নির্বাচনী ফুটবল
যদিও এখনও পর্যন্ত তফশীল ঘোষণা করা হয়নি, তবুও বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে, সামাজিক মাধ্যমে আসন্ন নির্বাচনের উত্তাল বাতাস বইতে শুরু করেছে বেশ আগে থেকেই। গড়ে উঠছে বিভিন্ন রাজনৈতিক জোট। ভাঙ্গা গড়ার এ খেলায় মেতে উঠেছে জাতি। এই সুযোগে বিস্মৃতির আড়াল থেকে সূর্যের আলোয় বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে অনেক রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি।
এর মধ্যে সিপিবি আসন্ন জতীয় সংসদ নির্বাচনে
সম্ভাব্য প্রার্থীদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। তাতে চুরাশিটি নাম আছে। শুধু তাই নয়, এই চুরাশি জনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থী ধর্মীয়
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। যেহেতু সিপিবি ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী, তাই এতে অবাক
হবার কিছুই নেই। কিন্তু দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির
প্রেক্ষাপটে এটা নিঃসন্দেহে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। সিপিবি এর মাধ্যমে প্রমাণ করেছে তারা শুধু কথাতেই নয় কাজেও তাদের
ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখে।
সিপিবির এই তালিকা প্রকাশে দুটো কারণে আমি আশাবাদী। প্রথমত সিপিবি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় বিপ্লবের সম্ভাবনা যেখানে অস্তমিত, সেখানে নির্বাচন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের এক অন্যতম প্রধান অস্ত্র। ২০১৪ সালে যে দৃষ্টিকোণ থেকেই সিপিবি নির্বাচন বয়কট করুক না কেন, সেটা অনেকের মনেই বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছে, ভবিষ্যতেও তুলবে। গত নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নটা সিপিবির জন্য ছিল শাঁখের করাতের মত। তবে অনেকের ধারণা সেটা না করে সিপিবি পারত পক্ষে একাত্তরের চেতনার বিরোধী শক্তির হাতকেই শক্তিশালী করেছে। তাই এবারের নির্বাচনে সিপিবির অংশগ্রহণে আগ্রহ একটা পজিটিভ দিক। দ্বিতীয় যে ব্যাপারটা আমার ভালো লেগেছে তা হল সম্ভাব্য প্রার্থীর সংখ্যা। যেহেতু সিপিবি নির্বাচনের মাঠে কখনই শক্তিশালী দল ছিল না, এতগুলো কেন্দ্রে তাদের প্রার্থী দেবার আকাঙ্ক্ষা দলটির সাংগঠনিক শক্তির কথাই বলে। এখানে জয়টা বড় কথা নয়, নির্বচনকে সামনে রেখে সিপিবিসহ বাম দলগুলোর বার্তা মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়াই আসল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে একাত্তরের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শক্তিশালী বিরোধী দলের আত্মপ্রকাশ যুগের দাবি। নির্বাচন একটা সুবর্ণ সুযোগ সেই কাজটা শুরু করার এবং যথা সম্ভব সামনে এগিয়ে নেওয়ার।
সিপিবির এই তালিকা প্রকাশে দুটো কারণে আমি আশাবাদী। প্রথমত সিপিবি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় বিপ্লবের সম্ভাবনা যেখানে অস্তমিত, সেখানে নির্বাচন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের এক অন্যতম প্রধান অস্ত্র। ২০১৪ সালে যে দৃষ্টিকোণ থেকেই সিপিবি নির্বাচন বয়কট করুক না কেন, সেটা অনেকের মনেই বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছে, ভবিষ্যতেও তুলবে। গত নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নটা সিপিবির জন্য ছিল শাঁখের করাতের মত। তবে অনেকের ধারণা সেটা না করে সিপিবি পারত পক্ষে একাত্তরের চেতনার বিরোধী শক্তির হাতকেই শক্তিশালী করেছে। তাই এবারের নির্বাচনে সিপিবির অংশগ্রহণে আগ্রহ একটা পজিটিভ দিক। দ্বিতীয় যে ব্যাপারটা আমার ভালো লেগেছে তা হল সম্ভাব্য প্রার্থীর সংখ্যা। যেহেতু সিপিবি নির্বাচনের মাঠে কখনই শক্তিশালী দল ছিল না, এতগুলো কেন্দ্রে তাদের প্রার্থী দেবার আকাঙ্ক্ষা দলটির সাংগঠনিক শক্তির কথাই বলে। এখানে জয়টা বড় কথা নয়, নির্বচনকে সামনে রেখে সিপিবিসহ বাম দলগুলোর বার্তা মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়াই আসল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে একাত্তরের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শক্তিশালী বিরোধী দলের আত্মপ্রকাশ যুগের দাবি। নির্বাচন একটা সুবর্ণ সুযোগ সেই কাজটা শুরু করার এবং যথা সম্ভব সামনে এগিয়ে নেওয়ার।
কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
ওবায়দুল কাদের সিপিবির নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোটের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন “আসুন আমরা
মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হই, মিনিমাম পয়েন্টে ম্যাক্সিমাম ইউনিটি
গড়ে তুলি। এ প্রসঙ্গে তিনি
বলেন “আমরাও জাতীয় ঐক্য চাই। আমরা জাতীয়
ঐক্য চাই সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে, নষ্ট রাজনীতির
বিরুদ্ধে, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। এ দেশের জন্মের যে চেতনা, এই চেতনা নিয়ে আমরা জাতীয় ঐক্য চাই।”
সিপিবি অবশ্য এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
করেছে। সিপিবি নেতা রুহিন
হসাইন প্রিন্স বলেন, “উনি যে সব বিষয় উল্লেখ করেছেন, তার সঙ্গে বর্তমান আওয়ামী লীগ
নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ পুরোপুরি সাংঘর্ষিক অবস্থায় রয়েছে।“ তার কথায় আওয়ামী লীগ নিজেই এখন সাম্প্রদায়িক শক্তিকে লালন করছে। রাজাকারের বিচার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু
তারা নিষিদ্ধ হয়নি। তার মতে নষ্ট রাজনীতির
অন্যতম স্তম্ভে পরিণত হয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ। এই সরকারের আমলে দুর্নীতি, সন্ত্রাস আগের যেকোন সরকারের চেয়ে
অনেক বেশি ছড়িয়ে গেছে।
ওবায়দুল কাদের যে সমস্ত সমস্যার কথা
তুলে ধরেছেন সে ব্যাপারে একমত না হয়ে উপায় নেই। এ সমস্যাগুলো বাংলাদেশের বিকাশের পথে প্রধান বাধা। এ সমস্যার সমাধান বাংলাদেশের মুলনীতিতে
বিশ্বাসী প্রতিটি নাগরিকই চায়, বিশেষ করে বামপন্থী দলগুলো। এখানে বলে রাখা ভালো বাংলাদেশ অন্যান্য দশটা দেশের মত নয়। পৃথিবীর অনেক দেশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা লাভ করেছে। সেসব লড়াই ছিল মুলত বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের লড়াই ছিল আদর্শিক। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ব্রিটিশ
সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও অচিরেই মানুষ বুঝতে পারে এর ফলে
শুধুই মালিকই বদল হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত স্বাধীনতা আসেনি। ১৯৪৮ সালের ভাষার দাবি একের পর এক
ইতিহাস রচনা করে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। ২৪ বছরের এই নিরন্তর সংগ্রামে এ দেশের মানুষ
শুধু দ্বিজাতি তত্ত্বকেই ত্যাগ করে না, ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে সামরিক শাসন,
স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা। মুক্তিযুদ্ধের
চেতনার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে বাহাত্তরের সংবিধানে। ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এসব শুধু কথার কথা নয়,
বাংলাদেশের জন্য এগুলো জন্মদাগের মত। এর যে কোনটাকেই
বাদ দিলে আমরা যে বাংলাদেশ পাই, সেটা একাত্তরের চেতনার পরিপন্থী। এমন কি বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় সমাজতন্ত্র
তার আগের আবেদন হারালেও আমাদের দেশের বিশেষ করে জনগনের সার্বিক উন্নয়নে
সমাজতান্ত্রিক বণ্টন ব্যবস্থার অনেক কিছুই গ্রহণ করা যেতে পারে। সেদিক থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এই
উপলব্ধি পজিটিভ।
অন্যদিকে
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে সিপিবির বক্তব্য ফেলনা নয়। সিপিবি বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের সাথে একই প্ল্যাটফর্মে কাজ করেছে। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগের সেই আগের চরিত্র
আর নেই। দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার ফলে
সুবিধাবাদীদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে আজকের আওয়ামী লীগ। ফলে অনেক
পরীক্ষিত বন্ধুরা আজ দূরে যেতে বাধ্য হয়েছে বা হচ্ছে। পঁচাত্তরে তাজউদ্দীন আহমেদ এ ভাবেই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরে গেছিলেন
মোশতাকের মুজিব ভক্তির ধাক্কায়। আর সেটা না
মুজিব, না তাজউদ্দীন, না আওয়ামী লীগ, না সিপিবি না একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী
মানুষ কারো জন্যই কোন সুখবর বয়ে আনেনি। আজকের প্রজন্ম
যদি একই ভুল করে তাহলে বলার কিছুই থাকবে না।
এখানে
একটা কথা বলে নেই। যেকোনো কথার অনেকগুলো
ইন্টারপ্রিটেশন থাকে। যে বলে তার আবার যে শোনে তার। জীবন প্রচণ্ড সাবজেক্টিভ এবং বলতে গেলে
মিথ্যার উপর গড়া। আমরা বড় হই বই পড়ে। কিন্তু এই বইগুলোও তো কাল্পনিক, মানে লেখক
তার কল্পনা দিয়ে লেখেন। এমন কি সেটা যদি বাস্তব
অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেও হয়, তার পরেও সেখানে থাকে লেখকের কল্পনার ছোঁয়া। আমরা তাদের লেখা থেকে শিক্ষা নেই, সেই
শিক্ষাকে জীবনে চলার পাথেয় করি। রাশিয়ায় একটা
কথা আছে – “চাক্ষুষ সাক্ষী সবচেয়ে বড় মিথ্যেবাদী”। আপাত দৃষ্টিতে কথাটা অযৌক্তিক মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা এই যে, সে
শুধু একটা দিকই দেখে আর সেটাকেই চূড়ান্ত সত্য বলে মনে করে। দশ জন লোক যদি ১০ টা ভিন্ন কোণ
থেকে ঘটনাটা দেখে, তবে প্রত্যেকের দেখা হবে নিজের নিজের। সত্যটা হবে এই দশ জনের বর্ণনার ভিত্তিতে যে নিরপেক্ষ ছবি পাওয়া যাবে সেটা।
তাই
প্রশ্নটা হচ্ছে ওবায়দুল কাদের কী বললেন শুধু সেটা
নয়, অন্যেরা কীভাবে তা গ্রহণ করছে সেটাও। আমরা আগেই দেখেছি তার তুলে ধরা
সমস্যাগুলো বাংলাদেশের জন্য নির্মম সত্য। আসুন না এটাকে এভাবে দেখি। সরকারী দলের
সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এই কথা বলা মানে দেশ চালাতে অনেক
ক্ষেত্রেই যে তারা ব্যর্থ সেটা স্বীকার করা। তিনি সিপিবির নেতৃত্বাধীন বাম দলগুলোকে আহ্বান জানাচ্ছেন এই সমস্যার
মোকাবেলায় তাদের সাথে একসাথে লড়তে। এর অর্থ হল এই
বাম দলগুলোই যে প্রকৃত একাত্তরের চেতনার ধারক ও বাহক সেটা স্বীকার করা। সেটাই যদি হয় তাহলে সিপিবিসহ বাম দলগুলোর এসব
প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সাথে এক যোগে লড়াই করার বাধা কোথায়? সিপিবির নিজের শক্তিতে
নির্বাচনে জয়ী হবার সম্ভাবনা কম। কিন্তু তারা তো
এই সুযোগে পারে তাদের এজেন্ডাগুলো সামনে নিয়ে আসতে, সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে, নষ্ট
রাজনীতির বিরুদ্ধে, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একসাথে লড়াই করতে। আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে কতটুকু আন্তরিক সে প্রশ্ন আসতেই পারে, কিন্তু
সাহায্য না করুক, এই আন্দোলনে যদি আওয়ামী লীগ বাধা না দেয় সেটাও কি বড় পাওয়া নয়?
ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়, বাম রাজনীতির বর্তমান অবস্থায় ওবায়দুল কাদের শুধু খড়কুটো নয়, রীতিমত ভেলার
কাজ করতে পারবেন। নৌকার প্রতি অ্যালার্জি থাকলেও
ভেলার ক্ষেত্রে বামদের সেটা থাকার কথা তো নয়।
পাকিস্তান আমলে সিপিবির আন্দোলনের কথা এই ভূখণ্ডের ইতিহাসে সুবর্ণ অক্ষরে লেখা থাকবে। স্বাধীনতার পরে বাকশালে মিশে যায় এই দল। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে অনেক দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি সেভাবে। কিন্তু আশির দশকে, বিশেষ করে এরশাদের আমলে সিপিবির পালে নতুন হাওয়া লাগে। কৃষক সমিতি, ক্ষেতমজুর সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন থেকে শুরু করে অন্যান্য গণসংগঠনগুলো নতুন প্রাণ ফিরে পায়। কমরেড ফরহাদের নেতৃত্বে সিপিবি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিশেষ স্থান দখল করে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মত জন সমর্থন না থাকলেও সিপিবি বিশেষ করে ফরহাদ ভাই হয়ে ওঠেন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। ফরহাদ ভাইয়ের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা পার্টিতে মেহনতি মানুষের ভ্যান গার্ডে পরিণত করে। ঐ সময়ে পার্টির দ্রুত বৃদ্ধির একটা অন্যতম প্রধান কারণ মনে হয় সিপিবির পার্লামেন্ট নির্বাচনে কতগুলো আসনে জয়ী হওয়া। রাস্তায় আন্দোলনের সাথে সাথে পার্লামেন্টের ভেতরে তাদের ভূমিকা গণমানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জানি না পার্লামেন্টের ভেতরের রাজনীতি নিয়ে সিপিবির নেতৃবৃন্দের মূল্যায়ন কী, তবে আমার বিশ্বাস ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনে কতগুলো আসনে বিজয়ের সুবাদে সিপিবি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে পেরেছিল। আর এই বিশ্বাস থেকেই আমার মনে হয় সিপিবির উচিৎ আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এবং কিছু আসনে বিজয় নিশ্চিত করা যায় কি না সে বিষয়টি ভেবে দেখা।
পাকিস্তান আমলে সিপিবির আন্দোলনের কথা এই ভূখণ্ডের ইতিহাসে সুবর্ণ অক্ষরে লেখা থাকবে। স্বাধীনতার পরে বাকশালে মিশে যায় এই দল। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে অনেক দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি সেভাবে। কিন্তু আশির দশকে, বিশেষ করে এরশাদের আমলে সিপিবির পালে নতুন হাওয়া লাগে। কৃষক সমিতি, ক্ষেতমজুর সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন থেকে শুরু করে অন্যান্য গণসংগঠনগুলো নতুন প্রাণ ফিরে পায়। কমরেড ফরহাদের নেতৃত্বে সিপিবি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিশেষ স্থান দখল করে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মত জন সমর্থন না থাকলেও সিপিবি বিশেষ করে ফরহাদ ভাই হয়ে ওঠেন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। ফরহাদ ভাইয়ের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা পার্টিতে মেহনতি মানুষের ভ্যান গার্ডে পরিণত করে। ঐ সময়ে পার্টির দ্রুত বৃদ্ধির একটা অন্যতম প্রধান কারণ মনে হয় সিপিবির পার্লামেন্ট নির্বাচনে কতগুলো আসনে জয়ী হওয়া। রাস্তায় আন্দোলনের সাথে সাথে পার্লামেন্টের ভেতরে তাদের ভূমিকা গণমানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জানি না পার্লামেন্টের ভেতরের রাজনীতি নিয়ে সিপিবির নেতৃবৃন্দের মূল্যায়ন কী, তবে আমার বিশ্বাস ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনে কতগুলো আসনে বিজয়ের সুবাদে সিপিবি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে পেরেছিল। আর এই বিশ্বাস থেকেই আমার মনে হয় সিপিবির উচিৎ আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এবং কিছু আসনে বিজয় নিশ্চিত করা যায় কি না সে বিষয়টি ভেবে দেখা।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক
অঙ্গনে সবচেয়ে সক্রিয় দল হওয়ার পরেও নির্বাচনের দৌড়ে সিপিবি অনেক পিছিয়ে। এমন কি
সম্পূর্ণ স্বচ্ছ নির্বাচন হলেও শুধুমাত্র নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে কোন আসনে
জয়ী হওয়া তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এ জন্যে দরকার রাজনৈতিক জোট। কিন্তু বাম
দলগুলোর সাথে গাঁটছড়া বেঁধে সে কাজ যে হবে না সেটা বলাই বাহুল্য। দরকার নির্বাচন ও
ভোটের রাজনীতিতে চ্যাম্পিয়ন কোন দলের সাথে সমঝোতায় আসা। কিন্তু এখানে অপশন শূন্যের
কাছাকাছি। বিএনপির সাথে গাঁটছড়া বাধার প্রশ্নই আসে না, সেটা করলে পার্টির অস্তিত্ব
বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বিপুল। বাকি রইল শুধু আওয়ামী লীগ। কিন্তু আমাদের রাজনীতির
সবচেয়ে বড় সমস্যা হল রাজনৈতিক যুক্তিযুক্ততার ওপরে ব্যক্তিগত মান অভিমানকে স্থান
দেওয়া। নেহেরু-জিন্নাহ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এ মনভাব শুধু বাংলাদেশ কেন,
উপমহাদেশের রাজনীতিকে বার বার ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। বিগত দিনগুলোতে একমাত্র সিপিবি ও
তার নেতৃত্বাধীন বাম দলীয় জোটই রাজনৈতিক ভাবে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করার চেষ্টা
করেছে। ফলে আওয়ামী লীগ ও সিপিবির সম্পর্ক অনেকটা সাপে নেউলের মত দাঁড়িয়েছে। এমনকি
সিপিবির অনেক নেতা, যারা বীর বিক্রমে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের
মুক্তিযোদ্ধা সনদ হারানো, জনসভায় সিপিবির সভাপতির উপর আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের
আক্রমন করার মত ঘটনা ঘটেছে। এটাও সিপিবির পক্ষ থেকে ওবায়দুল কাদেরের আহ্বানে সাড়া
দেবার পথে কণ্টকের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে রাজনীতি শুধু আবেগ নয়, পুঙ্খানুপুঙ্খ
হিসাব নিকাশ। তাই সিপিবির উচিত হবে ওবায়দুল কাদেরের ডাকে সাড়া দিয়ে এ দেশের
অস্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করা, আওয়ামী লীগের
সাথে কতগুলো সংসদীয় আসনের ব্যাপারে সমঝোতায় আসা। কেননা একমাত্র এই বোঝাপড়াই সিপিবি
জন্য জাতীয় সংসদের দ্বার খুলে দিতে পারে।জানি, এ বড়িটা খুব তেতো, কিন্তু দলের ও
দেশের কথা চিন্তা করে এ ধরণের ঐক্য যুক্তিযুক্ত বলেই মনে করি। কেননা অতীত অভিজ্ঞতা
প্রমান করে সংসদীয় দল হিসেবে সিপিবি শুধু নিজেকেই শক্তশালী করতে পারবে তা নয়, এর
মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে শক্তিশালী তৃতীয় শক্তি গড়ে তোলার এক অনন্য
প্ল্যাটফর্ম পাবে। তবে আমি রাজনৈতিক বিশ্লেষক নই। শুধু মাত্র গাণিতিক লজিকের উপর
ভিত্তি করে এসব ব্যাপারে কথা বলার বা লেখার চেষ্টা করি। সিপিবি কি সিদ্ধান্ত নেবে
সেটা তাদের ব্যাপার, তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সিপিবির বন্ধুরা উপরের কথাগুলো
একটু গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন বলে আশা করি।
দুবনা, ০১ নভেম্বর ২০১৮
দুবনা, ০১ নভেম্বর ২০১৮
Comments
Post a Comment