গুজবের আলখেল্লায় সত্যের দিনকাল


কয়েকদিন আগে লিখেছিলাম, “আমাদের সত্যের সন্ধান অনেকটা অন্ধের হাতী দর্শনের মত। আমরা যেকোনো ঘটনাই নিজ নিজ অ্যাঙ্গেল বা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করে সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে চাই। এর ফলে সত্যটা যে আংশিক হতে পারে সেটা মানতে চাই না কোন মতেই। বাংলাদেশে এখন কিশোর কিশোরীদের আন্দোলন চলছে। এখানে যে ব্যাপারগুলো নিয়ে কারো কোন সন্দেহ নেই সেগুলো হল বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে দুই কিশোর কিশোরীর মৃত্যু, এক মন্ত্রীর অমানবিক হাসি আর পরবর্তীতে নিরাপদ সড়কের দাবীতে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন। এই মৃত্যুতে সবাই শোকাহত। মন্ত্রীর হাসি নিন্দিত হয়েছে সব মহলেই আর সব মহল থেকেই কিশোর কিশোরীদের এই দাবী পেয়েছে নিঃশর্ত সমর্থন। যতদূর শুনেছি সরকার এই দাবীগুলো মেনে নিয়েছে এবং তাদের ঘরে ফেরার অনুরোধ করেছে। এর বেশি কিছু আশা করা আর যাই হোক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয় না। মনে রাখতে হবে এসব জয় ফুটবল বা ক্রিকেট মাঠের জয় নয় যে সাথে সাথেই ফল পাওয়া যাবে। যে দাবীগুলো তারা তুলেছে সেটা পূরণ করা এক দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। সমাজ বা দেশ নিজের ইনারশিয়ায় চলে, যেকোনো পরিবর্তন শুরু হলে তার ফল পেতে পেতে অনেক দিন চলে যায়। তাই সে সময়টা সবাইকে অপেক্ষা করতেই হবে।
তারুণ্য শধু শক্তিই নয়, তারুণ্য সারল্যও বটে যাকে অন্যেরা সহজেই নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি আন্দোলনেই তাই ঘটেছে শুধুমাত্র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনগুলো ছাড়া। সবাই চেষ্টা করেছে এই আন্দোলনকে নিজেদের পক্ষে আনতে। ভালুক মরার আগেই শুরু হয়েছে মৃত ভালুকের চামড়ার ভাগ বাটোয়ারা। আর তা করা হয়েছে এইসব কিশোর কিশোরীদের কাঁধে বন্দুক রেখে, তাদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। ফলাফল – যে মৃত্যুকে রোধ করতে এত আয়োজন, সেই মৃত্যুই যেন অন্য বেশে হাঁটছে আমাদের পাশেপাশে।
গত কয়েকদিন ইন বক্সে আসছে একের পর এক ভিডিও। আসছে সংবাদপত্রের লিঙ্ক। একদল চেষ্টা করছে আন্দলনের পেছনে বিএনপি, জামাত, বামের প্রেতাত্মা দেখাতে, অন্য দল কিশোর কিশোরীদের উপর সরকার ও ছাত্রলীগের কর্মীদের অমানবিক অত্যাচারের কথা বলছে। এর কোনটা গুজব আর কোনটা সত্য সেটা বুঝে ওঠা কষ্ট। তবে সত্য আর গুজব যাই হোক, যেটা আমার বেশি মনে হয়েছে তা হল নিরাপদ সড়ক আর কেউ চাইছে না, সবাই চাইছে এই সুযোগে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে। এ এক ভয়াবহ অবস্থা। এমনকি কোন সংবাদ যখন ভুল বলে প্রমাণিত হচ্ছে তখনও নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য সেই সংবাদ প্রচারকারী লোকজন বিভিন্ন অজুহাত দাড় করাচ্ছে। এ যেন গল্পের সেই নেকড়ের মত “তুই ভাটিতে দাঁড়িয়ে জল ঘোলা করিসনি তা ঠিক, তবে তোর বাবা কয়েক বছর আগে করেছিল।“ এটাও আমাদের দেশের মধ্যযুগীয় মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। বিজ্ঞানের মুল কথা হল “আমি জানি না, সত্যকে জানতে চেষ্টা করি।“ ধর্ম বলে ”আমি সব জানি।“ তাই হাতে স্মার্টফোন, আইফোন যাই থাকুক, নিজেদের যতই মডার্ন ভাবি না কেন, এসব ক্রিটিক্যাল সময়ে আমাদের সবার ব্যবহার হয় ডগ্মাটিক। আমরা ভুলে যাই যতই পরস্পরের বিরোধী হই না কেন একটা জায়গায় আমাদের ঠিকই মিল আছে। সেটা হল বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশকে ঘিরেই আমাদের যত রাজনীতি। তাই পরস্পররের মধ্যে যদি বিশ্বাসের কোন জায়গাই না থাকে তাহলে ব্যবসাটা চলবে কেমনে? দেশ তো আর বাপদাদার সম্পত্তি নয় যে পছন্দ না হলে নিজের নিজের অংশ নিয়ে ভিন্ন হয়ে যাব? আমাদের বুঝতে হবে আমার সত্যটাই একমাত্র সত্য নয়, আমার পথটাই একমাত্র পথ নয়। সব যুদ্ধেরই শেষ হয় শান্তি চুক্তির অথবা প্রতিপক্ষকে সমুলে নির্মূল করার মাধ্যমে। দ্বিতীয় পথ বর্তমান বিশ্বে গ্রহণযোগ্য নয়, তাই প্রথমটাই একমাত্র অপশন। খুব বেশি দেরি হওয়ার আগেই সবাই যে যার জায়গা থেকে সন্তানদের (দুঃখজনক হলেও সত্য কথা হচ্ছে অন্যদের সন্তানদের নিয়ে, নিজেদের সন্তানরা তো এই পোড়া দেশে বাস করে না) ঘরে ফেরাবেন আর একযোগে শুধু সড়কই নয় রাজনীতির চলার পথও নিরাপদ করবেন এ আশা করি। এর বেশি আর কিই বা চাইতে পারে দেশের সাধারণ মানুষ।

দুবনা, ০৫ আগস্ট ২০১৮              



                             

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি