অবিশ্বাসের বিশ্বাস

আচ্ছা, তুমি ওকে চেন?
বারে, চিনব না কেন?
যোগাযোগ হয়?
না। উনি রাবীন্দ্রিক মানুষ। আমার সাথে এদের তেমনটা যায় না।
রাবীন্দ্রিক মানুষ?
অনেকের মত আপনিও আবার তাঁর গুনগ্রাহী নাকি? বেশ বেশ!
কারও গুন থাকলে আমাদের গ্রহণ করতে আপত্তি কোথায়?

যার সাথে কথা হচ্ছিল তিনিও উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা মানুষ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চর্চা করেন এমন অনেক লোকের সাথে তাঁর ওঠা বসা, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কিন্তু এই "রাবিন্দ্রীক মানুষ" কথাটায় এক ধরণের শ্লাঘা ছিল।

আচ্ছা, কেন এমন হয়? যারা কোন মহান ব্যক্তিদের অনুসরণ করেন, তাঁদের দেখানো পথকে পাথেয় করে জীবন কাটান, তাঁদের অনেকের প্রতি মানুষ কেন এমন বিরূপ ধারণা পোষণ করে? রবীন্দ্রনাথ বা সে অর্থে কোন মানুষই পারফেক্ট বা নিখুঁত নন। কিন্তু মানুষ বরাবরই পারফেকশন খোঁজে। আর এই পারফেকশন খুঁজতে গিয়ে সে তার নিজের ঈশ্বরকে তৈরি করে। তার ভাষায় যত পজিটিভ বিশেষণ আছে তাই দিয়ে সে তার ঈশ্বরকে সাজায়। কল্পনায় ঈশ্বরের নিখুঁত আদল গড়ে তোলে। বিভিন্ন ধর্মে ঈশ্বরের রূপ বিভিন্ন। কোথাও তিনি নির্মোহ বিচারক, কোথাও শাস্তিদাতা, কোথাও বা করুনাসিন্ধু। বিভিন্ন ধর্মে, বিশেষ করে ভারতীয় ধর্মে মোক্ষ লাভ মানে ঈশ্বরকে পাওয়া, ঈশ্বরে বিলীন হয়ে যাওয়া। আসলে এটা তো আর কিছুই নয়, তপস্যার মাধ্যমে, সাধনার মাধ্যমে, নিজের কাজের দ্বারা নিজেকে পারফেক্ট করা। এভাবে যদি ভাবা যায়, তাহলে মন্দিরে গিয়ে ঈশ্বর খুঁজতে হয় না, নিজেকে প্রতিনিয়ত উন্নত থেকে উন্নততর করে নিজেই ঈশ্বরে বিলীন হওয়া যায়। আর এটা সম্ভব ধর্মীয় রীতিনীতি নয়, মানব ধর্ম পালন করে। জীবে প্রেম করে। জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। তবে ধার্মিকদের বিশেষ করে ধর্ম ব্যবসায়ীদের কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয় মোক্ষ নয়, পারফেকশন নয়, তত্ত্ব জ্ঞান নয়, স্বর্গের অপ্সরা, হুরপরী আর অঢেল সুস্বাদু খাবার দাবারই তাদের বেশি আকর্ষণ করে। ফলে ধর্মও আজ ভোগবাদী দর্শনে পরিণত হয়েছে।

ফিরে আসি রাবীন্দ্রিক মানুষে। আসলে আমরা অনেকেই রাবীন্দ্রিক হতে গিয়ে যতটা না তাঁর জীবন অনুসরণ করি, তাঁর লেখা পড়ে, তাঁর গান শুনে নিজেদের মনকে নির্মল করি, তার চেয়ে বেশি রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হতে চাই। রবীন্দ্রনাথের দর্শণকে ধারণ করি না, কথায় কথায় তাঁর লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে সমাজে নিজের স্থান করে নিতে চাই। রবীন্দ্রনাথ আমাদের অন্তর বিকশিত করে না, তাঁকে আমরা আমাদের গায়ে দামী চাদরের মত জড়িয়ে রাখি। না বুঝে মুখস্ত করে পরীক্ষায় পাশ করি, করতে চাই। আমরা ভুলে যাই রবীন্দ্রনাথ নিজে সাধারণ মানুষের সাথে চলতেন, তাদের জীবন থেকে শিক্ষা নিতেন। বাউল গান, লালন গীতিকে অন্তরে ধারণ করার জন্য, বাংলার প্রকৃতিকে জানতে, বুঝতে তিনি সাধারণ মানুষের সাথে দিনের পর দিন কাটাতে পারতেন। নিজেকে এলিট বলে গর্ব করতেন না। কিন্তু আমরা কি করি? রবীন্দ্রনাথ পড়ে, তাঁর গান গেয়ে বা শুনে, তাঁকে গুরুদেব মেনে নিজেদের এলিট ভাবতে শুরু করি। এখানেই যত সমস্যা। এ যেন "বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শত গুন।"
কোথায় যেন পড়েছিলাম কে সবচেয়ে নিখুঁত ভাবে চার্লি চ্যাপলিনকে নকল করতে পারে এমন এক প্রতিযোগিতায় স্বয়ং চ্যাপলিন প্রথম স্থান অধিকার করতে ব্যর্থ হন। হ্যাঁ, আমরা রবীন্দ্রনাথকে পড়ে নিজেরাই তারচেয়েও বড় রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাই। শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন, আমরা মার্ক্সের চেয়ে বড় মার্ক্সবাদী, মুজিবের চেয়ে বড় মুজিববাদী। আসলে আমাদের এই অতি ভক্তি বা অতি ঘৃণা, আমাদের বিশ্বাস বা অবিশ্বাস সব কিছুই ব্যবসা, এই বিশ্বাস বা অবিশ্বাসকে বিক্রি করে সমাজে নিজের সাইনবোর্ডটা আরেকটু উঁচু করে ধরা, এসব ভাঙ্গিয়ে নিজের ইহকাল আর পরকালের একটা গতি করা। কোন কিছুতে অতি ভক্তি প্রায়ই অন্য কিছুর প্রতি অতি ঘৃণার জন্ম দেয়। এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণার প্রকাশকেই নিজ ধর্মের সেবা বলে মনে করে। করোনা নিয়ে হারারি বর্তমান আমেরিকান সমাজে দুটো ক্যাম্প নিয়ে এভাবে বলেছেন " একদল লোক যদি ট্রাম্প বলে সূর্য পশ্চিম দিকে উঠে পূর্ব দিকে অস্ত যায়, সেটাকেই বিশ্বাস করবে। আরেকদল লোক যদি ট্রাম্প বলে একের সাথে এক যোগ করলে দুই হয়, সেটাকেও অস্বীকার করবে শুধুমাত্র ট্রাম্প এটা বলেছে বলে।" সমস্যা এখানেই। এক্সট্রিম কোন কিছুই ভালো নয়। এমন কি ভালো আইডিয়াও যদি অন্ধ ভাবে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা হয়, আজ হোক, কাল হোক সেখানেও হাজারো সমস্যা দেখা দেয়, পরিনামে ভালো আইডিয়াটাকেই মানুষ ঝেটিয়ে বিদায় করে। ইতিহাসে এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে, ঘটছে।

দুবনা, ০৫ এপ্রিল ২০২০

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি