ভাব সম্প্রসারণ
কয়েকদিন আগে ঈদ চলে গেল। ফেসবুকে বয়ে
গেল শুভেচ্ছার বন্যা। ঈদ, পূজা, বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষ, ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস (৯
মে ও ১৬ ডিসেম্বর) এ দিনগুলোতে আমরা একে অন্যেকে শুভেচ্ছা জানাই। এখন অবশ্য
সামাজিক মাধ্যমের কারণে যোগাযোগ রেগুলার হয়। চিঠির যুগে এসব দিন ছিল বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করার এক
বাড়তি অছিলা। অন্তত আমার
জন্য এসব ছিল পরিচিত মানুষদের সাথে দেখা করার বা তাদের খোঁজ খবর জানার এক উত্তম
সুযোগ। এ কারণেই
মস্কোয় কোন অনুষ্ঠান হলে যাওয়ার চেষ্টা করি। অন্যদের কথা বলতে পারব না, তবে পূজা বা ইদের শুভেচ্ছার
সাথে সাথে আমার কাছে বরাবরই চলে আসে ছোটবেলার সেই দিনগুলো। তখন গ্রামে এগুলোই ছিল একমাত্র
অনুষ্ঠান যখন মানুষ দল বেঁধে একে অন্যেকে স্বাগত জানাত, পরত নতুন জামাকাপড়। অনেকের জন্যে
পূজা বা ঈদের জামাকাপড়ই ছিল বছরের একমাত্র পোশাক। তার চেয়েও বড় কথা শুধুমাত্র এই
সময়েই সবাইকে দেখিয়ে জামাকাপড় পরত সবাই। অনুষ্ঠানের অনেক আগে থেকেই দর্জির দোকানে দেওয়া
জামাকাপড়ের গল্প চলত পাড়ায় পাড়ায়। এখন হয়তো সেরকম নেই, তবে ধর্মীয় আবেদনের বাইরেও একটা
সামাজিক আবেদন রয়ে গেছে বলেই আমার বিশ্বাস। তাছাড়া ঈদ বা পূজায় যারা শুভেচ্ছা জানান তাঁরা নিজেদের
সুখ, আনন্দ বন্ধুদের সাথে ভাগ করে নিতে চান। এর মধ্যে যে লোক দেখানো অনুষঙ্গ থাকে না তা নয়। তবে আজকাল আমরা
যখন গণহারে দেশ বিদেশে বেড়িয়ে নিজেদের সেলফি তুলে মানুষকে দেখাই তখন ঈদগাহ মাঠ বা
পূজার মণ্ডপ থেকে কেউ ছবি তুলে দেখালেই কী? এখন এটাই সমাজের রীতি, সবাইকে জানান
আমি এখানে ছিলাম, আমি এখানে খেলাম এই সব আর কি। আমাদের ছোটবেলায় কি কল্পনা করতে
পারতাম নিজের হাড়ির ভাতের খবর কাউকে বলব? এখন আমার মুখের আগেই ফেসবুক বন্ধুরা পোড়া
ভাতের স্বাদ পেয়ে যান। যুগের হাওয়া বলে কথা।
আমার ফেসবুক বন্ধু তালিকায় হাজার
খানেক লোক, যাদের অধিকাংশ সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়া ফেরত, আছে আত্মীয়স্বজন,
স্কুলের বন্ধুরা, কমরেডরা, মানে পরিচিত বা কাছাকাছি মানসিকতার লোকজন। তাছাড়া আমার
টাইম লাইনে আসে শুধু খুব ঘনিষ্ঠ লোকদের পোস্ট। তাই ঈদের আগে দু এক জনের
স্ট্যাটাস আমাকে অবাক করেছে, কেননা এরা নিজেদের প্রগতিশীল মনে করেন, আন্দোলন করেন,
সুযোগ পেলেই ভলতেয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তি বলতে ছাড়েন না “I do not agree with what you say but I will defend your right to express
it to the last”। তাই এদের অনেকেই
যখন দেখলাম তাদেরকে ঈদের শুভেচ্ছা না জানাতে বলছেন নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা
আমরা মুখে যা বলি, সেটা কি সত্যিই বিশ্বাস করি?” আমার কেন যেন মনে হয় আমাদের
বিশ্বাস শুধু নিজের জন্য। আমরা নিজেরা গণতন্ত্র চাই, কিন্তু অন্যেরাও তা পাক সেটা চাই না, বিশেষ করে
অন্যদের গণতন্ত্র যদি আমার স্বার্থের পরিপন্থী হয়। আমি মুখে বলি তোমার
বাকস্বাধীনতার জন্য আমি জীবন দিতে প্রস্তুত, অথচ তোমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করতে পারি
না। জানি ঈদের সাথে
কোরবানি, পূজার সাথে পশুবলী এসব অনেকে মানতে পারেন না। কিন্তু সব সময় ঢালাও ভাবে সব কিছুকে না করার এই প্রবণতা নিজেদের
ঘোষিত বিভিন্ন আদর্শের সাথে কেমনে যায়, সেটাও ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। যেহেতু তখন সময়
ছিল না এতো কিছু লেখার আমি সেটাকে এক কথায় প্রকাশ করে এক স্ট্যাটাস দিলাম
“তা তুমি যে বাদীই হও না কেন, যতক্ষন না অন্য বাদের প্রতি সহনশীল বা পরমতসহিষ্ণু হতে পারছ, নিরপেক্ষ বিচারে তুমি উগ্রবাদীই হবে। “
এরপর শুরু হল পক্ষে বিপক্ষে
বিভিন্ন বাক বিতণ্ডা। এলো একাত্তরের পক্ষের বিপক্ষের কথা, এল রাজনীতির কথা। ব্যাপারটা দাঁড়ালো যদি কেউ লেখে
“সদা সত্য কথা বলিবে” হাজার হাজার লোক তাকে তাড়া করবে এই অভিযোগে যে সে তাদের
মিথ্যেবাদী বলেছে। আমরা এতদিন অন্যদের সন্দেহ করতাম, এখন নিজেদের সন্দেহ করতে শুরু করেছি। চারিদিকে
সন্দেহের গন্ধ। চারিদিকে বিশ্বাসহীনতা। বিশ্বাসহীন এই
সমাজে আদর্শ টিকবে কিভাবে? আসলে আমাদেরই বা দোষ কি? যেখানে মানুষের দরকার
ডেমক্রাসির টিকা, সেখানে তারা পায় গণতান্ত্রিক মিসাইল। সহ্যেরও তো একটা সীমা আছে। তাই তার কাছে
আজ সব কিছুই অসহ্য। তার কাছে জীবন অসহ্য, মরণ অসহ্য, আলো অসহ্য, আঁধার অসহ্য - সে আজ সব
সহ্যের উপরে। আজ প্রতিটি মানুষ একেকজন একেকটি খুদে দেবতা, সবজান্তা বিশেষ করে তার পকেটে যদি কোন
সার্টিফিকেট থাকে। ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। সত্যিকার
অর্থেই ছোট হয়ে আসছে। মানুষের বুদ্ধির ভারে সে আজ অসুস্থ।
Comments
Post a Comment