ছোট মানুষের ছোট গল্প
গত ২৪ জানুয়ারি বানিয়াজুরি ইউনিয়ন হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের রি-ইউনিয়ন হল। অনেক আগেই ওরা আমার একটা লেখা চেয়েছিল স্মরনিকার জন্য। জানি না ওটা বেরিয়েছে কি না বা বেরুলেও কিভাবে বেরিয়েছে। প্রথমে ওদের প্ল্যান ছিল ২০১৯ এ রি-ইউনিয়ন করা। আমার মনে হয়েছিল যেহেতু ২০২০ স্কুলের ৭৫ বছর পূর্তি হবে, তাই ডেট একটু পেছানো যায় কিনা সেটা ভেবে দেখতে, সেটা লেখাতেও উল্লেখ করেছি। যাই হোক সে লেখাটাই এখানে আজ পোস্ট করছি। নিজে উপস্থিত থাকতে পারিনি, তবে ফেসবুকে দেখে মনে হল খুব সফল হয়েছে এ অনুষ্ঠান। এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা থাকবেই, থাকবে কি হতে পারত, কি হল না তাঁর চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে এসব আয়োজন মুলত পুরনো বন্ধুদের, সহপাঠীদের সাথে কথা বলা, দেখা করার এক অনন্য সুযোগ করে দেয়। দিনের শেষে মানুষ সেটাই মনে রাখে। সুন্দর অনুষ্ঠানের জন্য সবাইকে অভিনন্দন। দুবনা, ২৬ জানুয়ারি ২০২০
*******************************************************************************
আমার লেখাপড়া শুরু হয় তরা প্রাইমারি স্কুলে ১৯৭০ সালে। তখন স্কুল ছিল বাজারের পাশে, আর স্কুলের সাথেই ছিল গ্রামের মানুষের ঘরবাড়ি। তাই পরিবেশ ছিল ঘরোয়া। স্কুলে ছিল তিনটে মাত্র ঘর, ক্লাস হত দুই শিফটে। সকালে বি, ওয়ান, টু আর দুপুর থেকে বিকেল চারটে অবধি থ্রি, ফোর, ফাইভ। এখন অবশ্য বি ক্লাস বলে কিছু নেই। বি খুব সম্ভব বেবি থেকে, তবে ঠিক জানি না। এখন সে জায়গায় নার্সারি, কেজি ইত্যাদি এসেছে। স্কুলের সম্পদ বলতে একটা টিউব ওয়েল আর একটা জাম গাছ। কালো জাম নয়, ছোট জাম। ওই জাম আমরা যতটা না খেতাম তার চেয়ে বেশি ব্যবহার করতাম বাঁশের পিস্তলের গুলি হিসেবে। স্কুলের সামনে যে বাজার সেখানে ছিল পোস্ট অফিস আর বিশাল এক কড়ই গাছ। পঞ্চাশ বছর আগের মতই সে গাছটা এখনও বহাল তবিয়তে আছে আর আগের মতই বাজারে আসা লোকজনদের ছায়া বিলিয়ে যাচ্ছে। আমরা অবশ্য টিফিনের সময় গাছের বিশাল কাণ্ডটার মাঝে বসে চানাচুর খেতাম আর গল্প করতাম। সে ছিল আমাদের গোল টেবিল। স্কুলের সামনে বাজার ঘেঁষে ছিল একটা পুকুর, যদিও পুকুর না বলে ডোবা বললেই বেশি মানায়। পরে আমরা ওই ডোবার পাশ দিয়ে কিছু গাছ লাগিয়েছিলাম, তবে ওসব বড় হওয়ার আগেই স্কুল নতুন জায়গায় চলে যায়। তখন অবশ্য আমি প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে অনেক আগেই চলে গেছি অন্য স্কুলে। হারান সূত্রধর ছিলেন আমাদের হেড মাস্টার যাকে আমরা বড় মাস্টারমশাই বলে ডাকতাম। তাঁর ছেলে গোবিন্দ স্যারও স্কুলেই চাকরি করতেন। এছাড়া অনাথ সূত্রধর পরিচিত ছিলেন ছোট মাস্টারমশাই নামে। এরা সবাই তরা গ্রামের। চতুর্থ শিক্ষক ছিলেন সরফরাজ স্যার। উনি স্কেলের কোনা দিয়ে ছাত্রদের মারতেন, তাই তাঁকে পেছনে ডাকা হত ঘারা স্যার নামে। তবে স্বাধীনতার পরপরই বড় মাস্টারমশাই ইন্ডিয়া চলে যান। তাঁর জায়গায় আসেন গাংডুবির বিষ্ণুপদ সরকার। হারান মাস্টারমশাই ছিলেন খুব কড়া। অত্যন্ত শক্তিশালী চশমার পুরু কাঁচের ভেতর দিয়ে তাঁর চোখদুটো যেন আগুনের গোলার মত জ্বলত। সে তুলনায় নতুন মাস্টারমশাই ছিলেন হাসিখুশি। প্রায়ই তাঁর ছেলে বিচিত্র আসতো আমাদের স্কুলে। আমাদের বয়েসি। পরে এক সাথে হাই স্কুলে পড়েছি আমরা। এছাড়া আসেন গাংডুবির সত্য স্যার, সোলধারার আমজাদ স্যার। সত্য স্যার অবশ্য কিছুদিন পরেই পিটিআই ট্রেনিং নিতে চলে যান। ভিন্ন ভিন্ন গ্রাম থেকে নতুন শিক্ষক আসার পরেও আমাদের স্কুল তার ঘরোয়া পরিবেশ বজায় রাখে। ১৯৭৪ সালে ক্লাস ফাইভে যখন পড়ি তখন ঠিক হয় স্কুলে একটা মাঠ অত্যাবশ্যক। পাশেই ছিল এক খণ্ড নীচু জমি। আমরা গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে সই সংগ্রহ করি। তখন তরা গ্রামে কালীগঙ্গা সড়ক সেতু নির্মাণ শেষ পর্যায়ে। ওদের কাছে আবেদন করলে আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে সেই নীচু জমি ভরাট করে দু’দিনেই মাঠ করে দেয়। স্কুল শুধু প্রিয়ই নয়, একান্ত আপন হয়ে ওঠে। তবে সেই আত্মীয়তা বেশিদিন বজায় থাকেনি। পঁচাত্তরের শুরুতে আমরা হাইস্কুলে চলে যাই। ভর্তি হই বানিয়াজুরি ইউনিয়ন হাই স্কুলে।
বানিয়াজুরি আমাদের পাশের গ্রাম। স্কুল বাড়ি থেকে প্রায় এক মাইল দূরে। হাঁটা পথ চলে গেছে ফসলি জমির ভেতর দিয়ে। বর্ষায় যখন মাঠ জলের নীচে ডুব দিত, স্কুলে যেতাম ঢাকা আরিচা রোড ধরে। তখন গাড়ি ঘোড়া তেমন ছিল না, যদিও ক্রস ব্রীজের ওখানে সবাই সতর্ক হয়ে চলতাম। জায়গাটা দুর্ঘটনার জন্য বিখ্যাত ছিল। যাহোক, যেহেতু আমার দাদা দিদিরা অনেকেই ওই স্কুলে পড়ত, তাছাড়া সুধীর দা এই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন তাই স্কুলটা আমার কাছে অপরিচিত কিছু ছিল না। তাছাড়া বানিয়াজুরি রথের মেলা ও শিবরাত্রির মেলায় যেতাম ও পথ ধরেই। এলাকার ফুটবল খেলা হত স্কুলের মাঠেই। শুধু সুধীর দা নয়, আমাদের গ্রামের তুলসী স্যার, নরেশ স্যার, আতাব আলী স্যার, মৌলবী স্যার সবাই তখন ওই স্কুলের শিক্ষক। এ ছাড়া ছিলেন নুরু স্যার (তখন ক্লার্ক, পরে উনি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন, তাঁর জায়গায় আসে আমাদের গ্রামেরই বাদশাহ ভাই)। এ ছাড়া দফতরি হিসেবে ছিলেন রহমান ভাই। সব মিলে তখন স্কুলের স্টাফের এক বিরাট অংশই তরার। আর ছাত্রছাত্রীদের কথা বললে বলতেই হবে স্কুলের প্রায় অর্ধেক ছেলেমেয়ে যেত তরা গ্রাম থেকে। শুধু কি তাই? স্কুলটাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তরা গ্রামের জমিদার ত্রৈলোক্য নাথ মজুমদারের দান করা জমিতেই। তখন স্কুল বলতে ছিল দুটো একতলা বিল্ডিং আর দুটো টিন শেড ঘর। লেখা ছিল “বানিয়াজুরি ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয়, ১৯৪৫ ইং”। যদিও জানতাম গ্রামের অনেক বাড়িঘর অনেক পুরনো, তবে এটাই একমাত্র বিল্ডিং যাতে খোদাই করে সনটা লেখা ছিল যা আমাকে প্রায়ই অবিভক্ত ভারতবর্ষের কথা মনে করিয়ে দিত। আমাদের ক্লাস হত মূলত টিনের ঘরে। একটা বিল্ডিং ছিল প্রশাসনিক, তাতে তিনটে ঘর। একটা হেড স্যার আর তার সহকারী বসতেন। সহকারী ছিলেন তুলসী স্যার। অন্য রুম ছিল শিক্ষকদের মিলনায়তন। ক্লাসের ফাঁকে বা কোন ঘন্টায় কারো ক্লাস না থাকলে শিক্ষকবৃন্দ সেখানে বসে সময় কাটাতেন। ওখানেই ছিল স্কুলের লাইব্রেরি। পণ্ডিত স্যার ছিলেন তার দায়িত্বে। অন্য রুম বোর্ডিং কাম নামাজ ঘর। ইসলাম ধর্ম এবং আরবী ক্লাসও সেখানে হত। হিন্দু ধর্ম এবং সংস্কৃত ক্লাস হত পাশেই একটা রুমে। সংস্কৃত পড়াতেন পণ্ডিত স্যার। খুব কঠিন লাগত। আমার খুব ইচ্ছে ছিল আরবীতে নিজের নাম লেখার। আতাব আলী স্যার সেটা শিখিয়েছিলেন। কী স্কুলে, কী আজ একটা প্রশ্ন আমার মনে বার বার উঁকি দেয়। আলিফ, বে, তে, ছে এই আরবী বর্ণমালার সাথে আলফা, বেটা, থেটা, সিগমা এসব গ্রীক বর্ণমালার মিল। এক সময় আরবরা চীন, ভারত ও ইউরোপের মধ্যে সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করত। তাদের মাধ্যমেই ভারতীয় গণিত ইউরোপে যায়। গ্রীক সভ্যতার স্বর্ণযুগ ছিল খ্রিস্টের জন্মেরও অনেক আগে। আরবরা কী তাহলে গ্রীক দেশ থেকে তাদের বর্ণমালা ধার করেছিল?
অন্য যে বিল্ডিংটা ছিল সায়েন্স বিল্ডিং। তার এক রুমে হত পদার্থবিদ্যা, বাইওলজি আর রসায়নের
প্র্যাক্টিক্যাল, অন্য রুমে আলজেব্রা, পদার্থবিদ্যা, বাইওলজি ও রসায়নের ক্লাস। এই বিল্ডিংএর
পশ্চিমে ছিল শহীদ মিনার আর দক্ষিণে পুকুর। আমাদের স্কুল জীবনের শেষের দিকে সেই পুকুরে তেলাপিয়া
মাছের চাষ শুরু হয়।
আমাদের স্কুল শুরু হত, যদি ভুল না করি সকাল এগারোটায়। আমি যখন ভর্তি হই, রবিবার ছিল ছুটির দিন আর শুক্রবার মর্নিং স্কুল। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পরে অবশ্য শুক্রবার ছুটি হয় আর মর্নিং স্কুল হয় রবিবার। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যেতাম ফুটবল খেলতে, এরপর ছিল চায়ের আসর, প্রাইভেট পড়া (কখনও গ্রামের অন্য স্যারদের কাছে, কখনও সুধীর দার কাছে)। প্রাইভেট শেষে ভাত খেয়ে স্কুলে যেতাম। সে সময় আজকের মত এত রাস্তাঘাট ছিল না। আজকের রাস্তাগুলো তখন ছিল খাল। শুকনো মরশুমে হাঁটা পথ, বর্ষায় নৌকা। আমরা প্রায়ই যেতাম জমির আল (দুই জমির মাঝে সরু সীমানা চিহ্ন) ধরে। একবার জমিদার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছলেই পেতাম প্রশস্ত রাস্তা। ওই রাস্তা ধরে আশু বাবু আর প্রফুল্ল চক্রবর্তীর বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যেতাম। ওখান থেকে দেখা যেত দ্বীপের মত আমাদের স্কুলটি। মাঝে বা আশেপাশে কোন বাড়িঘর ছিল না। কখনও যেতাম ঋষি পাড়ার ওদিক দিয়ে, কখনও আমাদের নিজেদের জমির পাশ দিয়ে। সেখানে শ্যাওড়া গাছ আমাদের ভূতের ভয় দেখাত। আশুবাবুর বাড়ির ওখানে গ্রামের বিভিন্ন পাড়া থেকে একের পর এক জড় হত স্কুলের ছেলেমেয়েরা, এ যেন ছোট ছোট ঝর্ণা মিলে নদীতে পরিণত হওয়া। মটরশুঁটির সময়ে আমরা প্রায়ই নেমে পড়তাম সেগুলো তুলতে। চুনী বসাক আর আমাদের জমি ছিল মূল লক্ষ্য। এছাড়া প্রায়ই কলাই পুড়িয়ে খেতাম শীতের শেষে। তবে সেটা ছিল ফেরার পথে।
আমি যখন স্কুলে ভর্তি হই আমার বড় ভাই রতন তখন এসএসসি দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওই সময় হল স্কুলের সংসদ নির্বাচন। তখনও এসব নির্বাচন ঠিক বুঝি না। মনে আছে ভি পি পদে দাঁড়িয়েছিল ব্রজেনদা আর শওকত ভাই। দু জনেই খেলাধুলায় ভালো ছিল। তখনই প্রথম স্কুলের দেওয়ালে দেখি জাসদের দেওয়াল লিখন। গ্রামে সাধারণত এসব দেখা যেত না। টিন বা বাঁশের দেওয়াল বলে সেখানে পোস্টার লাগানো হত। তাও মূলত চেয়ারম্যান বা মেম্বার পদে ভোট চেয়ে। দেওয়াল লিখনের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭২ সালে কোলকাতায়। নক্সালদের লেখা এসব শ্লোগান ভর্তি ছিল ফাঁসির দাবীতে। তাই এসবের প্রতি আমার তখন কোন আগ্রহ তো ছিলই না, বরং ভয় ছিল।
আমাদের স্কুল শুরু হত, যদি ভুল না করি সকাল এগারোটায়। আমি যখন ভর্তি হই, রবিবার ছিল ছুটির দিন আর শুক্রবার মর্নিং স্কুল। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পরে অবশ্য শুক্রবার ছুটি হয় আর মর্নিং স্কুল হয় রবিবার। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যেতাম ফুটবল খেলতে, এরপর ছিল চায়ের আসর, প্রাইভেট পড়া (কখনও গ্রামের অন্য স্যারদের কাছে, কখনও সুধীর দার কাছে)। প্রাইভেট শেষে ভাত খেয়ে স্কুলে যেতাম। সে সময় আজকের মত এত রাস্তাঘাট ছিল না। আজকের রাস্তাগুলো তখন ছিল খাল। শুকনো মরশুমে হাঁটা পথ, বর্ষায় নৌকা। আমরা প্রায়ই যেতাম জমির আল (দুই জমির মাঝে সরু সীমানা চিহ্ন) ধরে। একবার জমিদার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছলেই পেতাম প্রশস্ত রাস্তা। ওই রাস্তা ধরে আশু বাবু আর প্রফুল্ল চক্রবর্তীর বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যেতাম। ওখান থেকে দেখা যেত দ্বীপের মত আমাদের স্কুলটি। মাঝে বা আশেপাশে কোন বাড়িঘর ছিল না। কখনও যেতাম ঋষি পাড়ার ওদিক দিয়ে, কখনও আমাদের নিজেদের জমির পাশ দিয়ে। সেখানে শ্যাওড়া গাছ আমাদের ভূতের ভয় দেখাত। আশুবাবুর বাড়ির ওখানে গ্রামের বিভিন্ন পাড়া থেকে একের পর এক জড় হত স্কুলের ছেলেমেয়েরা, এ যেন ছোট ছোট ঝর্ণা মিলে নদীতে পরিণত হওয়া। মটরশুঁটির সময়ে আমরা প্রায়ই নেমে পড়তাম সেগুলো তুলতে। চুনী বসাক আর আমাদের জমি ছিল মূল লক্ষ্য। এছাড়া প্রায়ই কলাই পুড়িয়ে খেতাম শীতের শেষে। তবে সেটা ছিল ফেরার পথে।
আমি যখন স্কুলে ভর্তি হই আমার বড় ভাই রতন তখন এসএসসি দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওই সময় হল স্কুলের সংসদ নির্বাচন। তখনও এসব নির্বাচন ঠিক বুঝি না। মনে আছে ভি পি পদে দাঁড়িয়েছিল ব্রজেনদা আর শওকত ভাই। দু জনেই খেলাধুলায় ভালো ছিল। তখনই প্রথম স্কুলের দেওয়ালে দেখি জাসদের দেওয়াল লিখন। গ্রামে সাধারণত এসব দেখা যেত না। টিন বা বাঁশের দেওয়াল বলে সেখানে পোস্টার লাগানো হত। তাও মূলত চেয়ারম্যান বা মেম্বার পদে ভোট চেয়ে। দেওয়াল লিখনের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭২ সালে কোলকাতায়। নক্সালদের লেখা এসব শ্লোগান ভর্তি ছিল ফাঁসির দাবীতে। তাই এসবের প্রতি আমার তখন কোন আগ্রহ তো ছিলই না, বরং ভয় ছিল।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে জীবনের গণ্ডী তরা গ্রাম ছাড়িয়ে বাইরে চলে গেল। আমাদের সাথে পড়ত জাবরার রকিব, রফিক, ইমরান, কামরান, লুতফর, সোলায়মান, ডলা, বানিয়াজুরির সাহাদত, খলিল, লোকমান, বুলবুল, মুসা, জাহীদ, দুর্গাবাড়ির মধু, দ্বীজেন, দীনবন্ধু, বলাই, গাংডুবির বিচিত্র, অখিল, সোলধারার আজিজ, কাকজোরের রাজা, হুমায়ুন, আযম, জোকার পাখি। কাসেম আসত গোয়ালডাঙ্গির পাশের গ্রাম বহুজা থেকে। পরে আমাদের সাথে যোগ দেয় পদ্মা পাড়ের ইমরান আর ঘিওরের প্রদীপ। মেয়েরা অধিকাংশই ছিল তরার। প্রাইমারি স্কুলে আমাদের রুম ছিল সব মিলিয়ে তিনটে। মেয়েদের বা শিক্ষকদের জন্য আলাদা কোন রুম ছিল না। তাই দু ক্লাসের মাঝে যখন শিক্ষক চলে যেতেন ছেলেমেয়েরা সবাই একসাথে হৈচৈ করে সময় কাটাতাম আর আমরা বসতাম আলাদা আলাদা বেঞ্চে। হাই স্কুলে সেটা ছিল না। ক্লাস শেষে মেয়েরা চলে যেত কমন রুমে, আসত শিক্ষক ক্লাসে এলে। তাই মেলামেশা বা কথা বলার সুযোগ ছিল না বললেই চলে, যেটা হত, সেটা স্কুলে যাওয়ার বা স্কুল থেকে ফেরার পথে। তাই এখন অনেকের মুখ বা নাম মনে নেই। যাদের নাম বললাম তাদের বাইরেও অনেকেই ছিল, অনেকের মুখ মনে পড়লেও নাম আর মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে। তরা থেকে যে মেয়েরা স্কুলে আসত তাদের অনেকেরই বিয়ে হয়ে যায় স্কুলের প্রথম দিকেই। শুধু তরা কেন, অন্যান্য গ্রাম থেকে আসা অনেক মেয়েরই স্কুলে পড়ার সময়ই বিয়ে হয়ে যায়। তখন বাল্য বিবাহ বলতে মূলত বোঝাত শিশুকালে বিয়ে, স্কুলের ছেলেমেয়েদের, বিশেষ করে মেয়েদের বিয়েকে গ্রামের লোকজন বাল্যবিবাহ হিসেবে দেখত না। আসলে মেয়েদের শিক্ষা, চাকরি – এসব তখনও সমাজ ঠিক ভাল চোখে দেখত না। এখনও যে এর বিরোধিতা কেউ করে না তা নয়, তবে মেয়েদের আর তাদের অভিভাবকদের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতা বেড়েছে, শত বাধার পরেও জীবন নিজেই মেয়েদেরকে শিক্ষার আলোয় ঠেলে দিচ্ছে। হাই স্কুলে এসে আমার বিশ্ব অল্প ক’দিনেই বিস্তারিত হল বানিয়াজুরি ইউনিয়নের আনাচে কানাচে, এমন কি সেটা ছাড়িয়ে গেল এর বাইরেও। যদিও বাংলার গ্রামগুলো দেখতে একই রকম, তবুও গভীর আগ্রহে অন্যদের গ্রামের গল্প শুনতাম, মনে হত অন্য গ্রামগুলো অন্য রকম রহস্যে ঘেরা। সেখানে জীবন যাত্রা অন্য রকমের। শুধু কী তাই, দেখা গেল বিভিন্ন গ্রামে কথাবার্তার ধরণটাও একটু ভিন্ন।
আমি যখন বানিয়াজুরি স্কুলে ভর্তি হই, তখন প্রধান শিক্ষক ছিলেন সিরাজ স্যার। খুব বদমেজাজি বলে খ্যাতি ছিল তাঁর। টিফিনের পরে বেত হাতে ঘুরে বেড়াতেন সারা স্কুল আর কাউকে বাইরে পেলেই সপাং সপ। উনি অবশ্য কিছুদিন পরে ওকালতি করতে মানিকগঞ্জ চলে যান। হক স্যার আসতেন নবগ্রাম থেকে। ভারিক্কি মানুষ। পরে নবগ্রাম স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ছিলেন হবিবুর স্যার। উনি থাকতেন স্কুলের বোর্ডিংএ। গাংডুবি থেকে আসতেন ক্ষিতীশ স্যার। অংকের ক্লাস নিতেন। ছিলেন দুর্গাবাড়ির হরমোহন স্যার আর তাঁর ভাই প্রফুল্ল স্যার। পরে অবশ্য প্রফুল্ল স্যার ইন্ডিয়া চলে যান। পন্ডিত স্যার পড়াতেন বাংলা, খুব রাশভারি লোক, আসতেন সাইকেলে চড়ে বরঙ্গাইল থেকে। সবাই সমীহ করে চলত তাঁকে। বাংলা, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গল্প পড়াতে গিয়ে কী সুন্দর করে ব্যাখ্যাই না করতেন তিনি। ওনার হাত ধরেই আমার রুশ সাহিত্য পড়া শুরু। এর আগে অবশ্য ছোটদের গল্প অনেক পড়েছি, মানে রুশ দেশের উপকথা এসব আর কী! উনিই আমাকে প্রথম পড়তে দেন চেখভ। বাড়িতে আমাদের বই ছিল প্রচুর, সবারই নিজ নিজ ছোটোখাটো একেকটা করে সংগ্রহশালা ছিল। ছোটদের জন্য সম্পাদিত বিশ্ব সাহিত্যের অনেক কিছুই আগে পড়া ছিল, তবে ওই প্রথম মনে হয় সিরিয়াস কিছু পড়া। এর পর আসে গোর্কি, দস্তয়েভস্কি, তলস্তয় আরও কত কী! সিরাজ স্যার চলে গেলে কয়েক দিনের জন্য প্রধান শিক্ষক হিসেবে আসেন খলিল স্যার। উনি আগেও এই পদে ছিলেন। প্রচণ্ড কড়া নাকি ছিলেন। সেই সময় বালিয়াটি না কোথায় যেন প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। তবে কোন কারণে উনি নিয়োগ পাননি। তাঁর পরিবর্তে এলেন গোলাম হোসেন স্যার। উনি নদীর ওপার থেকে আসতেন। বিশাল দেহ, কালো আর হাসিখুশি মানুষ। বানিয়াজুরি স্কুল এলাকায় বেশ নামকরা ছিল তার শিক্ষকদের জন্য। যার ফলে অন্যন্য ইউনিয়ন থেকেও এখানে পড়তে আসত ছেলেমেয়েরা। শিক্ষক হিসেবে গোলাম হোসেন স্যার হয়ত অন্যদের মত তত নামকরা ছিলেন না, তবে মানুষ হিসেবে খুব ভালো, সাদাসিধে ছিলেন। আমাদের অন্যান্য প্রধান শিক্ষকদের দেখে ছাত্রছাত্রীরা ভয়ে কাঁপত। ওনার ক্ষেত্রে সেটা লক্ষ্য করিনি। তবে স্কুলের রাজনীতির কারণে ওনাকে এক সময় চলে যেতে হয়। তাঁর জায়গায় আসেন রাজ্জাক স্যার। উনি অবশ্য স্থানীয়, বানিয়াজুরির মানুষ। উনি সিরাজ স্যারের মত কড়া ছিলেন না, তবে গোলাম হোসেন স্যারের মত নরমও ছিলেন না। মাঝে কিছুদিন আমাদের পড়াতেন করিম স্যার। পরে কেল্লাই-এ নতুন স্কুল হলে তিনি সেখানে চলে যান প্রধান শিক্ষক হিসেবে। বর্তমানে ওকালতি করেন। আমার স্কুলের শেষের দিকে যোগ দেন আমিনুর স্যার। উনি তপন দার বন্ধু, তাই সম্পর্কটা অন্য রকম ছিল। আরও ছিলেন রাজ্জাক স্যার। তেরশ্রীর। প্রথমে আমাদের বাড়িতেই ছিলেন, পরে স্কুলের বোর্ডিংএ চলে যান। উনি ছিলেন শরীর চর্চার শিক্ষক। সে সময় বেত ছিল কমন, মানে কেউ পড়া না পারলে বা দুষ্টুমি করলে বেত দিয়ে মারা ছিল কমন প্র্যাকটিস। কিছু কিছু শিক্ষক ছাত্রদের মেরে এক ধরণের আনন্দই পেতেন, শিক্ষক যে ছাত্রদের চেয়ে উপরের শ্রেনীর সেটা ভেবে আত্মতুষ্টি পেতেন। আবার কিছু কিছু শিক্ষক বাধ্য হয়ে সেটা করতেন। বোঝা যেত তাঁরা এরকম শাস্তি উপভোগ করছেন না, তবে উপায় নেই বলে সেটা করতেন। তাঁরা মারতেন চোখ বন্ধ করে, ভয়ে ভয়ে পাছে ছাত্র ব্যথা পায়।
আমাদের ক্লাস ছিল বিভিন্ন দিক দিয়ে স্কুলের সেরা ক্লাসগুলোর একটা। বিচিত্র, কাসেম, অখিল, মধু, মন্টু, রাজা মিয়া, আমি – আমাদের নিয়ে সবার
খুব আশা ছিল। পরে অবশ্য মধু
আর মন্টু মানিকগঞ্জ সরকারী স্কুলে চলে যায়। লুতফর
আর সাহাদত ছিল খেলাধুলায় চ্যাম্পিয়ন। লুতফর
১০০ মিটার দৌড়ে দেশের সেরাদের একজন ছিল। স্কুলের বাইরেও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ
নিত। ১০ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়ের স্বপ্ন ছিল
ওর। যদি ভুল না করি ওর নিজস্ব রেকর্ড ছিল ১১
সেকেন্ড।
আমার স্মৃতিতে শুধু আমাদের ক্লাসের কথা উঠে এলেও তার মানে এই নয় যে অন্য কোন ক্লাসের কারো কথা মনেই নেই বা অন্য কোন ক্লাস ছিল না। তবে অন্যান্য ক্লাসের সেই সব ছেলেমেয়েদের কথাই মনে আছে যারা কোন না কোন ভাবে তাদের প্রকাশ করত। আমাদের সময়ে ক্রিকেট ছিল শহুরে খেলা, আমাদের এলাকার গ্রামে তার কোন অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। ফুটবল ছিল এক নম্বর খেলা। তাই এলাকার ফুটবলারদের নাম ছিল মুখে মুখে। জাবরার লাভলু ভাই ভালো খেলত। আমাদের বছর তিনেকের সিনিয়র। পরে শুনেছি ঢাকায় কোন এক ক্লাবে খেলেছে। অদুদ ভাই তাদের ক্লাসের গোলী। গিলন্ডর মুন্নাফ ভাই খেলত ফুল ব্যাক পজিশনে। পরে আর্মিতে যোগ দেয়, শুনেছি সেখানেও রেগুলার খেলেছে। আমাদের ঠিক দু বছরের আগের ক্লাসে ভালো ফুটবল খেলত অমূল্য দা, আবুল ভাই। ওদের ক্লাসই স্কুলের চ্যাম্পিয়ন ছিল। আবুল ভাইয়ের শূন্যে লাফিয়ে ব্যাক কিক ছিল দেখার মত। আমাদের ক্লাসে অনেকেই খেলত। ভালো খেলত অনেকেই। লুতফর, সাহাদত, দীনবন্ধু, প্রদীপ, বুলবুল...। ওই সময়ে এলাকায় যারা ভালো ফুটবল খেলত তারা সবাই জাবরার নবারুণ সংঘ বা বানিয়াজুরির বা রা ঠা উত্তরণ সংঘের সাথে জড়িত ছিল। স্কুলের শরীর চর্চার শিক্ষক থাকলেও সংস্কৃতি চর্চার কোন বালাই ছিল না। কোথাও থাকে বলেও মনে হয়না। তবে অনেক স্কুলেই সংস্কৃতিমনা কোন শিক্ষক থাকলে নিজেদের উদ্যোগে গান বাজনা, নাটক এসব করেন। আমাদের স্কুলে এরকম উদ্যোগী কেউ ছিলেন না। ফলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান বাজনা, কবিতা এসব হত ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের তাগিদে। আমরা যখন ক্লাস নাইন বা টেনে পড়ি আমাদের ক্লাসে এক নতুন মেয়ে আসে ঢাকা থেকে। ওদের বাড়ি এমনিতে জাবরা। নাম মনে হয় হাসিনা। আসার পরপরই আমাদের এক স্কুল ফাংশনে ও কাজী নজরুল ইসলামের কাঠবিড়ালি কবিতা পাঠ করে। এরপর থেকে ওর নামই হয়ে যায় কাঠবিড়ালি।
আমার স্মৃতিতে শুধু আমাদের ক্লাসের কথা উঠে এলেও তার মানে এই নয় যে অন্য কোন ক্লাসের কারো কথা মনেই নেই বা অন্য কোন ক্লাস ছিল না। তবে অন্যান্য ক্লাসের সেই সব ছেলেমেয়েদের কথাই মনে আছে যারা কোন না কোন ভাবে তাদের প্রকাশ করত। আমাদের সময়ে ক্রিকেট ছিল শহুরে খেলা, আমাদের এলাকার গ্রামে তার কোন অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। ফুটবল ছিল এক নম্বর খেলা। তাই এলাকার ফুটবলারদের নাম ছিল মুখে মুখে। জাবরার লাভলু ভাই ভালো খেলত। আমাদের বছর তিনেকের সিনিয়র। পরে শুনেছি ঢাকায় কোন এক ক্লাবে খেলেছে। অদুদ ভাই তাদের ক্লাসের গোলী। গিলন্ডর মুন্নাফ ভাই খেলত ফুল ব্যাক পজিশনে। পরে আর্মিতে যোগ দেয়, শুনেছি সেখানেও রেগুলার খেলেছে। আমাদের ঠিক দু বছরের আগের ক্লাসে ভালো ফুটবল খেলত অমূল্য দা, আবুল ভাই। ওদের ক্লাসই স্কুলের চ্যাম্পিয়ন ছিল। আবুল ভাইয়ের শূন্যে লাফিয়ে ব্যাক কিক ছিল দেখার মত। আমাদের ক্লাসে অনেকেই খেলত। ভালো খেলত অনেকেই। লুতফর, সাহাদত, দীনবন্ধু, প্রদীপ, বুলবুল...। ওই সময়ে এলাকায় যারা ভালো ফুটবল খেলত তারা সবাই জাবরার নবারুণ সংঘ বা বানিয়াজুরির বা রা ঠা উত্তরণ সংঘের সাথে জড়িত ছিল। স্কুলের শরীর চর্চার শিক্ষক থাকলেও সংস্কৃতি চর্চার কোন বালাই ছিল না। কোথাও থাকে বলেও মনে হয়না। তবে অনেক স্কুলেই সংস্কৃতিমনা কোন শিক্ষক থাকলে নিজেদের উদ্যোগে গান বাজনা, নাটক এসব করেন। আমাদের স্কুলে এরকম উদ্যোগী কেউ ছিলেন না। ফলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান বাজনা, কবিতা এসব হত ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের তাগিদে। আমরা যখন ক্লাস নাইন বা টেনে পড়ি আমাদের ক্লাসে এক নতুন মেয়ে আসে ঢাকা থেকে। ওদের বাড়ি এমনিতে জাবরা। নাম মনে হয় হাসিনা। আসার পরপরই আমাদের এক স্কুল ফাংশনে ও কাজী নজরুল ইসলামের কাঠবিড়ালি কবিতা পাঠ করে। এরপর থেকে ওর নামই হয়ে যায় কাঠবিড়ালি।
স্কুলের মাঝখানে ছিল একটা কেয়া ফুলগাছ। ওর সুগন্ধে বর্ষায় স্কুল চত্বর ভরে যেত। অনেকেই বলত কেয়ার গন্ধে নাকি সাপ আসে, তাই আমি ওটাকে এড়িয়ে চলতাম। স্কুলের সাথে ছিল বিশাল মাঠ। প্রাইমারি স্কুল থেকে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত, তারপর খাল। খালের ওপার দুর্গা বাড়ি। ওই মাঠে আমাদের খেলাধুলা হত। শুধু আমাদের নয়, এলাকার ফুটবলের আসর ওখানেই বসত। এটাও ছিল তরার জমিদারদের দান। খেলার মাঠ বাদে বাকি অংশে কলাই চাষ করা হত।
সেসব দিনে আজকের মত হাজার রকমের কনফেকশনারি ছিল না। টিফিনে আমাদের মূল খাবার ছিল জামাইএর ঝালমুড়ি। কী যত্ন করেই না তৈরি করত। ওই মুড়ি খেয়ে যত সুখ পেতাম বাড়িতে নানা উপকরণসহ ভাত খেয়েও সেটা পেতাম না। আসলে এটা শৈশব বা কৈশোরের ধর্ম। এখন নিজের ছেলেমেয়েদের দেখি ঘরের খাবার না খেয়ে গোগ্রাসে দোকানের ছাইপাঁশ গিলছে।
স্কুলের পাশ দিয়ে যে রাস্তায় এখন বাস চলাচল করে ঘিওর পর্যন্ত তখন সেটা এমন ছিল না। যতদূর মনে পড়ে আমাদের সময়ই ওই রাস্তাটা মাটি ফেলে উঁচু করা হয়। ওটা আসলে বানিয়াজুরি বাস স্ট্যান্ডের সাথে জাবরা হাটের যোগাযোগ সুষ্ঠু করার জন্য আর তাও হয়েছিল আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাবরার ছিলেন বলে। অন্তত তখন এটাই ছিল বাস্তবতা। ওই হাঁটা পথে যখন রিক্সা চলতে শুরু করল তখন আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতাম। কারণ রিক্সা তখনও শহরবাসী, গ্রামে সে বড় একটা আসত না। গ্রামের জন্য বরাদ্দ ছিল গরুর গাড়ি বা ঘোড়ার গাড়ি। সে সময় অনেক জায়গায় হাঁটার রাস্তা পর্যন্ত ছিল না। গাংডুবি থেকে যারা আসত, বর্ষায় নৌকাই ছিল চলাচলের একমাত্র উপায়। বর্তমানে যারা স্কুলে পড়ছে তারা ধারণাই করতে পারবে না যে মাত্র তিরিশ বছর আগেও স্মার্ট ফোন তো দূরের কথা বাংলার গ্রাম গঞ্জে তখন স্বাভাবিকভাবে যাতায়াতের রাস্তা পর্যন্ত ছিল না।
স্কুলের জীবন ছিল গতানুগতিক। ক্লাসের বাইরে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে আলোচনা সভা যাকে আমরা বলতাম ফাংশন। হত বাৎসরিক মিলাদ মাহফিল আর সরস্বতী পূজা। আমাদের বাড়িতে গান বাজনার রেওয়াজ ছিল। দিদি, রতন গান গাইত স্কুলের ফাংশনে। তাই সবার ধারণা ছিল আমি গান গাইতে পারি। ফলে আমার কোন দিনই স্কুলের কোন অনুষ্ঠানে যাওয়া হত না বা গেলেও একদম পেছনের দিকে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকতাম। তখন লোকজনের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে গেলে আমার হাঁটু কাঁপত, গলা শুকিয়ে আসত, যদিও আমাদের ক্লাসের অনেকের বক্তব্য আমি নিজেই লিখে দিতাম। ফলে মস্কো আসার পর সবাই যখন স্কুলে একুশের প্রভাত ফেরি, স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের কথা বলত, আমি সেখানে নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকতাম। তবে এটাও ঠিক, স্কুলে প্রতিদিন যখন অ্যাসেম্বলি হত, আমি মোটামুটি রেগুলার ভিত্তিতে সেখানে জাতীয় সঙ্গীত গাইতাম জাতীয় পতাকার পাশে দাঁড়িয়ে।
তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। ক্লাসে টিকটিকি, তেলাপোকা এসব অবাধে ঘোরাফেরা করত। আমি সাধারণত শেষ বেঞ্চে বসতাম, যদিও টিচার প্রশ্ন করলে নিয়মিত হাত তুলতাম, উত্তর দিতাম। একদিন বসে আছি, দেখি দেওয়ালে একটা টিকটিকি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আমার স্বভাব সুলভ ভঙ্গীতে ওর সাথে কথা বলছি। এ দেখে মধুর চক্ষু চড়ক গাছ। টিকটিকির সাথেও যে কথা বলা যায় সেটা ওর মাথায় আসেনি কখনো। আমি অবশ্য এখনো কুকুর, বিড়াল এসবের সাথে কথা বলি। দেশে বেড়াতে গেলে বাড়ির লোকেরা ভাবে রাশিয়ানে বলছি, এখানে ছেলেমেয়েরা ভাবে বাংলায়। আমি অবশ্য নির্দিষ্ট কোন ভাষায় ওদের কিছু বলি না। ছেলেমেয়েরা এক সময় জিজ্ঞেস করত কি বললাম। আমি উত্তরে বলি, যাদের বললাম, ওরা বুঝলেই হল, আমার যে বুঝতেই হবে তেমন তো কোন কথা নেই।
আরেক দিনের ঘটনা। মনে হয়
তখন ক্লাস টেনে পড়ি। কথায় কথায়
লুতফর বলল, “তুই আমার নাকে ঘুসি দিলে আমার কিছুই হবে না।“ “তাই, দেব নাকি? তখন বুঝবি হবে কি হবে না।“ আমাদের চারপাশে সবাই জড় হয়েছে। কেউ
কেউ বলছে বিজন সাহস পাবে না ঘুসি দিতে। কী আর
করা। সমস্ত শক্তি দিয়ে মারলাম এক ঘুসি। ঝর ঝর করে রক্ত পড়তে লাগল লুতফরের নাক দিয়ে। সবাই থ’ হয়ে গেল। পড়ে মস্কোতেও একবার এমনটা ঘটেছিল। আসলে মাঝে মধ্যে আমি এমন সব কাণ্ড ঘটাই যে আশেপাশের লোকজন তো বটেই
নিজেই অবাক হয়ে যাই।
আমি স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেও আতাব
আলী স্যার আমাদের বাড়িতে আসতেন। তখনও শার্ট প্যান্ট পড়তেন। কিন্তু আমি যখন ভর্তি হই, উনি
পাজামা পাঞ্জাবী পড়তে শুরু করেছেন। রেগুলার তব্লিগে যেতেন। ওনার সাথে আমাদের ক্লাস শুরু হয়
আমরা যখন ক্লাস এইটে পড়ি। আমার সাথে ক্লাসে প্রায়ই মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে কথা হত। আমি ছিলাম
প্রকৃতির সমর্থক, উনি ঈশ্বরের। বিতর্কও হত। আজ প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পরে এসব ব্যাপারে এত খোলামেলা
কথা বলা দেশে কতটুকু সম্ভব কে জানে?
আরেক দিনের কথা মনে আছে। আমাদের আলজেব্রা পড়াতেন ক্ষিতীশ স্যার আর সুধীর দা। সুধীর দা সাধারণত থিওরির উপর গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি সমীকরণই ধাপে ধাপে সমাধান করার পক্ষে ছিলেন। ক্ষিতীশ স্যার ফর্মুলা ব্যবহারের পক্ষে। হঠাৎ একদিন তাদের এ নিয়ে বিতর্ক, কে ঠিক। আমাদের ক্লাস চলছিল। দুজনেই উপস্থিত। ভাল ছাত্র হিসেবে আমার নাম ছিল। আমার উপর ভার পড়ল তাদের সমস্যার সমাধান করতে। কি মুস্কিল! যতদূর মনে আছে বলেছিলাম অংক বোঝার জন্য সুধীর দা যেটা বলছেন সেটা ভালো, তাতে ছাত্রদের কাছে থিওরিটা পোক্ত হয়, তবে পরীক্ষার সময়, যখন সময় একটা ফ্যাক্টর তখন ফর্মুলা ব্যবহার করেও সমাধান করা যায়।
স্কুলে আমি শিক্ষকদের প্রিয় পাত্র ছিলাম। শুধু স্কুলে কেন, ইউনিভার্সিটি লাইফেও সেটা ছিল। তখন ক্লাস টেনে পড়ি। পাড়ার ছেলেদের সাথে মনোমালিন্য হওয়ায় আমি একাই স্কুলে যেতাম। বিশাল চক। কোথাও কেউ নেই। আমি যাচ্ছি, যাচ্ছি আর গলা ছেড়ে গান গাইছি। ফাঁকা মাঠে বেসুরো গাইলেও বলার কেউ ছিল না। প্রফুল্ল বাবুর বাড়ি পেরোলেই দেখা যেত স্কুল ঘর। রহমান ভাই এর মধ্যে বেল বাজিয়েছেন। ধানী জমির উপর বয়ে যাওয়া হাল্কা বাতাস সেই শব্দ নিয়ে আসছে আমার কানে। আমার কোন উদ্বেগ নেই। শম্বুক গতিতে আমি যাচ্ছি তো যাচ্ছি। আমাদের প্রথম ক্লাস বাংলা। পণ্ডিত স্যার পড়াতেন। অন্য কেউ হলে ওনার ভাষায় “একটা কিলও মাটিতে পড়ত না।“ আমার মনে হয় উনি আমার পিঠ আর নিজের হাত মেপে বুঝতেন সে কিলগুলো পিঠ ছাপিয়ে মাটিতে পড়বেই পড়বে। তাই কিছু বলতেন না। শুধু বলতেন “আমি সেই তখন থেকে দেখছি তুই আসছিস আর আসছিস। অন্তহীন এই আসা। এক পা এগুলে দুই পা পিছিয়ে যাস। আমার তো ধারণা ছিল ক্লাস শেষ হওয়ার আগে তুই পৌঁছতেই পারবি না। যা, বস।“
স্কুল জীবনের শেষের দিকে বিকেলে
প্রায়ই যেতাম স্কুলে সাহাদত, লুতফর, দীনবন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। সন্ধ্যার পরেও
বসে বসে গল্প করতাম, ওরা প্রায়ই আমাকে এগিয়ে দিত অনেকটা পথ। এখনো দেশে বেড়াতে গেলে ওদের সাথে
দেখা করি, পুরনো দিনের গল্পে গল্পে সময় কাটে। তবে স্কুলে আর যাওয়া হয় না। পুরনো
শিক্ষকদের কেউই আর নেই বললেই চলে, স্কুলও বদলে গেছে। শুধু স্কুল কেন, এলাকাই বদলে গেছে। গ্রাম আর গ্রাম নেই।
রাস্তাঘাট, গাড়িঘোড়া, বিদ্যুতের আলো, কল-কারখানা – সব মিলে গ্রাম তো নয়, যেন
ছোটখাটো শহর একটা। ২০১১ সালে ১৪
বছর পরে যখন দেশে ফিরি আর গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের খোঁজ
করি, দেখা গেল শৈশব তো দূরের কথা পরিচিত রাস্তাঘাটই সব বদলে গেছে। স্কুল ও বাদ যায়নি। বানিয়াজুরি হাই স্কুল এখন
বানিয়াজুরি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ। নতুন দালান
কোঠা। স্মৃতির
জায়গাটা ঠিক নেই আগের মত। তবে যে স্মৃতি মনে গাঁথা তা কি মুছে ফেলা যায় কোন দিন?
স্কুলের শেষ দিনটির কথা এখনো মনে উজ্জ্বল। এটা আমরা স্কুল শেষ করার পরে। রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমাদের স্কুলের যাত্রা ১৯৪৫ সালে। পঁয়তাল্লিশ বছর পরে ১৯৮০ সালে আমিই প্রথম স্টার মার্ক পাই বানিয়াজুরি ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। তাই পরীক্ষার আগে স্বাভাবিক বিদায় সম্বর্ধনা দেবার পরেও এ উপলক্ষ্যে একটি বিশেষ আয়োজন করা হয়েছিল। শিক্ষক ও ছাত্রদের অনেকেই অনেক ভালো ভালো কথা বলেছিলেন আমার উদ্দেশ্যে। সত্যি বলতে কি, ব্যাপারটা আমার বরাবরই অপছন্দ, এমন কি এখনও। কারণ আমি সব কাজই করি ভালবেসে আর যাই করি তা থেকে আনন্দ পাই। নিজে যে কাজ উপভোগ করেছি সেজন্যে কেউ যদি বাহবা দেয় তাতে অস্বস্তি ছাড়া কিছু হয় বলে মনে হয়না। তবে স্টিফেন হকিংএর ভাষায় “গনিতবিদ আর পদার্থবিদরা তাদের কাজ উপভোগ করে আর বোনাস হিসেবে আবার বেতনও পায়।“
আজ সেই স্কুল জীবনের স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে যদিও বরাবরই পদার্থবিদ্যার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল, স্কুল জীবনেই টেলিস্কোপ, পেরিস্কোপসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বানাতাম, তবুও ‘জীবনের লক্ষ্য’ রচনায় কখনো পদার্থবিদ হব বলে লিখিনি। সবার মতই ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হব লিখেছি, যদিও ডাক্তার যে হব না সেটা সব সময়ই জানতাম। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাই হয়তো আমাদের বিজ্ঞানমুখী, গবেষণামুখী করে না। এসবের পরিবর্তে আমাদের শেখায় কিভাবে নিজের শিক্ষাকে উঁচু দরে বিক্রি করে গাড়ি বাড়ি করা যায়। শিক্ষাটা বাহ্যিক ভালো থাকার একটা মাধ্যম, একটা পণ্য। শিক্ষা যে সাধনা সেটা আর কেউ বলে না। শিক্ষাও যে গান, বাজনা বা অন্যান্য শিল্পের মতই প্রচণ্ড উপভোগ্য একটা বিষয় সেটা আমাদের শেখানোই হয়না কখনো। তবে এটাও ঠিক, মুখে না বললেও আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের ভাবতে শিখিয়েছিলেন, ভালমন্দ বোধ শিখিয়েছিলেন। আর সে কারণেই আজ আমাদের স্কুলের অনেকেই জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
এবার বানিয়াজুরি ইউনিয়ন হাই স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রীরা
পুনর্মিলনী পালন করছে। কেন এ বছর, কেন
দু বছর আগে হল না বা দু বছর পরে করা গেল
না, সে প্রশ্ন অনেকে করতেই পারেন। তবে এটা
নিঃসন্দেহে সুন্দর এক উদ্যোগ। এটা
আবার আমাদের শিকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমাদের
জানায় যে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেকেই মর্যাদার সাথে কাজকর্ম করছেন বিভিন্ন
জায়গায়। যেহেতু দেশের বাইরে থাকি, দেশে বেড়াতে
যাওয়ার সুযোগও তেমন হয়ে ওঠেনা, তাই দু’ কথা না লিখলেই নয়। আগেই বলেছি আমাদের স্কুল স্থাপিত হয় ১৯৪৫ সালে, মানে আগামী ২০২০ সালে
সে ৭৫ বছরে পা দেবে। পঁচাত্তর একশ’
নয়, তবে মোটেই কিছু কম নয়। যদি এ
উপলক্ষ্যে স্কুলের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু লেখা হয়, কিভাবে স্কুলের শুরু, কাদের
তৈরি, প্রথম শিক্ষক, প্রথম ছাত্র, প্রথম ছাত্রী। হয়ত অনেক কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না, হয়তো প্রথম ব্যাচের কেউই এখন
বেঁচে নেই – তবুও যেটুকু সংগ্রহ করা যায় সেটাই বা কম কিসে! যারা দেশে আছেন, ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন।
সবশেষে এই সুন্দর একটা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ যারা নিয়েছেন
তাদের জানাই অনেক অনেক ধন্যবাদ। কী
নতুন, কী পুরনো - ছাত্র শিক্ষক সকলের জন্য
রইল এক রাশ শুভ কামনা।
দুবনা, জুন ২১ – জুলাই ০৪, ২০১৯
Comments
Post a Comment