বইয়ের প্রচ্ছদ (১) রামায়ণ


  • "ধীরে বহে সরযূ নদী কাকের চক্ষু জল"
    ঠিক এভাবেই শুরু হয়েছিল ছোটদের রামায়ণ। ১৯৭২ সাল। স্বাধীনতার পর মা'র সাথে ইন্ডিয়া বেড়াতে গেলাম। আমি তখন অটো প্রমোশন পেয়ে ক্লাস থ্রিতে পড়ি। বহরমপুরে মাসির ওখানে থাকার সময় বাড়ি সংলগ্ন স্কুলে যাই। নেতাজী, দেশবন্ধুসহ অনেকের সংক্ষিপ্ত জীবনী স্কুলের বইয়েই পড়া হয়। সে সময় মামা আমাকে ছোটদের রামায়ণ উপহার দেন। সেটাই ছিল আমার প্রথম বই, একেবারেই নিজের। ছোটবেলা থেকেই অবশ্য মা আর কাকার মুখে রাম আর রামায়ণের গল্প শুনে আমার বড় হওয়া। সন্ধ্যায় বড়দাদের বারান্দায় মার নেতৃত্বে প্রায়ই গাওয়া হত
জয় জয় রঘুপতি রাঘব রাজা রাম
পতিত পাবন সীতারাম
ঈশ্বর আল্লাহ তেরে নাম
সবকো সুমতি দে ভগবান।

ঈশ্বরে আল্লাহ তেরে নাম শুনে মনে এক ধরনের আনন্দ অনুভব করতাম। সে সময় ঈশ্বর, আল্লাহ, গড সবাই ছিলেন একান্নবর্তী পরিবারের, তখন তাঁদের ঘরে ভাঙ্গন লাগেনি। রাম রাজ্য কী সেসময়, কী এখন আমার কাছে কখনও ধর্মীয় রাজ্য মনে হয় নি, মনে হয়েছে এমন এক রাজ্য যেখানে আইনের শাসন কায়েম হয়েছে। বিশ্বামিত্র মুনি যখন রামকে নিতে আসেন  তাড়কা রাক্ষসী বধ করার জন্য, সেটা করেছেন তাড়কা রাক্ষসী বলে নয়, তাড়কা অন্যদের কাজকর্মে (ধ্যান ও যজ্ঞে) বাধা দেয় বলে। আবার একই ভাবে রাবন ব্রাহ্মণ (আমরা তাঁকে রাক্ষস বলেই জানি, যদিও রাবন রামের অকাল বোধনে পুরহিতের কাজ করেন ব্রাহ্মণ হিসেবে) হওয়ার পরেও রামের হাতে নিহত হন সীতাকে চুরি করার অপরাধে। তাই বর্তমানে রাম রাজ্য মানে ধর্ম রাজ্য যারা বলতে চান তারা ধর্মের সঠিক অর্থ ব্যবহার করছেন না। মনে রাখা দরকার ধর্ম মানে পূজা পার্বণ নয়, ধর্ম হল সামাজিক দায়িত্ববোধ।  
এ ছাড়া রাম সম্পর্কে আরও জানা ছিল ধারাপাত থেকে
দুষ্টমতি লংকাপতি হরে নিল সীতা সতী
রামচন্দ্র গুনাধার ত্বরা গিয়ে সিন্ধু পার
ঘোরতর যুদ্ধ করে বধিলেন লংকেশ্বরে
সীতাসহ পুনরায় ফিরছিলেন অযোধ্যায়
যাহোক, ফেরা যাক আসল কথায়। কিছুদিন আগে ফেসবুকে সবাই যখন প্রচ্ছদ বিনিময় খেলায় ব্যস্ত তখনই মনে হল প্রিয় বই বা লেখকদের নিয়ে নিজের সাথেই খেলব। প্রথমেই মাথায় এল প্রিয় লেখক দস্তয়েভস্কির নাম। তবুও প্রথম বই হিসেবে রামায়ণ দিয়ে শুরু করব ভাবলাম। মামার দেওয়া সেই ছোটদের রামায়ণের পরে ক্লাস সেভেন ও এইটের জন্মদিনে সুধীর দা বাল্মিকীর রামায়ণ ও বেদ ব্যাসের মহাভারত উপহার দেয় (তখন জন্মদিনে বিভিন্ন রকম বই পেতাম উপহার হিসেবে) যা পড়ে মনে মনে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াই। পরে রাজশেখর বসুর গদ্য ও রুশ ভাষায় (সেটা মুলত বাচ্চাদের রামায়ণ আর মহাভারতের গল্প শোনাতে গিয়ে) এ বইগুলো পড়েছি আর অবাক হয়েছি তখনকার ভারতবর্ষের প্রকৃতির সৌন্দর্যে। এনিয়ে দু' কলম লিখব বলে ভেবেছিলাম মাস দেড়েক আগে। এরমধ্যে রামায়ণ নিয়ে এক বন্ধুর সাথে কথা হল, তাই লেখার প্রসঙ্গটা একটু বদলে গেল।
৩১ ডিসেম্বর এক বন্ধুকে ফোন করলাম জন্মদিনের অভিনন্দন জানাতে। কথায় কথায় ক্যাবের কথা উঠল। এ নিয়ে নিজেও ক'দিন আগে লিখেছিলাম "ক্যাবলার প্যাচাল"। সে সময় ফেসবুকে কে যেন শেয়ার করল এ নিয়ে সদগুরুর ভিডিও। ফেসবুকে কেউ শেয়ার করলে আমি সময় পেলে দেখি ওনার ভিডিও। সব সময় যে একমত হই তা নয়, তবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই ওনার কিছু নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকে বিভিন্ন ঘটনায়। অন্তত আমার জন্য অজানা কিছু তথ্য সেখানে থাকে। সেটাই বললাম। ওদিক থেকে বন্ধু জিজ্ঞেস করল আমি রামায়ণ, মহাভারত নিয়ে সদগুরুর ভিডিও দেখেছি কি না। সেখানে নাকি উনি উত্তর এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন, প্রশ্নটাকে পাশ কাটিয়ে গেছেন ইত্যাদি। প্রশ্ন করল
- আপনি কি মনে করেন রাম ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব?
- সেটা মনে করা বা না করার মত যথেষ্ট তথ্য আমার নেই। তাই আমি যেটাই মনে করি না কেন, সেটা হবে বিশ্বাস, বলতে পার যুক্তি প্রমাণ ছাড়া এক অন্ধ বিশ্বাস। তবে আমার মনে হয় রামের সত্যি সত্যি কোন প্রোটোটাইপ ছিল। যতদূর জানি সে সময়ের কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। তাছাড়া এসব গ্রন্থে ভৌগলিক বিভিন্ন স্থানের যে নিখুঁত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সেটাও অগ্রাহ্য করার মত নয়। সময়ের সাথে সাথে অবশ্য কুশীলবদের ক্ষমতা অতিরঞ্জিত হয়ে বর্তমান রূপ পেয়েছে। যতদূর জানি, তুলসিদাসের আগে পর্যন্ত রাম ছিলেন শুধুই রাজা, তুলসিদাস কলমের খোঁচায় তাঁকে অবতার বানান। তাছাড়া শুধু ভারতবর্ষ নয়, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ এক বিস্তীর্ণ এলাকায় রামায়ণ জনপ্রিয় গ্রন্থ এবং স্থান ভেদে নায়ক নায়িকা ভিন্ন। শ্রীলংকায় রাবণকে হিরো ভাবা হয় যদিও আমাদের কাছে রাবন ভিলেইন।
- আপনি কি রামকে অবতার মনে করেন?
- অবতার হয় ভগবানের তাই কাউকে ভগবানের অবতার মনে করার আগে তোমাকে ভগবানের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে, ভগবানে বিশ্বাস করতে হবে।
  • সেদিনের কথোপকথনের পরে মনে হল রামায়ণ মহাভারত নিয়ে সদগুরুর ভিডিওটা দেখা দরকার। খুব সহজেই পেয়ে গেলাম সেটা। প্রশ্ন ছিল রাম কি ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব কি না? উত্তরে উনি বললেন, “পাঁচ হাজার বছর আগের একজন মানুষ ঐতিহাসিক কিনা সেটা আমাদের জন্য যতটা না গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বর্তমান সমাজে তাঁর অদৃশ্য কিন্তু শারিরীক উপস্থিতি।“ এভাবে ব্যাপারটা আগে দেখিনি। তবে ঘটনা তো সেটাই। আজ আমরা যীশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ব্যক্তি নিয়ে যখন কথা বলি সেখানে তাঁদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনার ঐতিহাসিক সত্যতার চেয়েও বেশি যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা এসব ঘটনার সত্যতায় মানুষের বিশ্বাস। এই বিশ্বাসই সমাজকে চালায়। এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে ভক্তি, ডগমা। এই বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের রক্তাক্ত লড়াইয়ে ধ্বংস হয় জনপদের পর জনপদ। রাম ঐতিহাসিক কি না সেটা কি এতই প্রয়োজন? আপনার ওষুধটা কে আবিষ্কার করল সেটা না জানলে ততটা ক্ষতি হবে না যতটা হবে আপনি যদি না জানেন কিভাবে সেটা ব্যবহার করতে হবে। কোন বিষয়ে আমরা বেশি প্রাইওরিটি দেব কোন বিষয়ে কম, সেটার উপর নির্ভর করে আমাদের সাফল্য। দুঃখজনক হলেও সত্য এক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে, ফলে সাময়িক ভাবে সাফল্য লাভ করলেও সুদুরপ্রসারী ফল ভালো হয় না। এটা অনেকটা এখনকার জিপি৫ এর মত, পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট কিন্তু জ্ঞানের ভাণ্ডার শূন্য।
  • আরও একটা প্রশ্ন ছিল সীতা প্রসঙ্গে। সীতার বনবাস নিয়ে। উত্তরটা খেয়াল করার মত। উনি বললেন “রাজা হিসেবে রাম চাইলে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারতেন। কিন্তু সীতার প্রতি তাঁর ভালবাসা এমনই ছিল যে তিনি সমুদ্র পার হয়ে মহা পরাক্রমশালী রাবনের সাথে যুদ্ধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন। তাই শুধু অগ্নি পরীক্ষা বা পরবর্তীতে কোন প্রজার কথায় সীতাকে বনবাসে পাঠানোর ঘটনা বিচ্ছিন্ন ভাবে না দেখে রামের জীবনের সমস্ত প্রেক্ষিতে এটাকে দেখতে হবে। রাম যদি প্রজার কথা না শুনে মাতাল বলে তাকে শাস্তি দিত, তাহলে আজ স্বজন প্রীতির অভিযোগ উঠত। একজন রাজপুত্র যাকে সেই বালক বয়সে তারকা রাক্ষসীর সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে, জীবনের প্রতি পদে পদে একের পর এক বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে আজ পাঁচ হাজার বছর পরে আবার আমরা তাঁকে বর্তমানের মানদণ্ডে বিচার করতে চাইছি, কেউ তাঁকে দেবতার আসনে বসাচ্ছি, কেউ আসামীর কাঠগড়ায় - সেটাই কি প্রমাণ করে না ঐতিহাসিক চরিত্র হন আর নাই হন, তিনি আজও কতটা প্রাসঙ্গিক আমাদের সমাজে?” এখানে অবশ্য তবে প্রশ্নও উঠতে পারে রাম যতটা না ভালবাসার জন্য তার চেয়ে বেশি নিজের আত্ম সন্তুষ্টির জন্য সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন। রাবনের সাথে যুদ্ধ না করে আর দশ জনের মত অন্য কোন রাজকন্যাকে বিয়ে করলে আজ আর তাঁর কথা কেউই মনে রাখত না। কথাটা এখানেই। রাম আর দশ জন যা করে সে পথে যাননি, আর তাই এত বছর পরেও আমরা তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন তুলছি, আলোচনা করছি। 
    ব্যক্তি রাম, ঐতিহাসিক বা কাল্পনিক, হাজার হাজার বছর আগেই এসব ভালো মন্দের ঊর্ধ্বে। আমরা নিজেদের স্বার্থে তাঁকে বিভিন্ন রূপে কল্পনা করি। রামায়ণের গল্প একটা জিনিসই প্রমাণ করে আর সেটা হল রাম ছিলেন প্রজা বৎসল, প্রজাদের মঙ্গলের জন্য নিজে যেকোনো কিছুই ত্যাগ করতে সদা প্রস্তুত। আর যেহেতু তাঁর বন্ধু বা সহযোদ্ধাদের অনেকেই ছিল বানর (হনুমান, সুগ্রীব, অঙ্গদ), ভাল্লুক (জাম্বুবান), রাক্ষস (বিভীষণ) আর ধারনা করা হয় এরা আসলে বিভিন্ন উপজাতির মানুষ, যাদের গোত্রের টোটেম ছিল এসব প্রানী, ধরে নেওয়া যেতে পারে তিনি জাতি বা বর্ণের বা ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে বিচার করতেন না। তাই তাঁর দেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই আইনের শাসন পেত। সুতরাং, রাম রাজ্য, এটা ধর্ম রাজ্য নয়, এটা আইনের শাসন, যেখানে সব মানুষ সমান। এখন যারা “রামের কাঁধে বন্দুক রেখে” ভোট যুদ্ধে জিততে চাইছে বা হিন্দু অধিকারের কথা বলছে, তারা আসলে রামের বিপক্ষেই কাজ করছে, রামের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে নিজেদের ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থ হাসিল করছে। তাই বর্তমানে রামকে ঘিরে যে মতামাতি, সেটা শাস্ত্রীয় নয়, সেটা ভারতীয় নয়, সেটা এমন কি সেই অর্থে ধর্মীয় নয়। এটা নিছক ধর্ম ব্যবসা। আর সেটা করা হচ্ছে যে পশ্চিমা বিশ্বকে এরা ঘৃণা করে তাদের কাছ থেকে ধার করা কৌশল প্রয়োগ করে। তাই রামকে নিয়ে রাজনীতি না করে তাঁকে শান্তিতে থাকতে দেওয়াই শ্রেয়। যারা তাঁকে নিয়ে রাজনীতি করে তারা রাজনীতিবিদ নয়, রাজনীতিবাজ।       
  • আসলে আমার এত্ত এত্ত অক্ষর লেখার কারণ কিন্তু মোটেই সদ্গুরুর সাথে একমত বা দ্বিমত প্রকাশ করার ইচ্ছে বা অনিচ্ছা থেকে নয় নয়। আমাকে যেটা অবাক করে সেটা আমাদের অন্যকে শোনার বা বোঝার চেষ্টা না করা। ডান বা বাম, ধার্মিক বা নাস্তিক, বর্ণবাদী বা মানবতাবাদী, সবাই আমরা বাদী হয়ে অন্যের নামে নালিশ করতে সিদ্ধহস্ত। সব ক্ষেত্রেই শুধু আদর্শের কথা, কিন্তু আদর্শটাই বেমালুম হাওয়া হয়ে গেছে। সবাই আমরা নিজে যে বিশ্বাসে বিশ্বাসী তার অনুকুলে কথা শুনতে চাই আর সেটা না হলে ভাবি হয় সে দালাল নয় তো মূর্খ। আমরা সবাই নিজেদের এমন একটা জায়গায় কোণঠাসা করেছি যে আমাদের চিন্তার জগত হয়ে পড়েছে সংকীর্ণ। নিজেদের বিজ্ঞানের পুজারী মনে করলেও, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী ভাবলেও আমরা অনেকেই নিজেরা যে ভুল করতে পারি বা করি, সেই সাধারণ বৈজ্ঞানিক সত্যটুকু স্বীকার করতে পারি না। আর এই ভুল স্বীকার করতে না পারা, নিজের বিশ্বাসকে অন্ধের মত আঁকড়ে ধরে থাকাই মৌলবাদ, তা সে ধর্মীয় হোক, মানবিক হোক আর যাই হোক না কেন? রাম বলতেই পারতেন এক বার অগ্নি পরীক্ষা হয়েছে আবার কি। তিনি সেটা করেননি। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন, সাহসের সঙ্গে নতুন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এটাই কি বৈজ্ঞানিক পথ নয়, বস্তুবাদী দর্শন নয়?
  • আচ্ছা কেন এমন হয়? এটা কি মানুষের স্বভাবগত নাকি অন্য কিছু? অনেক কিছুই আমরা করি নিজেদের অজান্তে, যদিও অন্য কারও সাথে সেটা হলে ঠিক খেয়াল করি। দিনগুলো যদি আর দশটা দিনের মত হয় আমরা সেটা খেয়ালই করি না। তবে হঠাৎ প্রচণ্ড শীত বা গরম পড়লে আমাদের সেটা মনে থাকে। এসব আসলে এক্সট্রিম পয়েন্ট। গণিতে এসব বিন্দুতে ফাংশন বিশেষ গুণ অর্জন করে। মনে হয় মানুষ অজ্ঞাতসারেই গণিত দ্বারা প্রভাবিত হয়। আমি মাঝে মধ্যেই রাত দুপুরে ভল্গায় ঘুরতে পছন্দ করি। জানি ব্যাপারটা রিস্কি, তবে সেটা মাথায় নিয়েই আমি ঘুরতে যাই বা ছবি তুলতে যাই। যদি কখনও কোন দুর্ঘটনা ঘটে জানি সবাই বলবে এটা আমার দোষ, এত রাতে ওখানে যাওয়া ঠিক হয়নি। একইভাবে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ ভুক্তভোগীর দোষ দেয়, কারণ দুর্ঘটনা ঘটে কালেভদ্রে। অন্য ফ্যাক্টরগুলো পরে তার মাথায় আসে। তার মানে হল নিজ নিজ মানসিক টাইপ অনুযায়ী মানুষ সব প্রশ্নের একেকটা উত্তর মনে মনে তৈরি করে রাখে। আর অন্য কেউ অন্য ভাবে ভাবলে সে সেটাকে সহজে মেনে নিতে পারে না। সেটা রাজনীতি, ধর্ম, বিজ্ঞান প্রায় সব ক্ষেত্রেই সত্য। আর সে জন্যেই আইনস্টাইনের মত মানুষ, যিনি বিজ্ঞানে আদর্শগত পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন, তাঁর নিজের সমীকরণের পরিবর্তনশীল মহাবিশ্বের সমাধান মেনে নিতে পারেননি। আইনস্টাইনের মত মানুষ যেখানে হুট করে ডগমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না, আমাদের মত খুদে বিপ্লবীরা সেখানে কিই বা করতে পারে?

    আবারও ফিরে যাই ঈশ্বর আল্লাহ্‌ তেরে নামে। হ্যাঁ, এক সময় আমাদের বিশ্বাস ছিল ঈশ্বর, আল্লাহ্‌, গড সবাই এক ও অভিন্ন, ভিন্ন শুধু নাম। মনে পড়ে ছোটবেলায় ভগবান ছিল বাবা কাকাদের মত। আমাদের ছিল একান্নবর্তী পরিবার। বাবা ব্যবসা দেখতেন, মানে টাকা রোজগার করতেন। ছোট কাকা জমিজমা দেখা শোনা করতেন, বাজার ঘাট তিনিই করতেন। আর জ্যাঠামশাই আমাদের এমনিতে আদর করলেও মাংস, আইসক্রিম এসব খেতে দিতেন না, এসব খেতে দেখলে বকতেন। আমার শিশু মনে এঁরা তাই ছিলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর শিবের মত। আর এঁদের নিজেদের মধ্যে ছিল খুবই ভালো সম্পর্ক। ছোটবেলায় রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডী বা অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থে ঈশ্বরের যে রূপ দেখেছি, সেটা ছিল করুনাময়। একসময় বাইবেল (নিউ টেস্টামেন্ট) পড়েও সেটাই মনে হয়েছে। তবে এরপর ওল্ড টেস্টামেন্ট পড়ে দেখতে পাই ঈশ্বরের নিষ্ঠুর রূপ। আমার কিছু ইহুদি বন্ধুকে প্রশ্ন করলে ওরা স্বীকার করে যে টোরায় বর্ণিত ঈশ্বর সত্যই নিষ্ঠুর। তখনই মনে হয়েছে শুধু নামে নয়, চারিত্রিক গুণাবলীতেও বিভিন্ন ধর্মের ঈশ্বর ভিন্ন আর তাই তাদের এক হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এটা অনেকটা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মত। সবাই দেশের উন্নতির কথা বলে, হয়তো বা দেশের ভালও চায়, অথচ একে অন্যের ঘোর শত্রু, এক দলের কর্মীরা নির্দ্বিধায় অন্য দলের কর্মীদের এক হাত নিয়ে নিতে পারে। এক সময় শত্রুকে নির্মূল করা হত, এখন সেটা হয় না। বিপক্ষ দল গণতান্ত্রিক নিয়মে ক্ষমতায় আসতেও পারে। ধর্মের ক্ষেত্রেও সেটা করা দরকার আর তার জন্য দরকার ধর্মের গণতন্ত্রায়ন। তবে সেটা কতটুকু সম্ভব বা আদৌ সম্ভব কিনা সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। কেননা ডগমা আর যুক্তি সাধারণত সমান্তরাল পথ যাত্রী।    

    যাহোক বই নিয়ে লিখতে বসে বইয়ের বাইরের কথাই বেশি বললাম। আসলে বই পড়া  তো শুধু পড়ার জন্য নয়, বই নিয়ে ভাবার জন্য, তা থেকে শেখার জন্য। আমরা বই পড়ে কে কি ভাবব, কে কি শিখব, কে বইটাকে কিভাবে অনুভব করব, সেটা নির্ভর করে আমাদের নিজ নিজ অজ্ঞতার বা গ্রহণ করার সামর্থ্যের উপর। আমি এখানে কাউকে ট্যাগ করছি না (সাধারণত করিও না)। তবে যে কেউ এই খেলায় অংশ নিতে চাইলে সুস্বাগতম!

    দুবনা, ২৩ জানুয়ারি ২০২০




Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি