বাসা বদল

রুশরা বলে দু' বার বাসা বদল একবার বাসায় আগুন লাগার সমান। কেন ওরা এটা বলে সেটা ঠিক জানি না, তবে মনে হয় বাসা বদলের সময় যেহেতু প্রচুর অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ফেলে দেওয়া যায়, সে কারণেই এই প্রবাদ। বিশ বছরের উপরে থাকার পর শেষ পর্যন্ত এ বাসাটা ছাড়ছি, তাই ধারনা ছিল পাহাড় প্রমাণ জিনিসপত্র ফেলে একটু হালকা হব। তবে সে আশার গুড়ে বালি।

আমার বাসা অনেকটা গোডাউন মত। দুবনায় আসি ১৯৯৪ সালে, তখন থাকতাম হোস্টেলে। ছাত্র জীবনের উত্তরাধিকার ছিল কয়েকশ' বই, শ' পাঁচেক করে এল পি রেকর্ড আর ক্যাসেট। আর ক্যামেরা, লেন্স ইত্যাদি। সেগুলো তখন মস্কোয় রেখে আসি। গুলিয়া আন্তন আর মনিকাকে নিয়ে দুবনা আসে ১৯৯৬ সালে। ঘর ভরতে থাকে বাচ্চাদের বই, খেলনা আর জামাকাপড়ে। এখানে এরপর ঘরে আসে ক্রিস্টিনা আর সেভা। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে
জিনিসপত্র। আমাদের তিন রুমের ফ্ল্যাট হয়ে ওঠে বাচ্চাদের বই কাম খেলনার দোকান।

২০০৯ সালে মতানইক্য। সে থেকে গুলিয়ার বাচ্চাদের নিয়ে মস্কো চলে যাওয়া। ২৪ ঘণ্টার বাবার চাকরি থেকে আমার অব্যাহতি। আমি হই রবিবারের পাপা।

এদেশে জামাকাপড়ের দিক থেকে মানুষ অনেকটা বাঁধা কপির মত। শীতে কাপড়ের ওপর কাপড়। খুলছি খুলছি, কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। যেন কুরু সভার পাঞ্চালী। বসন্তের শুরু থেকে একটা একটা করে কাপড় কমতে থাকে আর গ্রীষ্মে তো উদোম না হলেও শর্ট আর টি-শার্ট। শরতে আবার ধীরে ধীরে একের পর এক কাপড় পরার পালা। তাই সে সময় আমার কাজই ছিল দরকারি পোশাক মস্কোয় নিয়ে যাওয়া আর অপ্রয়োজনীয়গুলো দুবনায় নিয়ে আসা। বাচ্চারা বড় হওয়ার সাথে সাথে ওদের ছোট হয়ে যাওয়া জিনিসপত্রের পার্মানেন্ট ঠিকানা আমার বাসা। তাই ঘর ভর্তি শুধু জিনিস আর জিনিস। পার্মানেন্ট ঠিকানা পেয়েছে একযুগ আগে মরে ভূত হয়ে যাওয়া টিয়ে, খরগোশ, গিনিপিগ, বিড়ালদের খাঁচা, থালা বাসন ইত্যাদি। যেন মিউজিয়ামের আইটেম একেকটা!

তিন রুমের বাসার দু রুমই এসব দিয়ে ভরা। ও দু' রুমে আর ঢোকাই হয় না। বাসায় কি আর করা। রান্না ঘরে কোনমতে কিছু রান্না করা, অন্য ঘরে ঘুমানো বা কম্পিউটারে বসে কাজ করা। এ যেন বাড়ি নয়, রেল স্টেশন। গাড়ির অপেক্ষার ফাঁকে ফাঁকে একটু শুয়ে বসে সময় কাটানো। বেশ চলছিল এভাবে। বাদ সাধল গুলিয়া। ২০১৭ দুবনায় ফিরে এলো। ২০০৭ এ আমরা এখানে একটা ফ্ল্যাট কিনেছিলাম, পড়েই ছিল এতদিন। ঠিক করল ও দুবনায় থাকবে। বাসা ঠিক করা হোল। ২০১৭র ডিসেম্বরে ওরা এলো। আমি বিভিন্ন অজুহাতে দু' বছর অফিসের বাসায়ই কাটিয়ে দিলাম। কখনও ওর ওখানে খাই, কখনও আমার এখানে ও আসে। বিল্ডিং দুটো পাশাপাশি, তাই অসুবিধা হয় না। গুলিয়া পীড়াপীড়ি করে থেকে যেতে, আমি থাকি না। আজও পর্যন্ত আমাদের বাসায় রাত কাটাইনি। গুলিয়া বলে আগন্তুক বর।

বছর পনের আগে আমাদের ইন্সটিটিউট তার কর্মীদের উৎসাহিত করত ফ্ল্যাট কিনতে। ও সময় অনেকেই চলে গেছিল নিজেদের ফ্ল্যাটে। অনেক বাসাই তাই খালি পড়ে থাকত। ফলে আমার তিন রুমের বাসায় একা থাকা নিয়ে কেউ কোন কথা বলেনি। ইদানীং অনেক নতুন লোকজন আসতে শুরু করেছে দুবনায় বিভিন্ন দেশ থেকে। ফ্ল্যাটের এখন বড়ই অভাব। ওখানেও কিভাবে জেনে গেছে আমার বৌয়ের একটা ফ্ল্যাট আছে দুবনায়। ফলে বেশ কয়েক মাস হল বলতে শুরু করেছে আমি যেন ফ্ল্যাট ছেড়ে দিই। বললাম আরও এক বছর সময় দিতে। ওরা বলল, ঠিক আছে, তবে সেক্ষেত্রে কমার্শিয়াল রেটে ভাড়া দিতে হবে। ছয় থেকে তিরিশ হাজার এটা বড্ড বাড়াবাড়ি, তাছাড়া বউকে বোঝানো যাবে না এই অযথা খরচ। তাই এখন বাসা ছাড়ার তোরজোড়।

এজন্যে প্রথমে দরকার অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ফেলে দেওয়া আর প্রয়োজনীয় জিনিস বিভিন্ন জায়গায় (নিজেদের ও বাচ্চাদের ওখানে) চালান করা। গুলিয়া আসে এসব বাছাই করতে। আন্তন এলো মস্কো থেকে।

- ওখানে কি?
- পাপার জিনিসপত্র।
- ফেলে দে।
আন্তনকে বললাম, সব কিছুই বলবি পাপার, তাহলে বোঝা কমবে। কিন্তু সেটি হওয়ার নয়।
- এটা রাখার কি দরকার?
- এটা আমি দেতস্কি মির থেকে মনিকার জন্য কিনেছিলাম।
- তাতে কি? এসব রাখবে কোথায়?
- খাটের নীচে।
- খাটের নীচেই যদি থাকে, তাহলে রাখার দরকার কি? ফেলে দিলেই তো ঝামেলা মিটে যায়।
- তুমি বুঝবে না।
- এত জিনিসপত্র নিয়ে তোমাকে তো নরকেও ঢুকতে দেবে না?
- নরক কেন?
- তোমার লাগেজের ওভার ওয়েট দেখে স্বর্গের দরজা তো দূরের কথা, ঐ রাস্তাই মারাতে দেবে না।
- সেটা তখন দেখা যাবে। এখন আমার এসবই চাই।
- তুমি তো চেয়েই খালাস। আমার সরকারি পা, সরকারি পিঠ।

সবচেয়ে বড় কথা হল এইসব জিনিসপত্র ছেলেমেয়েদের ওখানে রাখতে গিয়ে ওদের প্রতিবাদ মিছিলের তোপটা আমাকেই সামলাতে হবে। বাসা বদলানো তো নয়, রীতিমত যুদ্ধ!

দুবনা, ০৫ জানুয়ারি ২০২০











Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি