বিজয়ের কথা

আমার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে বাংলাদেশের গ্রামে। তাই সেই জীবনে বড় কিছু খুব একটা দেখার সুযোগ হয়নি। বিজয় দিবস সহ বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালিত হত ছোট আকারে, স্কুলে বা ক্লাবে। তাতে আনন্দের কমতি ছিল না, কমতি ছিল না শ্রদ্ধার, তবে সেটা বিশালতায় পৌঁছেনি কখনও। বর্তমানে এসব উৎসব দেশে ঘটা করে পালিত হয়। জাতীয় দিবসগুলোর অনুষ্ঠান মেলা মেলা মনে হয়।

দেশ থেকে মস্কো আসার পর পরিচয় ঘটে এদেশের বিভিন্ন জাতীয় উৎসবের সাথে। সোভিয়েত আমলে খুব ঘটা করে পালিত হত মে দিবস আর অক্টোবর বিপ্লব দিবস। রেড স্কয়ারে এ উপলক্ষ্যে হত প্যারেড। পলিট ব্যুরোর সদস্যরা লেনিনের দরগায় মানে মাউসেলিউমে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে হাত নাড়াতেন। আর আমরাও সেই আশীর্বাদে তুষ্ট হয়ে হৃষ্ট মনে বাড়ি ফিরতাম। অনেকে হয়তো এখানে দরগা শব্দের সাথে একমত হবেন না, তবে সেই সময় লেনিন দেবত্বের এমন এক স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন যে একে দরগা না বলাটাই বরং বেমানান। সে সময় বিজয় দিবসে আমার যেতাম মূলত গোর্কি পার্কে। কখনও বা ক্রেমলিন সংলগ্ন আলেক্সান্দ্রভস্কি বাগানে, কখনও বলশয় থিয়েটারের সামনে কার্ল মার্ক্সের স্ট্যাচুর নীচে। এসব জায়গায় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সৈনিকরা জড়ো হতেন। ঢল নামত মানুষের। ছোট ছোট বাচ্চারা আর তাদের বাবা মারা ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানাতেন তাঁদের, ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতেন তাঁদের ত্যাগের জন্য। আর যোদ্ধারা খুঁজে বেড়াতেন সহযোদ্ধাদের। কাউকে পেলে শিশুর মত জড়িয়ে ধরতেন। এ বিজয় ছিল অশ্রুসিক্ত, আনন্দ ছিল কান্নায় ভেজা।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকে এরা বলে মহান পিতৃভূমির যুদ্ধ। আমরা দেশকে সাধারণত মাতৃভূমি বলে ডাকি। এরা মাতৃভূমি (রোদিনার)র পাশাপাশি পিতৃভূমি (অতচিজনা) শব্দটাও ব্যবহার করে। যদিও দেশ মাতৃকাকে (রোদিনা মাত) এরা মহিলা রূপেই কল্পনা করে,  শিল্প এবং  ভাস্কর্যে  মাতৃ রূপেই প্রকাশ করে, তবে নেপলিয়নের বিরুদ্ধে আর নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে দুটো সর্বগ্রাসী যুদ্ধকে এরা পিতৃভূমির যুদ্ধ নামেই ডাকে। কে জানে বিজয় পৌরুষের প্রতীক বলে কি না?

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মে দিবস আর অক্টোবর বিপ্লব দিবস তাদের কৌলীন্য হারিয়েছে। ফলে ৯ মের বিজয় দিবস নতুন আঙ্গিকে এসেছে এদের চেতনায়, আর ৭ নভেম্বরের বদলী খেলোয়াড় হিসেবে এসেছে ৪ ঠা নভেম্বর জাতীয় সংহতি দিবস নামে ১৬১২ সালে পোলিশদের বিরুদ্ধে মিনিন ও পঝারস্কির বিজয় স্মরণে। আজ বিজয় দিবস পরিণত হয়েছে সত্যিকার অর্থে জনগণের উৎসবে। এই দিনকে সামনে রেখেই ১৯৯১ সালে হারানো গৌরব একটু একটু করে ফিরে পেয়েছে নতুন রাশিয়া। কয়েক বছর হল এর সাথে যোগ হয়েছে অমর ব্রিগেড (বেসস্মেরত্নি পোল্ক)  যেখানে হাজার হাজার উত্তরসূরি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিক ও সহযোগী যারা আজ বেঁচে নেই সেই সব পূর্বসূরিদের ছবি হাতে রাস্তায় নামে। এভাবেই বর্তমান প্রজন্ম স্মরণ করে তাঁদের পূর্বপুরুষদের। যুগ যুগের মানুষের ইতিহাস গাঁথা হয় এক অদৃশ্য সুতোয়।  

করোনা কারণে এবার বিজয় দিবসের প্রায় সব অনুষ্ঠানই স্থগিত রাখা হয়েছে। জনশূন্য রেড স্কয়ারের উপর দিয়ে উড়ে গেছে একের পর এক বিমান। সামাজিক দূরত্ব রেখে যাতে মানুষ তাদের ইতিহাস আর ইতিহাস সৃষ্টিকারী পূর্বসূরিদের স্মরণ করতে পারে তার জন্য চালু হয়েছে বিভিন্ন অনলাইন প্রজেক্ট। যেসব বাড়িতে এখনও কোন যোদ্ধা জীবিত আছেন, সে বাড়ির সামনে আয়োজন করা হয়েছে ছোট্ট কনসার্টের। দেশাত্মবোধক গানে কবিতায় ভরে উঠেছে বাড়ির আঙ্গিনা। করোনা কালের ব্যাপক অর্থনৈতিক টানাপোড়নের মধ্যেও জীবিত প্রতিটি সৈনিককে দেওয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের আর্থিক সহায়তা। কারণ এরা জানে তাদের যেটুকু স্বাধীনতা, যেটুকু উন্নতি সে জন্য যাদের অশ্রু, ঘাম আর রক্তের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদ পরাজিত হয়েছে সেই মানুষগুলোর কাছে তারা ঋণী। তাদের আজকের উন্নতির বীজ সেই সৈনিকদের রক্তে  ভেজানো মাটিতে রোপিত। যতদিন না দেশ মুক্তি সেনাদের প্রাপ্য সম্মান না দিতে পারে, ততদিন পর্যন্ত দেশ স্বাধীন হয় না।

সবাইকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের ৭৫ বছর উপলক্ষ্যে রইল আন্তরিক শুভেচ্ছা। সব কিছুর মত ইতিহাস বদলায়, বদলায় বিজয়। ভবিষ্যতেও বিজয়টা বিজয় থাকবে কি না সেটা নির্ভর করে আপনার, আমার, আমাদের সবার উপর!

দুবনা, ০৯ মে ২০২০




Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি