পূজার রেশ


আমাদের ছোটবেলায় ইন্টারনেট ছিল না, টেলিফোনও ছিল শুধুমাত্র বড় বড় শহরে, তাও আবার ঘরে ঘরে নয়। ফলে পূজা শেষ হলেও অনেকদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম সমস্ত আত্মীয়-স্বজনদের ভালোবাসা আর শুভেচ্ছা ভরা চিঠিগুলোর জন্য। দুপুর সাড়ে বারোটা বাজলেই শুরু হত অপেক্ষার পালা কখন পিওন আসবে চিঠি নিয়ে। অনেক সময় আমরা নিজেরাই যেতাম পোস্ট অফিসে চিঠির খোঁজে। এখন দিন বদলে গেছে। এমনকি পূজা শেষ হবার আগেই সবার মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় বিজয়ার শুভেচ্ছা জানানোর। ফলে অবস্থা দাঁড়িয়েছে এই যে দশমীর পরদিন থেকে আর শুভেচ্ছার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকি না। তাই হঠাৎ একটু আগে বিজয়ার শুভেচ্ছা পেয়ে একটু নস্টালজিক হয়ে পড়লাম।
-       শুভ বিজয়া দাদা!
-       শুভ বিজয়া!
-       কেমন আছেন?
-       ভালো। ভালো থাকাই আমার কাজ। আপনি ভালো?
-       একদম দারুণ আছি।  
-       গ্রেট। এই তো চাই।
-       পুজো কেমন কাটালেন?
-       অন্যান্য দিনের মতই। আমার সব দিনই আনন্দের। সপ্তমীতে মস্কো গেলাম বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। সেই সাথে দেবীকেও দর্শন দিয়ে এলাম।
-       বাহ। কলকাতায় পুজো চলছে তো চলছেই।
মনে পড়ল সকালে ভ্রমর লিখেছিল সিডনী থেকে। আজও ওদের ওখানে পূজা হচ্ছে।  তাই লিখলাম
-       এভাবে চললে দেবতারা কিছুদিনের মধ্যেই মর্ত্যের দখল নিয়ে নেবে।
-       তা যা বলেছেন। মানুষের কোন কাজকর্মও নেই, শুধু ছুটি আর হৈচৈ।
-       হ্যাঁ। ইহলোকে পাওয়ার তো আর তেমন কিছু নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পর থেকে গরীবের সে আশার গুড়ে বালি। সে এখন পরলোকে শান্তি খোঁজে। বড়লোকের জীবনও আজ একঘেয়ে। তারা চায় হাওয়া পরিবর্তন করতে। তাই সবাই এখন স্বর্গের হোটেল বুকিং করতে ব্যস্ত।       
-       হা হা। আপনি বুকিং দিয়েছেন?
-       আমার সেই ঝামেলা নেই। স্বর্গে যাব না বলে ঠিক করেছি। তাই ভগবানকে ঘুষ দেবার হ্যাঙ্গামা নেই আমার।   
-       তা যা বলেছেন। অ্যামেরিকা গিয়ে সেটা বুঝেছি।
-       আসলে মানুষ আজকাল নিজেকে ভালবাসতে ভুলে গেছে। মানে নিজেকে আমরা ভালবাসি ঠিকই। কিন্তু নিজেকে ভালোবাসা যে কি সে সম্পর্কে আমাদের অনেকের সঠিক ধারণা নেই। আমরা আসলে ভালবাসি টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি, জামা-কাপড় এই সব। এসব করে ভাবি আমরা আসলে নিজেদেরই ভালোবাসছি। আমরা ভুলে যাই শরীরের কোথাও মন বলে একটা ব্যাপার আছে যে একটু যত্ন চায়, একটু ভালোবাসা চায়। কিন্তু শো বিজের এই যুগে সেটা করার সময় কোথায়? উপভোগ – এটাই আজকের জীবন ধর্ম। এই নতুন ফিলসফি শুধু আমাদের দৈনন্দিন জীবনই নয়, আমাদের ধর্মীয় জীবনকেও প্রভাবিত করছে। ফলে এসবের মাধ্যমে আমরা যতটা না দেব-দেবীর পূজা করছি তার চেয়েও বেশি করছি নব্য পুঁজিবাদের, নেওলিবারিজমের সেবা।    

দুবনা, ২০ অক্টোবর ২০১৮        



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি