ভদ্রতার বিড়ম্বনা

আমার রাত পোহালো শারদ রাতে ...
বাঁশি বাঁশি ......

হ্যাঁ, সুপ্রভাতের ধাক্কায় রাতটা আজ আমার সেই মধ্য রাতেই পহিয়ে গেল। ভদ্রতার এই এক বিড়ম্বনা। অসময়ে প্রয়োগে অনেক সময় সুশাসন দুঃশাসনে পরিণত হয়, শুভ কামনাগুলো কামানের গোলার মত কানে বাজে।
রাত তখন ৫ টার মত। হঠাৎ মেসেঞ্জারের শব্দ। সুপ্রভাত। মনের কোনে ভেসে উঠলো খারকভে প্রস্তুতি পর্বে পড়াশুনা করা এক বন্ধুর মুখ। মস্কো এলেই আমার রুমে আসতো, চিঠিতে যোগাযোগ হত রেগুলার। খুব ভালো বাঁশি বাজাতো। এখনও নিশ্চয়ই বাজায় ঘরোয়া আড্ডায়। সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ এখনও আছে। কিন্তু আজকে বাঁশির ডাক পুলকিত করল না। এটা অবশ্য আমার সমস্যা। একবার ঘুম ভাঙ্গলে আর ঘুমুতে পারি না। সামনে বিশাল দিন।
মনে পড়ল আমার নিজের প্রস্তুতি পর্বের কথা। আমরা থাকতাম ৬ নং ব্লকে। ৫ নম্বরে থাকতেন অর্থনীতি, ইতিহাসের বড় ভাইয়েরা। রাতে সময় পেলেই যেতাম। দেশের খবর পাওয়া যেত আর সাথে দেশি কায়দায় রান্না খাবার। দেশে গ্রামের বাড়িতে আমাদের ফর্মালিটির তেমন সুযোগ ছিল না। বড়রা নিজেদের মধ্যে নমস্কার, আদাব এসব দিয়ে কথাবার্তা শুরু করলেও আমরা কেমন আছ বা আছেন দিয়েই শুরু করতাম। বিদায় বেলায় দেখা হবে বলার চল ছিল। তবে সেটা নিয়মিত নয়। মস্কো আসার পর এসব রপ্ত হতে শুরু করে। ঘুম থেকে জেগেই রুমমেটদের “দব্রোএ উত্রা” বা সুপ্রভাত বলা, বিদায়ের সময় “দো সভিদানিয়া” বা দেখা হবে বলা – এসব জীবনের প্রাত্যহিক অভিধানে ঢুকে যায়। একদিন নতুন শব্দ শেখালেন ম্যাডাম। “দো জাভত্রা” মানে কাল পর্যন্ত বা কাল দেখা হবে। আমি ঐ রাতে ৫ নম্বর থেকে বিদায় নেবার সময় পাকিস্তানি এক ভদ্রলোককে বললাম “দো জাভত্রা।“ উনি “দো সভিদানিয়া” বলে আমাকে বললেন, “দেখ, তোমার সাথে আমার আগামীকাল যে দেখা হবে এমন তো কথা নেই। তাই এ ক্ষেত্রে দো সভিদানিয়া বা দেখা হবে বলাই ভালো।“ আমি একটা লেসন পেলাম। শুধু জানাটাই নয় তার প্রয়োগটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অংকের ভাষায় যাকে বলে নেসেসারি ও সাফিসিয়েন্ট শর্তাবলী।
দেশে আজকাল ফর্মালিটির রেনেসাঁ চলছে। সবাই সুপ্রভাত, শুভদিন, শুভরাত্রির বিনিময়ে প্রচণ্ড আন্তরিক। আসলে আগের সেই অলস সময় আর নেই। সময় নেই প্রাণ খুলে কথা বলার। একই সাথে নিজেদের উপস্থিতি বা আমরা যে বন্ধুদের নিয়ে ভাবি সেটা জানানোও জরুরী। তাই অনেকেই সকালে, বিকেলে, সন্ধ্যায়, রাতে বিভিন্ন শুভেচ্ছাবানী পাঠিয়ে কাজটা সেরে ফেলি। আর যেহেতু আমরা আমাদের বন্ধুদের মনে মনে নিজেদের পাশেই দেখতে পাই, কার্যত ভুলে যাই এদের কেউ এখন অস্ট্রেলিয়ায় কাজের ভিড়ে, কেউ বা ক্যানাডায় রাতের স্বপ্নে বিভোর। আমি সাধারণত তাই এভাবে কাউকে ব্যক্তিগত শুভেচ্ছা পাঠাই না। কারণ শুভেচ্ছা পাঠালে উত্তর পাওয়ার দায়িত্ব থাকে। আর মেলবোর্নে নিখিলদা থেকে শুরু করে ভ্যাঙ্কুভারে পলি আপা পর্যন্ত সবাই যদি তাদের সময় অনুযায়ী উত্তর দিতে শুরু করে, আমার না থাকবে কাজের না থাকবে ঘুমের সময়। তাই কাউকে লেখার থাকলে আমি ফর্মালিটির বাইরে ব্যক্তিগত চিরকুট পাঠাই, দুমিনিট কথা বলি। সেটা যদি মাসে বা বছরে একবারও হয় এরকম ফর্মাল সুপ্রভাত, শুভরাত্রির চেয়ে সেটার গুরুত্ব অনেক বেশি। আর অনেককে কিছু বলার থাকলে স্ট্যাটাস বা নোট লিখি।  
বন্ধুরা, যারা আমাকে (শুধু আমাকে কেন) মেসেঞ্জারে এরকম ফর্মাল মেসেজ পাঠান একটু ভেবে দেখবেন, অনেক সময় সেটা আক্ষরিকভাবে অনেকের ঘুম নষ্টের কারণ হতে পারে। আশা করবো আপনারা আমাকে আমার রবি বাবুর মত বলতে দেবেন
আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে ...
বাঁশি বাঁশি ...

দুবনা, ০৪ অক্টোবর ২০১৮                       




Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি