শোক হোক শক্তি
আজ ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের জাতীয় শোক
দিবস আর একই সাথে ভারতের স্বাধীনতা দিবস। সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী হলেও দুটো ঘটনা একই
সুতোয় বাঁধা। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ না হলে আদৌ কি বাংলাদেশের জন্ম হত, অবিভক্ত
বাংলায় শেখ মুজিব কি হতে পারতেন সমস্ত বাঙ্গালির অবিসংবাদী নেতা? সে কথায় না গিয়ে
এখানে ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট নিয়ে দুটো কথা বলব।
এখনো চোখের সামনে ভাসে সেই দিনটির
ঘটনা। আমি তখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র। প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফেরার সময় বাজারে এ খবর
শোনা, অবিশ্বাস আর পাগলের মত দৌড়ে বাড়ি ফেরা যদি বিবিসি বা আকাশবানী অন্য খবর দেয়।
না, ওরা নতুন কিছু বলেনি। সারা বাড়িতে নেমে এসেছে বিষণ্ণতার ছায়া।
এখন মাঝে মধ্যে ভাবি কেন এমন হল? কোথায়
কি ভুল হয়েছিল? ১৫ আগস্ট শুধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা
হয়েছিল বাংলাদেশকে। হ্যাঁ, বাংলাদেশকে যাকে স্বাধীন করতে মাত্র চার বছর আগে বাংলার
তিরিশ লাখ মানুষ প্রান দিয়েছে আর ইজ্জত হারিয়েছে দুই লক্ষ মা ও বোন। অবিভক্ত ভারত ভেঙ্গে
পাকিস্তানের জন্মে শেখ মুজিবসহ তৎকালীন অনেক নেতারাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করেন নতুন দেশে এই এলাকার মানুষ অনেক সুখে শান্তিতে থাকবে এই আশায়। তবে পাক সরকার
উর্দুকে এক মাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার ঘোষণা দেওয়ায় খুব অল্প দিনের মধ্যে তারা বুঝতে
পারেন যে সে আশার গুড়ে বালি। এর পরের ইতিহাস বাঙ্গালির গৌরবের ইতিহাস। বাঙ্গালির
স্বপ্ন দেখার কাহিনী, সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নে তার লড়াই সংগ্রামের জয়গাথা। আর
বাঙালির এই স্বপ্নের রাজপুত্র ছিলেন শেখ মুজিব। তাইতো ১৯৭১ সালে শুনি
মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে
যুদ্ধ করি
মুজিব বাইয়া যাও রে নির্যাতিত
দেশের মাঝে জনগণের নাও (আচ্ছা সেই নাও কি এখনো জনগণেরই আছে?)
তাই একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর যে
বাংলাদেশ জন্ম নেয় সেটার সাথে শেখ মুজিবকে আলাদা করার সুযোগ খুব কম। তাঁর মৃত্যু
মানে বাংলাদেশের মৃত্যু, অন্তত যে স্বপ্ন বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার
মজুর, বাংলার মানুষকে তিনি দেখিয়েছিলেন সেই স্বপ্নের মৃত্যু। মানে আমার আপনার
আমাদের অনেকের মৃত্যু। কিন্তু কেন?
কয়েকদিন আগে মশিউল আলম ববির “পাকিস্তান”
উপন্যাস পড়লাম। ওখানে ওর পাকিস্তানী রুমমেটের সাথে কথা প্রসঙ্গে জানা যায় আমরা
যেটাকে মুক্তিযুদ্ধ বলি ওর রুমমেট মানে পাকিস্তানী ছেলে সেটাকে বলে গৃহযুদ্ধ। আমাদের মনে রাখতে হবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে
পরবর্তী রাজনৈতিক শাসন পদ্ধতি বা অন্যান্য অনেক প্রশ্নে মতবিরোধ থাকলেও দেশের শাসন
যে ভারতীয়দের হাতেই আসতে হবে এ নিয়ে কংগ্রেস বা মুসলিম লীগের কোন দ্বিমত ছিল না।
আন্দোলন বলি, সমঝোতা বলি ব্রিটিশরা এ দেশ ত্যাগ করবে, শাসন যন্ত্র ভারতীয়দের হাতে
তুলে দেবে সেটা ছিল জলের মত পরিষ্কার। কিন্তু পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আলাদা হওয়ার
ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন। প্রথমত একাত্তরের সাতই মার্চের আগে পর্যন্ত স্বায়ত্ত্ব
শাসনের কথা উঠলেও স্বাধীনতার কথা আসেনি কখনও। ২৫ মার্চের কালো রাতে বাঙ্গালির উপর
চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিয়েছে তারা শেখ মুজিবকে সামনে রেখে। সাধারণ
মানুষ রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝত না, তারা বুঝত শেখ মুজিবকে, তারা বিশ্বাস করত তাদের
নেতাকে যে তাদের শত বাধা বিপত্তি পার করে সঠিক ঠিকানায় নিয়ে যাবে। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ শুধু যে পশ্চিম পাকিস্তানের
বিরুদ্ধে ছিল তাই নয়, এ যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের ভিত্তি দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে।
যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একাংশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে আলবদর
রাজাকার সেজে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি
সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়। পরাজিত পাক বাহিনী এ দেশ
ত্যাগ করে বটে তবে তাদের দোসররা এখানেই থেকে যায়। আর যেহেতু তাদের জন্য এটা ছিল
গৃহযুদ্ধ, পরবর্তীকালে তারা তাদের বাংলাদেশ বিরোধী কাজ ঠিকই করে যায়। বঙ্গবন্ধু
তার স্বভাবসুলভ উদারতায় সমস্ত বাঙ্গালিদের ভালবাসতেন। যুদ্ধ পরবর্তী দেশে নিজের
নিরাপত্তার দিকে নজর দেননি। যেহেতু তিনি গৃহযুদ্ধ তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না, তিনি
সমাজের এ সমস্ত এলিমেন্টের হাত থেকে নিজেকে নিরাপদ দুরত্বে রাখার চেষ্টা করেন নি
এবং শেষ পর্যন্ত পারেনও নি। তাই আজও অনেক রাজনৈতিক দলই বাংলাদেশের বাস্তবতা মন
থেকে মেনে নিতে পারে না। তাদের ক্ষমতার লড়াই তাই প্রায়ই গৃহযুদ্ধের রূপ ধারণ করে।
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হল আজ তারা শুধু চিহ্নিত মৌলবাদী দলগুলোতেই নয়, স্বাধীনতার
পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও ঢুকে গেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় তারা
দেশ বিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা যদি একাত্তর ও একাত্তর পরবর্তী
সময়ের সঠিক মূল্যায়নে ব্যর্থ হই, সমাজের স্তরে স্তরে লুকিয়ে থাকা যে বাংলাদেশের জন্য
ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রান দিয়েছে সেই বাংলাদেশ বিরোধী শক্তিকে চিহ্নিত করে তার মোকাবিলা করতে ব্যর্থ
হই, তাহলে শেখ মুজিবের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়া কখনই সম্ভব হবে না। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির
মূল মন্ত্র ছিল মানুষের প্রতি ভালবাসা। তিনি বিশ্বাস করতেন বাহুবলে নয়, শুধুমাত্র
ভালবাসা দিয়েই মানুষের মন জয় করা যায়, মানুষের আস্থাভাজন হওয়া যায়। আর তখন মানুষ
আকাশের চাঁদ পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারে প্রতিদান হিসেবে। এই শোক দিবসে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক শোককে
শক্তিতে পরিণত করার, ক্ষমতার নয়, মানুষের জন্য রাজনীতি করার, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ
গড়ে তোলার। একমাত্র এভাবেই আমরা তাঁর রক্তের ঋণ শোধ করতে পারব।
দুবনা, ১৫ আগস্ট ২০১৮
Comments
Post a Comment