চলে যাওয়া

আমার ছোটবেলায় তরা গ্রাম এখনকার মত না হলেও যথেষ্ট ঘনবসতি পূর্ণ ছিল। কিন্তু সেই সাথে মাঠ ঘাটেরও অভাব ছিল না। গ্রামে হিন্দু ও মুসলমান অধিবাসীর সংখ্যা ছিল প্রায় সমান সমান। হিন্দুদের বেশিরভাগ হয় তাঁত শিল্পের  নয়তো ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। তবে ব্যবসা করলেও এ পাড়ার ছেলেমেয়ারা সবাই চেষ্টা করত স্কুল কলেজে যেতে। চাকরি তেমন কেউই করত না। পড়াশুনা করে ব্যবসায়ে ঢুকত, আর দুএকজন যারা চাকরি করত তাও আসলে ওকালতি, মানে আইনি ব্যবসা। ওদিকে মুসলমান পাড়ায় কিছু কিছু ব্যবসায়ী থাকেলও অধিকাংশই জড়িত ছিল কৃষি কাজের সাথে। মোট কথা, গ্রামে চাকরির তেমন কদর ছিল না। যারা চাকরি করতেন তাঁরাও মূলত শিক্ষকতার সাথে জড়িত ছিলেন। সেই সময় মুসলমান পাড়ায় হাতে গনা কিছু মানুষ পড়াশুনা করত। যদিও ও পাড়ায় অবস্থাপন্ন লোকের অভাব ছিল না, তবুও পড়াশুনাটাকে ঠিক তেমন গুরুত্ব দেওয়া হত না। এ নিয়ম ভেঙ্গে যে কয়জন মানুষ কলেজের দিকে পা বাড়ায় তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন আতাব আলী স্যার। একটু পরে মান্নান (মঈন উদ্দীন) ভাই, সালাহ উদ্দীন ভাই, হ্যামো (হোসেন আলী) ভাই, নুরু ভাই উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে এদের প্রায় সবাই চাকরির সাথে জড়িত ছিলেন। এদের প্রায় সবাই আমাদের দাদাদের বন্ধু ও সম বয়সী ছিলেন। আতাব আলী স্যার বাদে সবারই ছিল আমাদের বাড়িতে অবাধ আনাগোনা। এমন কি একদম ছোটবেলায়, যখন মান্নান ভাই ও হ্যামো ভাই পাশের বাড়িতে পড়াতে আসতেন, আমিও সবার সাথে বসে পড়তাম। এছাড়া একসাথে ক্লাব করা, ফুটবল খেলা এসব তো ছিলই। এরপর উনি ভেটেরিনারি বিষয়ে পড়াশুনা করেন, চাকরিও নেন এলাকার বাইরে। তাই দেখাসাক্ষাৎ তেমন হত না। তবে গ্রামে এলেই আমাদের বাড়ি আসতেন। এছাড়া ইদ্রিস ভাই, ইউনুসদের মাধ্যমে খবরাখবর পেতাম। এরপর আমার গ্রাম ছাড়া। নতুন করে ফেসবুকে বন্ধুত্ব, মাঝে মধ্যে হাই হ্যালো।

কিছুদিন আগে ওনার টাইম লাইনে একটা স্ট্যাটাসে (মেয়ের লেখা) জানি উনি গুরুতর অসুস্থ। প্রায় দুবছর ধরেই ভুগছিলেন। ঐ রাতেই মেরিল্যান্ড থেকে ইউনুস ফোন করে জানাল শরীর খুব খারাপ। রাত টিকবে কিনা সন্দেহ। এর আগে ভেলুর গিয়ে চিকিৎসা করে ভালো হয়ে এসেছিলেন। আবারও মনে হয় যাওয়ার কথা ছিল। করোনা সব কিছু বরবাদ করে দিল। ইউনুসের সাথে কথা বলতে বলতেই মনে পড়ল ২০১৬ সালের কথা। দেশে গিয়েছিলাম। উনি দেখা করতে এসেছিলেন। কিন্তু আমি বাড়িতে না থাকায় দেখা হয়নি। তবে দিদিকে বলে গেছিলেন আবার আসবেন। আমি ফেরার এক বা দুদিন আগে এসেছিলেন। হ্যামো ভাই, নুরু ভাই আর আমিনুল ভাই। যখন বাইরে থাকি, সবার সাথে কত কথা যে থাকে, কিন্তু কাছে এলে কোন কিছুই যেন বলার থেকে না। আসলে অপেক্ষার সময় আমরা সেই পুরনো ছবিটা মনে ধরে রাখি। দেখা হলে বুঝি সবাই অনেক বদলে গেছি। ভাবি,  পুরনো দিনের সেই নগণ্য স্মৃতি নিয়ে কথা বললে কিছু  ভাববে না তো! ফলে প্রায়ই কেমন আছেন, ছেলেমেয়ে কেমন আছে এসব কথার মধ্য দিয়েই কথা শেষ হয়ে যায়। আবেগবিহীন, ফর্মাল কিছু কথা।

ঐ সময় আমি আমার স্মৃতির উপর ভিত্তি করে "আমার একাত্তর" নামে একটা ধারাবাহিক লেখা প্রকাশ করছিলাম ফেসবুকে। এক পর্যায়ে মনে হল, এসবই তো বিভিন্ন জায়গার কথা যেখানে আমরা পালিয়ে বেরিয়েছি। কিন্তু আমার গ্রামের কথা, এলাকার কথা তো এখানে নেই। আমরা ছিলাম না, তবে এলাকা তো আর জনশূন্য ছিল না। কাকে জিজ্ঞেস করা যায়? কে বলবে সে সময়ের সত্য কথা?  তখন মনে হল হ্যামো ভাইয়ের কথা। রতনকে বললাম ওনাকে এ ব্যাপারে আমার হয়ে জিজ্ঞেস করতে। হ্যামো ভাই হতাশ করেন নি। আমার প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর দিয়েছেন। তবে নিজের নাম উল্লেখ করতে মানা করছিলেন। এরপর আর তেমন যোগাযোগ হয়নি। মাঝে মধ্যে ফেসবুকে স্ট্যাটাস থেকে খবর পেতাম। উনিও আমার লেখা বা ছবি দেখতেন।

গতরাতে ইয়াসিন জানাল হ্যামো ভাই মারা গেছেন। আবার মনের কোণে ভেসে উঠল অনেক অনেক স্মৃতি। যারা যাবে তাঁরা স্মৃতি হয়েই বেঁচে থাকবে আমাদের সাথে। দেখা হবে হ্যামো ভাই।            

দুবনা, ২০ মে ২০২০



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি