লেনিন - ১৫০
লেনিনের প্রতি ভালবাসার শুরু খুব ছোটবেলায়, এতো
ছোটবেলায় যে সময়টা মনেই নেই। এরপর যখন বাড়িতে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন রং
বেরঙের পত্র পত্রিকা আসতে থাকে তখন ভালবাসা আরও বেড়ে যায়। মনে আছে স্কুলে
পড়ার সময় একবার বড়দা বলেছিলেন, দেশি কৃষ্ণ থাকতে বিদেশি লেনিনের প্রতি এত
প্রেম কেন? আমিও বলে দিলাম, তোমাদের কৃষ্ণ যেমন এখানে বিদেশি, লেনিনও তাই।
এখনও মনে পড়ে "চারণিক শিল্পীগোষ্ঠী"র নিবেদনে লেনিনের পালা। লেনিনের ভুমিকায় অমলেন্দু
বিশ্বাসের অনবদ্য অভিনয়। পরে বাম রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে লেনিনের সম্পর্কে
আগ্রহ বাড়তে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়তে এসে সে ভালবাসায় ভাটি পরে। সেটার
জন্য লেনিন যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী লেনিন ভক্তরা। এদেশের রাস্তায়
রাস্তায় তখন লেনিনের মূর্তি, অনেকটা ভারতে শিব লিঙ্গের মত। আমার রুমমেট এক
দিন বলেই বসলো "যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতাম, লেনিন হতেন সেই ঈশ্বর।" সোভিয়েত
দেশে অনেক ভালোর মধ্যে কিছু কিছু খারাপ দিকও দেখার সুযোগ হয়েছে। আর সেসব
ছিল খুবই হাস্যকর। অনেক মানুষ আছে যারা জীবনে প্রচুর ভালো কাজ করে, কিন্তু
ছোটোখাটো দোষের জন্য তাদের সব ভালো কাজই বৃথা যায়। এমন লোক জীবনে অনেক
দেখেছি। আমার একটা প্রিয় জায়গা ছিল আরবাত। কখনও রাতের দিকে যেতাম সেখানে
ঘুরতে, দেখতাম গীটার বাজিয়ে গান গাওয়া তরুন তরুনীদের সাদা পোশাকের লোকজন
ধরে নিয়ে যেত। অথবা বাজারে অতি সাধারণ জিনিসপত্রের অভাব। এসবের জন্য লেনিন
হয়তো দায়ী ছিলেন না, তবে যেহেতু সব কাজই তখন লেনিনের নামেই করা হত তাই
দোষটা তাঁর ঘাড়ে এসেই পড়ত। কথা প্রসঙ্গে বলা যায় গরবাচভ সব কিছুই কিন্তু
লেনিনের নামেই করতেন, কথায় কথায় লেনিনের কাছে ফিরে যাওয়ার কথা বলতেন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার টাইম বোমা এই ১৯২২ সালেই স্থাপিত হয়েছিল বিভিন্ন
রিপাবলিককে স্বাধীন হওয়ার অধিকার দেওয়ার মাধ্যমে এ কথা এখন অনেকেই বলেন।
আসলে কোন বিশাল মানুষকে আমরা চিনি তাঁর কাজে বা লেখায়। তাঁর আসল জীবন সব
সময়ই থাকে বিভিন্ন মিথ দিয়ে ঘেরা। এই মিথ ভেঙ্গে সত্যিকারের মানুষের যত
কাছাকাছি আমরা যাই তত বেশি আমাদের মোহভঙ্গ হয়। সেটা ভালো বা মন্দ দুই হতে
পারে। সোভিয়েত আমলে বেশ কয়েকবার রেড স্কয়ারে চিরনিদ্রায় শায়িত লেনিনকে
দেখতে গিয়েছি। প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে দেখতে গিয়েছি তাঁর শেষ বাসস্থান গোর্কি
লেননস্কি। তবে ঐ যে বললাম যতই দিন গেছে মনে ততই প্রশ্ন জেগেছে তাঁকে নিয়ে।
সোভিয়েত পরবর্তী রাশিয়ায় লেনিনের জীবনের বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হতে থাকে।
জার পরিবার হত্যায় তাঁর যে পরোক্ষ সমর্থন ছিল সেটাও জানা যায়। সব মিলিয়ে
আগের সেই শ্রদ্ধার স্থানটা নড়ে যায়। লেনিন নিঃসন্দেহে গত শতাব্দীর অন্যতম
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি একাই বিশ্বের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছেন। পশ্চিমা
বিশ্বে বর্তমান মনবতাবাদী রূপ সেটাও এসেছে লেনিনকে হঠাতেই। বলে না "সুখ ছিল
না, দুঃখ সাহায্য করল"। তবে এটা ঠিক সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের প্রায় তিরিশ বছর
পর অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৫৬% রুশ লেনিনের প্রতি পজিটিভ
ধারণা পোষণ করে, ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে সেটা ৫৭%। তাঁর প্রতি নেগেটিভ
মনোভাব পোষণ করার অনুপাত যথাক্রমে ২০% ও ১৪%। অনেকেই লেনিনকে এদেশের এক
ট্র্যাজিক ফিগার বলে মনে করেন। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান। জীবিত
অবস্থাতেই তিনি দেখতে পান কিভাবে তাঁর হাতে গড়া পার্টিকে স্ট্যালিন ব্যক্তি
স্বার্থে ব্যবহার করে। যে রাষ্ট্র ধারণার বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই তাঁর অধীনেই
গড়ে ওঠে বর্তমান কালের সব চেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র যন্ত্র। আবার তাঁর জনগণের
শত্রু তত্ত্ব ব্যবহার করেই পরবর্তীতে একে একে তাঁর সমস্ত সহকর্মীকে হত্যা
করা হয়। সার্বিক বিচারে লেনিন খুব বিতর্কিত এক চরিত্র এ অর্থে যে একদিকে
তিনি সাধারণ মানুষের জন্যে এনেছেন মুক্তি, অন্যদিকে সমাজের এক বিশাল অংশের
জন্য এনেছেন সীমাহীন দুর্ভোগ। লেনিনের আদেশেই রাশিয়ার বুদ্ধিজীবীদের
পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেশের বাইরে। অল্প সংখ্যক মানুষের একনায়কত্বের জায়গায় আসে
শ্রমিকের একনায়কত্ব। শান্তির পরিবর্তে আসে সন্ত্রাস, যদিও স্ট্যালিনের হাত
ধরে। সব কিছুর পরেও লেনিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর রাজনৈতিক বা বিপ্লবের
তত্ত্বের জন্য। আরও শত শত বছর তাঁর হয়ে লাল ঝাণ্ডা তোলার মানুষের যেমন অভব
হবে না তেমনি অভাব হবে না তাঁকে ঘৃণা করে এমন মানুষের। আজ যে বিশ্ব আগের
চেয়ে অনেক মুক্ত, দেশে দেশে সাধারণ মানুষ যে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আরও
বেশি সোচ্চার তাঁর পেছনের আছে লেনিনের হাত। তাই ১৫০ বর্ষ পূর্তিতেও লেনিন
অনেকের চেয়েও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
দুবনা, ২২ এপ্রিল ২০২০
দুবনা, ২২ এপ্রিল ২০২০
Comments
Post a Comment