আধুনিকতা

সচেতন, সুশিক্ষিত, আধুনিক মানুষের সাথে সংস্কারাচ্ছন্ন, বিশ্বাসান্ধ মানুষের পার্থক্য কি? প্রথমজন বাস করেন আইনস্টাইনের জগতে, দ্বিতীয় জন নিউটনের। ব্যাপারটা একটু খুলে বলা দরকার। নিউটনের মহাবিশ্বে স্পেস-টাইম আবসলিউট যার কোনই পরিবর্তন নেই। চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র সেখানে নাটকের অভিনেতা অভিনেত্রী মাত্র যারা স্পেস-টাইম নামক এই রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করে যাচ্ছে। নিউটনের জগতের মানুষও একই ভাবে মনে করে তারা এই পৃথিবীতে, এই প্রকৃতিতে শুধুই অভিনেতা। তারা নিজেদের প্রকৃতির অংশ বলে গন্য করে না। ফলে এরা নির্দ্বিধায় প্রকৃতি ধ্বংস করে। প্রকৃতির ধ্বংস যে তাদেরও ধ্বংস করবে সেটা তারা বুঝতে পারে না। আইনস্টাইনের বিশ্বে স্পেস-টাইম আর ম্যাটার পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। একে অন্যের প্রভাবে প্রভাবিত, কেউ কারও থেকে মুক্ত নয়। এতে যারা বিশ্বাস করে তারা নিজেদের প্রকৃতির অংশ বলেই ভাবে। তারা জানে নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই প্রকৃতিকে রক্ষা করা কতটা প্রয়োজন। এরাই আধুনিক মানুষ, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, সত্যিকার অর্থে সুশিক্ষিত মানুষ। এরা পরিবর্তনে বিশ্বাসী, এমন কি প্রতিষ্ঠিত সত্যকে অন্ধভাবে গ্রহণ না করে নতুন বাস্তবতার পরশ পাথরে যাচাই করে দেখতে আগ্রহী। এরা জ্ঞানের পুজারী নয়, জ্ঞানের অন্বেষী। এরাই প্রকৃত আধুনিক মানুষ।

আমরা জানি নিউটনের আগে মনে করা হত পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থান করছে আর সূর্য সুবোধ বালকের মত পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে। পরে কোপেরনিকাস, গ্যালিলিও সহ অনেকেই  প্রমাণ করেন সূর্য মোটেই সুবোধ বালক নয়, বরং পাড়ার দুষ্ট ছেলের মত সে পৃথিবীকে নাকে দড়ি দিয়ে নিজের চারিদিকে ঘুরাচ্ছে। তবে এখানে মূল কথা হল কেন্দ্র, মানে পৃথিবীতেই হোক আর আর সূর্যেই হোক, মহাবিশ্বের এক কেন্দ্র আছে। আর মহাবিশ্বের যদি কেন্দ্র থাকতে পারে মানুষই বা কেন সৃষ্টির সেরা জীব হতে পারবে না।  তাই তো দেখা যায় মানুষ, বিশেষ করে ধার্মিকেরা ঈশ্বরকে মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা মনে করলেও আসলে ভাবে ঈশ্বর শুধু মানুষের সেবায়ই নিয়োজিত। মানুষের ভালমন্দ দেখতে, মানে ধার্মিকদের পুরস্কৃত করতে আর অধার্মিকদের শাস্তি দিতেই তার আবির্ভাব। প্রশ্ন জাগে, তিনি যদি সব কিছুর মালিক হন, তবে গাছপালা, পশুপাখী কি অপরাধ করেছে? কেন ডাইনোসার ও অন্যান্য অনেক প্রানী পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেল? তারা তো সবাই পাপী ছিল না, তাহলে কেন সবাইকে মরতে হল, কেন ঈশ্বর তার সৃষ্টিকে রক্ষা করলেন না বা করতে পারলেন না? এটা আর যাই হোক, তার মহানুভবতা প্রমাণ করে না। আর শ্রেষ্ঠ বলতে আমরা কী বুঝি? পৃথিবীতে অনেক অত্যাচারী রাজা, বাদশাহ, সেনাপতি ছিল যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করত, কিন্তু আজ তারা সবাই বিস্মৃতির আড়ালে। অন্যদিকে মোজার্ট, বীথোফেন, মারটিন লুথার কিং, আইনস্টাইন, মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ সহ আরও শত শত মানুষ যারা কোন ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না, তারা অনায়াসে শ্রেষ্ঠ মানবদের তালিকায় চলে আসেন। এসব শুধু একটা কথাই বলে, শ্রেষ্ঠ হওয়ার অনেক পথ আছে, অনেক শান্তিপূর্ণ পথ আছে। প্রকৃতিকে ধ্বংস করাই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের একমাত্র পথ নয়। যদি প্রাণীকুল কোন ধর্মে দীক্ষিত না হয়েও শান্তিতে বাস করতে পারে, পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে মানুষ কেন পারবে না। কেউ যদি ধর্ম পালন করতে চায়, ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে চায় সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, এ নিয়ে জোর জবরদস্তির কোন কারণ নেই। যদি ঈশ্বরের প্রতি প্রানীকুলের ঔদাসীন্য পৃথিবীতে ঈশ্বরের রোষ ডেকে না আনে, কিছু মানুষের উদাসীনতাই বা তা কেন করবে? কিন্তু আমরা সেটা মানতে পারি না এ কারণেই যে আমরা অবচেতনভাবে নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করি। আর এধরনের মনোভাব আর যাই হোক আধুনিক হতে পারে না।

আইনস্টাইনের মহাবিশ্বে আমরা কি দেখি? বিশেষ করে ফ্রিডম্যানের মডেলে? মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দু, প্রতিটি দিক সমতুল্য, অভিন্ন। এদিক থেকে বলা চলে ফ্রিডম্যানের মহাবিশ্ব সাম্যবাদী। এখানে তাই না পৃথিবী, না সূর্য, না অন্য কোন গ্রহ নক্ষত্র - কেউই বিশেষ কোন অবস্থায় নেই। তাই এই মহাবিশ্বের বাসিন্দা হিসেবে মানুষ কেন বিশেষ অবস্থায় থাকবে? মানুষ কেন তার ভোগ বিলাসিতার জন্য প্রকৃতি আর জীব জগতকে ধ্বংস করবে সেটা কি তারা ভাবে? আর এটা না ভেবে কী আধুনিক মানুষ হওয়া যায়?

ক' দিন আগে দেখলাম কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে ফুল ফুটেছে, পঁচিশ বছর পরে এখানে ডলফিনেরা ফিরে এসেছে। চীনের ধোয়ার কুয়াশা কর্পূরের মত উবে গেছে। সারা পৃথিবী জুড়ে উদ্ভিদ আর প্রানী জগত নতুন করে হাসছে। ঈশ্বর পারেনি কিন্তু করোনা মানুষের হাত থেকে পশুপাখী, গাছপালা সবাইকে রক্ষা করছে। ঢাকা, দিল্লি, বেজিং সহ বিভিন্ন শহরের মানুষেরা এখন বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। করোনা একদিন চলে যাবে। তখন, করোনা উত্তর বিশ্বে, মানুষ কি মনে রাখবে আজকের এই পরিষ্কার বাতাসের কথা, পাখীর গান, বন্য প্রানীর নির্ভয়ে চলাফেরা। যদি পারে, শুধু তাহলেই তারা নতুন বিশ্বের বাসিন্দা হতে পারবে। আর যদি বরাবরের মতই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ভুলে যায় তবে আজ না হোক কাল তাকে বিদায় নিতেই হবে।  প্রকৃতি আমাদের ছাড়াও ঠিকই বেঁচে থাকবে, নতুন সাজে সাজবে। আমরা প্রকৃতির বাইরে নই, তার অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। এই বিশাল মহাবিশ্বের রাজপ্রাসাদে মানবজাতি বড়জোর একটা ইট, যার অনুপস্থিতি প্রাসাদের সৌন্দর্যে একটু ব্যাঘাত ঘটাবে, কিন্তু তার অস্তিত্বের জন্য মোটেই বিপদজনক নয়। এটা বোঝা, আর বুঝে নিজেদের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করাই আধুনিকতা, সুশিক্ষা, সচেতনতা।  

দুবনা, ০১ এপ্রিল ২০২০                 




Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি