পা না মাথা


পা নিয়ে মাথা ব্যথাটা কমছে না কিছুতেই। আসলে সমস্যাটা পায়ে না মাথায় – সেটাই এখন গবেষণার বিষয়। ব্যথাটা মাথার হলে অনেক আগেই সেরে যেত। কারণ মাথার সাথে কোন সমঝোতায় আসা যতটা সহজ পায়ের সাথে সেটা করা ততটাই কঠিন। এটা পায়ের মগজহীনতার একটা মাইনাস পয়েন্ট। তবে এর সাথে আরেকটা উপসর্গ যোগ হয়েছে। পা বাবাজি অলরেডি তিন সপ্তাহ শয্যাশায়ী। এর মধ্যে বিভিন্ন রকমের ইনজেকশন, স্যালাইন, থেরাপি, ফিটনেসসহ অনেক কিছুই ভল্গার জলে ভেসে গেছে। পশ্চাদ্দেশ পরিণত হয়েছে ঝাঁজরিতে। কিন্তু ব্যথা যেমন ছিল তেমনই আছে। শুধু বোঝা যাচ্ছে না ব্যথাটা কি আগের নাকি ইনজেকশনের? এটা ভাবলেই আমার লম্বা দাড়িওয়ালা এক চুটকির কথা মনে পড়ে যায়।
এক মেয়ে সবে মাত্র কাজে ঢুকেছে ওষুধের দোকানে। এখনও অনেক ওষুধপত্রই চেনে না। তাই দোকানের বয়স্ক ভদ্রমহিলার সাথে পরামর্শ করে নেয় কিছু বিক্রির আগে। একদিন এক ভদ্রলোক এসে বললেন
- আমার প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। তাড়াতাড়ি কিছু একটা ওষুধ দাও।
- একটু অপেক্ষা করুন। সিনিয়র মহিলা এখন ব্যস্ত। উনি ফ্রি হলেই এনে দেব।                 
- অপেক্ষা করার সময় নেই। যা আছে তুমি সেটাই দিয়ে দাও।
মেয়েটা উপায় না দেখে ভদ্রলোককে একটা ওষুধ ধরিয়ে দেয়। একটু পরে বয়স্কা মহিলা এসে জিজ্ঞেস করলেন
-   কি চাইছিল ঐ ভদ্রলোক?
-   মাথা ব্যথার ওষুধ।
-   কি দিলে?
-   এইতো এই ওষুধটা।
-   এ কী করেছ? এখন তো ও বাথরুম থেকে বেরুতে পারবে না সারাদিন।
-   তা ঠিক। তবে আগামী ২৪ ঘন্টা মাথা ব্যথার কথা বেমালুম ভুলে যাবে।  
তবে এসব ছোটখাট অসুখের একটা ভালো দিকও আছে – বাড়তি মনোযোগ পাওয়া। আমার ফোন করার অভ্যেস নেই বললেই চলে। এমন কি ছেলেমেয়েদেরও ফোন করা হয়ে ওঠে না কোন কাজ না থাকলে। বউ প্রায়ই এ নিয়ে কথা শোনায়। আমি বলি, “ফোন যখন করছে না, তখন ভালই আছে। সমস্যা হলে নিশ্চয়ই ফোন করত।“ এটা ঠিক, ওরাও ফোন করে যদি কোন কিছুর দরকার হয় – টাকাপয়সা, কোন সংবাদ ইত্যাদি। আসলে শুধু বলার খাতিরে কিছু বলা আমরা বাসায় কেউই পছন্দ করি না।  তবে ইদানীং ওদের কাছ থেকে বাড়তি ফোন পাচ্ছি। ফোন করেই জিজ্ঞেস করে
- পাপা, তোমার পায়ের খবর কী?
আমার যেন কোন অস্তিত্বই নেই এই পৃথিবীতে। পায়ের বাইরেও যে আস্ত একটা মানুষ থাকতে পারে, সবাই যেন সেটা ভুলেই গেছে। যাক, শেষ পর্যন্ত পদমর্যাদা একটু হলেও বেড়েছে। সেটাই বা কম কি!
এছাড়াও ওরা বাসায় কাজকর্মও একটু হলেও করছে। সাধারণত আমি রবিবার মস্কো যাই। ওরা ঘরের অনেক কাজ আমার জন্য রেখে দেয়। ইদানীং সেটা করছে না। চেষ্টা করছে বাসাটা গুছিয়ে রাখতে। রোববার রাতে সেভা স্টেশনে অপেক্ষা করে, সোমবার ক্লাস শেষে নিয়ে যায় বাসায়। ক্লাস নেয়াটা সত্যি কষ্টকর। একটানা সাড়ে চার ঘণ্টা লেকচার দেওয়ার পরে মনে হয়, ইস পা’টা যদি কাঁধে নিয়ে এখন বাসায় ফিরে একটু ঘুমুতে পারতাম!
কয়েক দিন মনিকা বলল      
-   তুমি ছুটি নিলেই তো পার। পা’টাকে একটু বিশ্রাম দাও।
-   আইডিয়াটা খারাপ নয়। তোরা কাজ করিস। সংসারের হাল ধর। তাহলেই ছুটি নেব।
মনিকার মুচকি হাসি দেখে বুঝলাম এতো বড় দায়িত্ব নিতে ও এখনও প্রস্তুত নয়। সেভা অবশ্য ছুটি নিতে বলে না। বলে
-   পাপ, তুমি তো আজ না আসলেই পারতে।
-   এ আবার কেমন কথা। ছাত্ররা বসে থাকতো যে।
-   বাজে কথা। তুমি না এলে ওরা বরং উল্টো খুশি হত।
-   তা হয়তো। তবে ক্লাস না নিলে বেতন দেবে কেন? সেটাও তো দরকার।      
-   মাত্র এক দিন ক্লাস না নিলে কিই বা ক্ষতি হত।
-   আমি তো একদিনের জন্য ছুটি চাইতে পারি না। এই দেখ, তোর সব সময় এটা দরকার, সেটা দরকার। তাই কাজটা তো করতেই হবে।
এতো গেল ছেলেমেয়েদের কথা। বাড়ি থেকে ফোন এলেও তার একটা বিরাট অংশ জুড়ে থাকে আমার পা। এভাবে চললে আমার পাও একদিন বামন অবতারের পায়ের মত স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল সব দখল করে ফেলবে।
তবে এই পা কান্ডে সব চেয়ে বিপদে পড়েছি আমার শিক্ষক, রাশিয়ায় আমার একমাত্র অভিভাবক ইউরি পেত্রোভিচকে নিয়ে। পায়ে সমস্যা হচ্ছে শুনেই উনি কথা বলেছেন   আমাদের ইউনিভার্সিটির এক নামকরা স্পেশালিস্টের সাথে। এখন প্রায়ই ফোন করে জিজ্ঞেস করছেন আমি ঐ ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করেছি কি না। ইউরি পেত্রোভিচের এই ভালোবাসা একদিকে আমাকে পুলকিত করে, অন্যদিকে একটা বাড়তি দায়িত্ব চাপিয়ে দেয় শরীরের প্রতি যত্নবান হওয়ার। তাই চাই বা না চাই, পা নিয়ে মাথা ব্যথা আপাতত থেকেই যাচ্ছে।

দুবনা, ০৯ অক্টোবর ২০১৮   

  

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি