স্বর্গ রাজ্যে বিভেদ

বেশ কিছুদিন আগে দেশে কথা হচ্ছিল।

আমাদের ছোটবেলায়ও জানতাম আল্লাহ, ভগবান, গড সবই এক। তবে বর্তমান বাংলাদেশে সেটা আর কেউ বিশ্বাস করে না।

দেখ, লোকজন এটা বিশ্বাস না করে খুব ভুল করে বলে মনে হয় না।

মানে? তুমি কি মনে কর ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় নন?

আমি কিছুই মনে করি না। কারণ সেটা মনে করার জন্য ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে হয়।

প্রথমেই বলি আস্তিক আর নাস্তিকের একটাই কমন পয়েন্ট - সেটা ঈশ্বর। একজন ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, আরেকজন তাঁর অস্তিত্ব স্বীকার করে না। কিন্তু যারা বিশ্বাস করে তাদের মধ্যেও দলাদলি। কেউ হিন্দু, কেউ মুসলিম, কেউ বৌদ্ধ, কেউ খৃস্টান, কেউ বা অন্য ধর্মাবলম্বী। তাদের সবার আবার একটাই কমন পয়েন্ট - তারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী। এর পরেই শুরু হয় ভেদাভেদ। এটা অনেকটা খেলাধুলার মত। আমরা অনেকেই ক্রিকেট ভালবাসি। সেক্ষেত্রে আমরা এক নৌকার যাত্রী। কিন্তু যখনই কোন দলকে সমর্থনের প্রশ্ন আসে তখন আমরা একে অন্যের ঘোর শত্রু। একজন বাংলাদেশের সমর্থক, অন্যজন ইন্ডিয়া বা অস্ত্রেলীয়ার। তখন আর ক্রিকেট আমাদের এক করতে পারে না, যতক্ষণ না কেউ এসে ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবল বড় বলে দাবী করে।

বর্তমান পৃথিবীতে ঠিক ধর্ম না হলেও অনেক কিছুই আছে যা ধর্মের মতই। যেমন পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি। এসবও ধর্মের মতই এক ধরনের আইডিয়া যা পরকালে স্বর্গের ভিসা না দিলেও ইহলোকে সুখের লটারির টিকেট বিক্রি করে। কেউ কিন্তু এক সাথে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতে পারে না, হয় সে পুঁজিবাদে বিশ্বাস করে নয়তো সমাজতন্ত্রে। একইভাবে কেউ হিন্দু হয়, কেউ মুসলমান, কেউ বৌদ্ধ, কেউ খৃস্টান। কেউ কিন্তু একসাথে সব হয় না। আর এই এক না হওয়ার মূলে আছে ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন ধারণা। ঈশ্বর যদি ধারণা বা আইডিয়া হয় আর এই ধারণা যদি ভিন্ন হয়, তবে কেন ভগবান, আল্লাহ, গড এরা এক হতে যাবেন।

এই দেখ, খুব সাধারণ একটা ব্যাপার। আমার হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে পড়াশুনা একটু আধটু ছিল, মানে রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডী এসব। বাইবেলও পড়েছিলাম। সেখানে ভগবান বা গড ছিলেন অনেকটা পিতৃসুলভ, যার কাছে নিজের কথা বলা যায়। অন্তত অনেক গল্প সেটাই জানায়। এরপর যখন ওল্ড টেস্টামেন্ট পড়ি, সেখানে গডের একেবারে ভিন্ন চেহারা, প্রচণ্ড বদ মেজাজী এক মালিক যিনি শুধুই শাস্তি দিতে চান। ভারতীয় ও সেমেটিক ঈশ্বরের শাসনে পার্থক্য কি?
সেমেটিক ঈশ্বরের বিচার প্রক্রিয়া প্রচন্ড বিলম্বিত। আসামিদের যুগ যুগ ধরে বিচারের অপেক্ষায় হাজত বাস করতে হয়। ভারতীয় ঈশ্বর বিচার করেন কোর্ট মার্শালে আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে।
অর্থোডক্স আর ক্যাথলিক খৃস্টানদের মধ্যে পার্থক্য মুলত কিছু টেকনিক্যাল ব্যাপারে, যেমন ক্রস করার ভঙ্গি, সন্যাসীদের বিয়ে করা না করা ইত্যাদি। শিয়া, সুন্নীদের মধ্যেও এরকম খুব ছোটোখাটো পার্থক্য। তারপরেও তারা মতৈক্যে পৌঁছুতে পারে না। সেখানে ভারতীয় আর সেমেটিক ঈশ্বরের মধ্যে পার্থক্য যে থাকবে, বিভিন্ন ধর্মের লোক যে অন্য ধর্মের ঈশ্বরকে নিজের ধর্মের ঈশ্বর থেকে ভিন্ন ভাবে দেখবে সেটাই তো ঠিক। যতক্ষণ বিভিন্ন ধর্মের লোক তাঁকে সৃষ্টিকর্তা বলে ডাকেন, ততক্ষন পর্যন্ত সবাই একজনের কথা বলেন। কিন্তু যখনই তারা এই সৃষ্টিকর্তাকে কোন না কোন নামে ডাকেন, তাঁকে নিজের মত করে সাজান তখন আর তাঁরা এক থাকেন না। ফুটবল তখন আবাহনী, মোহামেডান, ইস্ট বেঙ্গল, মোহন বাগান ইত্যাদি বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে যায়, যারা এমনকি পরস্পরের আজন্ম শত্রু।

ঈশ্বর সম্পর্কে তোমার ধারণা কি?

ঈশ্বরের সাথে ধার্মিকদের চাওয়া পাওয়ার সম্পর্ক মিউচুয়াল, তবে সমতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি। ঈশ্বর চান বিশ্বাসী মানুষের ভক্তি আর বশ্যতা। বিনিময়ে সেই মানুষ চায় ধন দৌলত, দীর্ঘ আয়ু, শান্তি আর পরকালে গ্যারান্টেড মোটা পেনশন যা দিয়ে সে স্ট্রিপটিজ ক্লাব আর ফাইভ স্টার হোটেলে বছরের পর বছর থাকতে পারে। চাওয়ার এই অসাম্যে পাওয়ার ক্ষেত্রেও অসাম্য তৈরি হয়। আমদানি রপ্তানির এই ডিসব্যালান্স থেকে বেরুনোর একটাই উপায় - ঈশ্বরের কাছে মিউচুয়াল রেসপেক্ট ডিমান্ড করা।

তবে যাই হোক, আমি এসব গ্রুপিং পছন্দ করি না। ধর্মই হোক আর আদর্শই হোক, যা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সংকীর্ণ করে সেটা গ্রহণ করা ঠিক বলে মনে হয় না। তার মানে এই নয় যে কাউকে একই সাথে সবকিছু হতে হবে, সব মত গ্রহণ করতে হবে। তবে সত্যিকার মানুষ ভিন্ন মতকে ভয় পায় না, ভিন্ন মত শুনতে ভায় পায় না। জানি না অন্য প্রানীরা কোন মতামত দেয় কি না (নিশ্চয়ই দেয়। দলবদ্ধ প্রানীরা যখন জীবিকার খোঁজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়, তারা নিশ্চয়ই কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে নিজেদের মত প্রকাশ করে) তবে প্রতিটি মানুষই প্রায় সব ব্যাপারেই নিজস্ব মত পোষণ করে বা মত পোষণ করার সামর্থ্য রাখে। কথায় আছে "যত জীব তত শিব"। "যত মত তত পথ"। সব পথই যে ঠিক তা নয়, তবে তবে যেটা ভুল পথ সেটা যুক্তি দ্বারাই বুঝাতে হবে, যুক্তি দিয়েই প্রমাণ করতে হবে। বিভিন্ন পথের মধ্য থেকে সঠিক পথ বেছে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আর সেটা করার জন্য প্রথমেই যেটা দরকার সেটা নিজেকে ডগমা মুক্ত করা, মনকে মহাবিশ্বের মত বিশাল করা।

কিন্তু সেটা কি সম্ভব? তুমি তো বললে, শুধু ধর্ম নয় মানুষের শক্তিতে বিশ্বাসী আদর্শগুলোও পরস্পরকে সইতে পারে না। এমন কি কিছু আছে, যা ধর্মীয়, রাজনৈতিক, আদর্শগত দলাদলির ঊর্ধ্বে উঠতে পারে?

দেখ, ছোটবেলায় রামায়ণ মহাভারতের বীরদের কাণ্ড দেখে আমি দেব দেবতায় বিশ্বাস করতাম। একাত্তরের যুদ্ধের সময় কলার ডগা দিয়ে কালী মূর্তি বানিয়ে পূজা করতাম, আর এজন্যে এক মুঠো করে চাল সরিয়ে রাখতাম। একদিন আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে রাজাকাররা এসে সব লুট করে নিয়ে চলে যায়। এমন কি খাবার চাল ডালও। ঐদিন রাতের খাবার হয়েছিল আমার সরিয়ে রাখা চাল দিয়ে। বড় হয়ে যখন এসবের অসারতা বুঝলাম আর বামপন্থী রাজনীতির দিকে ঝুঁকলাম ঈশ্বর আমার জীবন থেকে চিরবিদায় নিলেন। মস্কোয় এসে সমাজতন্ত্রের (বরং বলি তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্র ব্যবস্থার) অনেক কিছুই আমার ভালো লাগল না। ছোটবেলা থেকেই চেয়েছিলাম পদার্থবিদ হব। তখন বুঝলাম শুধুমাত্র বিজ্ঞানের চর্চা করেই এসব দলাদলির ঊর্ধ্বে থাকা যায়। একজন বিজ্ঞানী যখন ওষুধ তৈরি করেন তিনি তখন ভাবেন না এই ওষুধ দিয়ে হিন্দুর না মুসলমানের চিকিৎসা হবে, ডানপন্থী না বামপন্থীর চিকিৎসা হবে, সাদা না কালো মানুষের চিকিৎসা হবে। তিনি এটা করেন সমস্ত মানব জাতির জন্য। একজন পদার্থবিদ যখন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তত্ত্ব ব্যবহার করে কম্পিউটার আবিষ্কারের পথ খুলে দেন, তিনি এটা করেন জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের জন্যই। বিজ্ঞানী এসব আবিষ্কার করেন প্রকৃতির রহস্য জানার আনন্দে, জ্ঞান অর্জনের জন্য। তিনি বোঝেন তার তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করে রাজনীতিবিদরা শত শত মানুষ মারে, তার তৈরি আধুনিক তথ্য বিনিময় যন্ত্র ব্যবহার করে ধার্মিকরা সমাজে বিভেদ ছড়ায়, সন্ত্রাসবাদীরা জন জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। কিন্তু বিজ্ঞানী এসব করেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। বিজ্ঞানী আজ শুধু মানুষের জন্যই সব করেন না, বিজ্ঞানের হাত ধরে বিলুপ্তপ্রায় প্রানীরা নতুন জীবন পায়। খরদাহে যখন বনের পর বন পুড়ে ছারখার হতে থাকে সেই বনের প্রাণ রক্ষায় এগিয়ে আসে বিজ্ঞানী। বিজ্ঞান শুধু মানুষ বান্ধব নয়, বিজ্ঞান আজ প্রকৃতি-বান্ধবও। তাই যে যে ধর্মের, যে বর্ণের, যে রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসীই হোক না কেন, মানুষকে যদি বিজ্ঞান মনস্ক করা যায় তবেই হয়তো একদিন এই ভেদাভেদি দূর হতে পারে। আবারও বলছি, বিজ্ঞান মনস্ক মানে শুধু আধুনিক ডিভাইস ব্যবহার করা না, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা না, প্রকৃতি ও সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো। বিজ্ঞান মনস্ক মানে কোন কিছুতে অন্ধ বিশ্বাস না করা, প্রশ্ন করা, অস্ত্র নয় যুক্তি দিয়ে নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করা, অন্যের মত শোনা। বিজ্ঞান মনস্ক মানে বিনয়ী হওয়া, যেকোনো পরিবর্তনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখা। বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের ঈশ্বর ধর্মে বর্ণিত ঈশ্বর নন, তার ঈশ্বর সদা পরিবর্তিত, সদা বিকাশমান, অনন্ত, অসীম জ্ঞান। রাজনীতিবিদদের ডিজিটাল বিশ্ব নয়, বিজ্ঞান মনস্ক সমাজ গড়ার মধ্য দিয়েই সেই বিশ্ব গড়া সম্ভব যেখানে ভগবান, আল্লাহ আর গড পরপস্পরের শত্রু হবেন না, মানুষের জ্ঞানের আলোয় নতুন রূপ পেয়ে পরস্পরের বন্ধু হবেন।

দুবনা, ০৮ এপ্রিল ২০২০ 
 
 
 

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি