খেলা

ছোটবেলায় আমরা বিভিন্ন ধরণের খেলা খেলাতাম। এদের একটা ছিল চারা খেলা। ভাঙ্গা মাটির হাড়ি বা কলসের (পরে অবশ্য বাড়িতে সুতার বাণ্ডিলে থাকা লোহার টুকরা ব্যবহার করতাম) টুকরা ছুঁড়ে দিতাম দূরে, একটা ছোট বৃত্তের ভেতরে দাঁড়িয়ে। একজন বাদে সবাই এটা করত। যে করত না, এটা ছিল তার দান। সে চাইলে অন্য খেলয়ারদের খেতে পারত, নইলে ঘরে ফিরতে বলত, মানে বৃত্তে ফেরা। এর মাঝে হত দরাদরি বা দান বা নিলাম। প্রত্যেকেই একেকটা ডাক দিত, মানে বলত যদি যার দান সে ওকে খেতে পারে, মানে চারা ছুঁড়ে ওর চারার আধ হাত বা চার আঙ্গুলের (এই দূরত্ব কতটুকু হবে সেটা খেলার এগেই ঠিক করা হত, এখন খেললে নিশ্চয়ই কোন স্কেল রাখতাম, কেন না বিভিন্ন মানুষের এই মাপ ভিন্ন। আমার হাত লম্বা, তাই আধ হাত হলে আমার সুবিধা হত, কিন্তু সরু বিধায় চার আঙ্গুলে আমি ঠকতাম)  মধ্যে আসতে পারে তাহলে সে কতগুলো সিগারেটের প্যাকেট পাবে। তাই এই খেলার আরেক নাম ছিল খোলা। বাড়িতে বা পরিচিত কেউ সিগারেট খেলে আগে থেকেই বলে রাখতাম প্যাকেট না ফেলতে। অনেক সময় ডাক বা নিলাম হত গোপনে মানে খেলোয়ার নিজের ইচ্ছেমত কিছু পরিমান খোলা এক হাতে ধরত আর অন্য হাত সামনে রাখত বা সরিয়ে রাখত, যদিও এর পরেও অনেকেই চিট করত, যেমন হারলে কোন ভাবে খোলার পরিমান কমিয়ে ফেলত আর জিতলে বাড়াত।  আর যদি সে খেতে না চাইত, তবে ঘরে ফিরতে বলা হত, একই ভাবে বৃত্তের ভেতর বা আধ হাত বা চার আঙ্গুলের মধ্যে ফিরতে হত।  এক্ষত্রে দরাদরি ছিল না, যেটা বলত সেটাই মানতে হত। না করার উপায় ছিল না। তাই চারা ছোঁড়ার সময় ফিরতে হবে সেটাও মাথায় রাখতে হত। অনেক সময় আমরা কিল কিল খেলাতাম, মানে খোলা নয়, কিল দিতাম,  আস্তে আস্তে। এর ডাক অনেক সময় কোটি কোটি হত। অনেক সময় বলতাম "যত কবি  (বলবি) তার ডাইনে শূন্য" বা "যত কবি তার চেয়ে ১ টা বেশি"। তখন এক কোটি বা একশ কোটি কিল যে দেওয়া সম্ভব নয় সেটা বুঝতাম না। তবে বাস্তবে এতো কিল দেওয়া হত না, খুব জোরে এক কিলে কোটি কোটি কিলের মীমাংসা করতাম।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে কারণে অকারণে মেসেজ পাই। জানি না, তারা এটা করে কি আনন্দ পায়। আমি নিজে কোন ব্যক্তিগত কথা না থাকলে সাধারণত লিখি না। লিখি আত্মীয়স্বজনদের, খুব ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুদের। তার মানে এই নয় যে কাউকে লিখতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু সময় কোথায়? আর আমরা যদি সবাই সবাইকে লিখি, তাহলে তাহলে অন্য কাজের সময় পাব কোথায়?  একটা কাজ অবশ্য করা যায়। ছাত্র জীবনে কেউ দরজা খুলে খুব জোরে মিউজিক বাজালে প্রথমে অনুরোধ করতাম, না শুনলে নিজের দরজা খুলে আরও জোরে মিউজিক বাজাতাম। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হত ভলিউম কমাতে।  দুবনায় এক লোক কি এক কারণে আমার বসের উপর নাখোশ ছিল, তাকে কিছু বলতে না পেরে আমাকে দেখলেই বিড়বিড় করে এটা ওটা বলত। একদিন এক বুদ্ধি খুঁজে বের করলাম। ও কিছু বলার আগেই রবীন্দ্র সঙ্গীত বা অন্য কিছুর সুর ভাজতাম। বাংলা না বোঝায় ও ভাবত আমি ওকে গালি দিচ্ছি। বার দুয়েকের পর জীবনে আর বিড়বিড় করেনি। হয়তো তাদের ইনবক্স হাবিজাবি দিয়ে ভরিয়ে এ সমস্যার একটা সমাধান করা যায়!

আজ ইনবক্স ভরে গেছে শুভ কামনায়। এমন অনেকেই আছে, যারা জীবনে আগে কখনও লেখেনি। তাদের লেখা অএয়ে ভালো লাগছে। আবার এমন লোক আছে যারা বিভিন্ন মাধ্যমে কয়েকবার শুভেচ্ছা পাঠিয়েছে। আমি সাধারণত মানুষের কষ্ট লাঘব করার জন্য নিজের টাইম লাইনে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কিছু একটা পোস্ট করি। যারা প্রয়োজন মনে করে ওখান থেকে শুভেচ্ছা নিয়ে নেয়, কেউ কেউ কমেন্টে শুভেচ্ছা জানায়। এক্ষেত্রে সবার পরিশ্রম কম হয়, সময় বাঁচে। কিন্তু যখন ইনবক্সে বন্যার জলের মত শুভেচ্ছাবানী আসে, যা আবার নিজের করা নয়, অন্য কারও করা কার্ড বা ক্লিপ, সেটা দেখতে অনেক সময় লাগে। আমি ভদ্রতা বশে সবাইকে নিজ হাতে লিখে উত্তর দিই। এ সব সময় সাপেক্ষ। কিন্তু সমস্যা হল তাদের শুভেচ্ছার উত্তরে শুভেচ্ছা জানানোর মধ্যেই সেটা শেষ হয় না। আমার শুভেচ্ছার উত্তরে কিছুক্ষণ পরে তারা ধন্যবাদ জানায়। সময়াভাবে আমি উত্তর দিই না। তারা হয়তো ভাবে আমি খেয়াল করিনি, তাই ধন্যবাদের পুনরাবৃতি ঘটে। এভাবে অনেকক্ষণ। আমার বিশ্বাস আমি যদি ধন্যবাদের উত্তর দিতাম তাহলেও তারা তার উত্তর দিত। আজ কয়েকবার এটা দেখে মনে হল সেই খেলার কথা। যতই বল তার চেয়ে একটা বেশি। যতই ধন্যবাদ দাও শেষ কথাটা আমার সাথেই থাকবে। বন্ধুরা বিনয় ভালো, কিন্তু অতি বিনয় অন্যের বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে।

করোনা আমাদের ঘরে রেখেছে কিন্তু বেকার করেনি।    
নববর্ষের শুভেচ্ছা ভালো, কিন্তু অতি শুভেচ্ছার বানে আমাদের ভাসিয়ে না দিলে সেটা হলে আরও ভালো। নইলে শুভেচ্ছা আর ভালবাসার স্রোতে হাবুডাবু খেতে খেতে করোনাকে আর প্রতিরোধের শক্তি থাকবে না।

শুভ নববর্ষ!

দুবনা, ১৪ এপ্রিল ২০২০












Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি