সেভা আমাকে এখন অনেক সাহায্য করে। বাজারে গেলে জিনিষপত্র নিয়ে আসে। এমন
কী ঠিক করেছি আমি ওর প্লেট ধোব, আর ও ঘর ঝাড়ু দেবে।
- করে?
- হ্যাঁ। তবে সব ধুলোবালি জড়ো করে দরজার ওখানটায় রেখেছে। কিছুদিন
পরে সব ঠিকঠাক করে করবে।
এ ক’দিন এ নিয়ে সেভার সাথে আর কথা
হয়নি। গতরাতে মাথা ব্যথা ছিলো, তাই রাত একটার দিকেই ঘুমিয়ে পড়েছি। সকালে উঠেই
কন্টাক্টে দেখি সেভার ম্যাসেজ
“পাপ, আমি ইংরেজি শিখতে চাই।
ইংরেজিতে কথা বলতে শিখতে চাই।“
অফিস থেকে যখন বাসায় ফিরলাম, সেভা
এলো আইকার (সেভার কুকুর) সাথে আমার ঘরে।
- পাপ!
- কি হোল?
- ইংরেজি!
- ঠিক আছে, বই বের করে দেবো। যদি না বুঝিস, জিজ্ঞেস করিস।
- না, আমি চাইছি এখন থেকেই প্র্যাকটিস করতে।
- ভালো তো। তা তুই আমাকে যা বলতে চাস, যেটুকু পারিস, ইংরেজিতে
বলিস। আর ইংরেজিতে সিনেমা দেখিস।
- ওকে, আই উইল ডু। বাট আই নীড ইওর হেল্প।
- সিওর। জানিস না, বলে “একটা পেশা আছে – জন্মভূমিকে ভালবাসা।“
এ রকম আরও একটা পেশা আছে – বাবা হওয়া। আমার কাজই তো তোকে, তোদেরকে হেল্প করা।
যাক। এই উছিলায় যদি পড়াশুনাটা
শুরু করে। শেষ পর্যন্ত সেভাটাও বড় হয়ে যাচ্ছে।
দুবনা, ২৭ – ২৮ জুলাই
২০১৭
Comments
Post a Comment