মানব বন্ধন

আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মে জড়িত কেউ রাজনীতিতে, কেউ বা সাংস্কৃতিক কার্যকলাপে বিভিন্ন ইস্যুতে তারা আন্দোলন করে, মিটিং মিছিল করে আমাকেও ডাকে কখনও কখনও, যদিও জানে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে পারব না তবে এই সুযোগে মত বিনিময় হয়, তর্ক বিতর্ক হয় 

- দাদা!
- বল

- চলেন মানব বন্ধন করি

- মানব বন্ধন? কিন্তু তার আগে দুটো কথা আছে যে

- বলেন?
- প্রথমত মানব বন্ধন করবে, তা মানব পাবে কোথায়? 
- দ্বিতীয়ত?
- পাঠানরা পারেনি, মুগলরা পারেনি, সিরাজ, ইংরেজ, পাকিস্তান পারেনি
এমন কি শেখ মুজিব পর্যন্ত পারেননি বাঙ্গালীকে বাঁধতে তুমি আমি কোন ছার? যাকগে বল, এই যে মানব বন্ধন করতে চাও তার লক্ষ্যটা কি?
- আমরা এটা করব নিরাপদ সড়কের জন্য

- লজিক খুঁজে পাচ্ছি না

- মানে?
- সড়কের কি হাত-পা আছে, নাকি শিং আছে? কখনও দেখেছ কোন সড়ককে কাউকে কামড়াতে? দোষ তো মানুষের
ওরাই তো মানুষ মারে কেউ বেপারয়া গাড়ি চালায়, কেউবা চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড় দেয়
- কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবে

- সে তো বটেই
একটা গল্প বলি শোন
- বলেন

- ১৯৮৩ সালে কেবল দেশ থেকে মস্কো এসেছি
যে জিনিসটা খুব চোখে পড়ত তা হল মানুষের নির্বিকার ভাব যেখানেই যাও  সবাই কেমন শান্ত, নির্বিকার তার মানে এই না, কেউ তোমার দিকে তাকাচ্ছে না, চাইলে সাহায্য করছে না কিন্তু সেটাও করছে ঠাণ্ডা মাথায় মেট্রোতে ঢুকেছ, লোকজন বই বা খবরের কাগজ পড়ছে, দোকানে ঢুকেছ, সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে যেন কারো কোন তাড়া নেই ১৯৮৬ সালের গ্রীষ্মে এক সিনিয়র বন্ধু দেশে গেল বেড়াতে ফিরে এলে সবাই তাকে ঘিরে ধরল নানা প্রশ্ন শুরু হল কেমন লাগলো দেশে এতদিন পরে ও বলল, “মানুষগুলো কেমন যেন ছোট ছোট আর কালো কালো“ কথাটা ঠিক প্রায় পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে এমন লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু নয় আমি দেশে বেড়াতে গেলাম পরের বছর ১৯৮৭ সালে আমার কিন্তু দেশের মানুষকে কালো বা ছোট ছোট মনে হয়নি তখন শুধু একটাই মনে হয়েছে – মানুষ হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে দৌড়ুচ্ছে আর সবাই চেষ্টা করছে অন্যকে পেছনে ফেলে চলে যেতে এরপরেও অনেকবার দেশে গিয়েছি কিন্তু এই প্রতিযোগিতা তো কমেই নি বরং বেড়েছে যেখানে মানুষ এক সাথে চলতে পারে না, যেখানে সবাই সবাইকে বাইপাস করে যেতে চায় সেখানে মানব বন্ধন কেমনে হবে বল তো আর হলেও তার ফলই বা কি হবে? এই দেখ, নিরাপদ সড়কের ইস্যুটা কী সুন্দর, কী সময়োপযোগী ছিল কী সরকার, কী বিরোধী দল সবার জন্যই এটা দরকার, কেননা দেশের মানুষের জন্য এটা জীবন মরণ প্রশ্ন কিন্তু হল কি? ভালুক মারার আগেই শুরু হল ভালুকের চামড়া ভাগাভাগি সবাই দেখতে শুরু করলো এই আন্দোলন সফল হলে কে কতটুকু লাভবান হবে ফলে আন্দোলনটাই মাঠে মারা গেল এরকম প্রতিটি ক্ষেত্রেই
- তাহলে কি আমরা কিছুই করব না?
- আচ্ছা, বলতো এই যে আজ তুমি আমি যারা এই মানব বন্ধনে সামিল হব, দুঘণ্টা পরে আমরাই কিন্তু হয় আইন না মেনে গাড়ি চালাব বা নিয়ম ভেঙ্গে রাস্তা পেরুবো – এটা ঠিক কি না?
- হ্যাঁ
সেটা ঠিক
- আমরা নিজেরাই যদি না বদলাই তাহলে অন্যদের বদলাব কেমনে? আমাদের দেশে যারা আইন তৈরি তারা তো নিজেদের জন্য ওটা তৈরি করে না
তারা মনেই করে নিজেরা সব আইনের ঊর্ধ্বে আমাদের জনগণও তাই তারাও চায় তাদের দাবীদাওয়া অন্যেরা মানুক, নিজেরা মানবে না নিরাপদ সড়কের দাবীতে মিছিলে গিয়ে নিজেরাই দেখবে কয়েকটা গাড়ি ভাঙবে বা গাড়িতে আগুন দেবে আইন অমান্য করাটা আমাদের রক্তে মিশে আছে তাই পরিবর্তনটা শুরু করতে হবে নিজেদের থেকেই 
- কিন্তু সেটা তো এমনি এমনি হবে না
তার জন্যেও তো কিছু করা দরকার
- সব কিছুর আগে দরকার এই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানুষের ইচ্ছা
আমরা কি তা চাই? মনে হয় না আমরা যে কোন  সমস্যার মূল না খুঁজে আপাত কারণ খুজি, সরকার বা অন্য কাউকে দোষারোপ করি যেমন সড়ক দুর্ঘটনায় সড়কের বা ঐ দফতরের মন্ত্রীর অথচ অভিজ্ঞতা বলে এই ঘটনাগুলো ঘটছে সব সরকারের আমলেই এবং কোন সরকারই এর সমাধানে তেমন যত্নবান নয় রাশানে একটা কথা আছে, যদি তারারা জ্বলে তার মানে এটা কারো না কারো দরকার আমারও মনে হয় যদি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে সেখানে কেউ না কেউ লাভবান হয় আর যারা লাভবান হয় তারা নিশ্চয়ই খুব ক্ষমতাধর ফলে সরকারও এ নিয়ে বেশি দূর এগোতে চায় না কিন্তু আমাদের জনগণ এতো কিছুর পরেও দুই দলের বাইরে চিন্তা করে না, চিন্তা করতে পারে না মুলে আঘাত করতে ভয় পায় যতক্ষণ না আমরা এই দ্বিদলীয় রাজনৈতিক চেয়ার খেলা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব ততক্ষন কোন বন্ধনই কোন ফল দেবে না দরকার নিজেদের স্টেরিওটাইপ ভাঙ্গা  তাই মানব বন্ধনটা হোক তাদের নিয়ে যারা সত্যিকার অর্থেই নিজেকে বদলাতে চায়, নিজেকে বদলায় এই দেখ আমাদের দেশে লোকজন যেখানে সেখানে নোংরা ফেলে, থুথু ফেলে এটা কিন্তু চাইলেই নিজেরা বন্ধ করতে পারে এ জন্যে সরকার, পুলিশ, বিরোধী দল কিছুরই দরকার হয় না যদি কিছু লোক মানব বন্ধন করে এটা শুরু করে, আমার বিশ্বাস কিছুটা হলেও সমাজ বদলাবে সড়কসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা অন্যের উপর নির্ভরশীল, মানে আমরা দাবী করছি, কেউ এটাকে মানছে বা মানছে না এখানে হার জিতের সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি, আর নোংরা ফেলানো বা না ফেলানো পুরোপুরি আমাদের উপর আমাদের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে – এখানে জয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি যেকোনো কাজ বা আন্দোলনই হোকনা কেন, যদি তুমি সাফল্য দেখাতে পার, লোকে তোমার সাথে আসবে না পারলে দূরে যাবে আমার যতদূর জানা আছে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে গান্ধীজী গ্রামাঞ্চলে স্যানাটরি ব্যবস্থার উন্নয়ন দিয়েই শুরু করেছিলেন তাই আস আমরা নিজেদের দিয়ে শুরু করি আমরা বলি, আমরা দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের ভোট দেব না, আমরা যেখানে সেখানে নোংরা ফেলবো না, আমরা বিপদজনক ভাবে গাড়ি চালাব না বা রাস্তা পার হব না আমরা ঘুষ দেব না বা ঘুষ নেব না  আমরা নিজ নিজ জায়গায় যদি সৎ থাকি আমার বিশ্বাস সমাজটাও ধীরে ধীরে বদলাবে এখন বদলায় না, কারণ সবাই সবাইকে ফাঁকি দিতে চায়, সবাই পুকুরে দুধের বদলে জল ঢালে এই অভ্যাস বদলের ডাক দিয়ে যদি মানব বন্ধন কর, ডেকো আসব 
দুবনা, ২৪ অক্টোবর ২০১৮                   


 



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি