সোনার বাংলা

গতকাল সকালে উঠে দেখি পার্থ দা ট্যাগ করেছে সোনার বাংলায়। কোন কিছু পড়ার আগেই গানটা শুনলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় গেয়েছি কিনা মনে নেই, তবে যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফেরার পর প্রতিদিন গাইতাম। আমাদের বাড়িতেই ছিল মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প। ওরা প্রতিদিন সকালে পতাকা উত্তোলন করত (তখন ছিল সবুজ জমিনে টুকটুকে লাল সূর্যের মাঝে সোনার বাংলার হলুদ মানচিত্র) আর সোনার বাংলা গানটা গাইত। আমরাও গাইতাম সাথে সাথে। এরপর প্রাইমারি স্কুল আর হাই স্কুলে প্রায় প্রতিদিনই পতাকার পাশে দাঁড়িয়ে গাইতাম জাতীয় সঙ্গীত। তাই সোনার বাংলা শুনলেই মনটা নেচে ওঠে।

গান শেষে আরেকটু কাজকর্ম করে পড়তে শুরু করলাম কমেন্ট, সব নয়, কয়েকটা। তখন বুঝলাম কেন এটা পোস্ট করা হয়েছে। কেউ এর সমালোচনা করছে, কেউ গায়কদের খারাপ লোক বলছে। আমি গায়ক গায়িকাদের সম্পর্কে তেমন জানি না, মাঝে মধ্যে ফেসবুকে এদের গান কেউ দিলে শুনি। তাদের সাথে আমার সম্পর্ক গায়ক আর শ্রোতার। অন্য কোন ইন্টারেস্ট নেই। তাই তারা ভালো লোক না  মন্দ লোক, এটা বলা আমার এখতিয়ারের বাইরে। আমি শুধু তাদের গান আমার ভালো লাগে কিনা সে ব্যাপারে মন্তব্য করতে পারি।

একটু একটু ফটোগ্রাফি করি, তাই রং সম্পর্কে একটু ধারণা রাখতে হয়। রঙের বিভিন্ন কম্পোজিশন, এদের একটা "দাও কালার"। সেখানে তো বটেই, অন্য অনেক জায়গায়ই কমপ্লিমেটারি কালার বলে একটা কথা আছে। সাদা-কালোর মতই লালা-সবুজ, আসমানি-কমলা, হলুদ-বেগুনি এরকম জোড়া তৈরি করে। যার ফলে নীল আকাশে অস্তগামী কমলা সূর্য মানুষের এতো প্রিয়। একই কথা লাল-সবুজের কম্বিনেশনের ক্ষেত্রে খাটে। কিন্তু আমি যখনই লাল আর সবুজের কম্বিনেশন দেখি মনে পড়ে বাংলাদশের পতাকার কথা। কিন্তু সেটা আমার বা বাংলাদেশের যেকোনো মানুষের বিশেষ আবেগের কারণে। বিশ্বের বাকি প্রায় ৭ বিলিয়ন মানুষ সেটা ভাবে না, তারা যেকোনো ভাবে এই দুই রং ব্যবহার করে বা করতে পারে। সত্যি বলতে কি সবুজ জমিনে লালা সূর্য হলেই  যে সেটা বাংলাদেশের পতাকা হবে তা কিন্তু নয়। এর জন্য একটা নির্দিষ্ট অনুপাত মেনে চলতে হবে। তাই সবুজ পাতার ভিড়ে রক্তজবা দেখলেই যদি আমার বাংলাদেশের পতাকা মনে হয় সেটা আমার সমস্যা। আমি অন্য কাউকে সেভাবে ভাবতে বলতে পারি না।

বছর দু তিন আগে এভাবেই ভারতের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে একটা ক্লিপ বেরিয়েছিল। আমার ভালো লেগেছিল। এর আগে এই গানটি পুরোটা শুনিনি। আর ওভাবে গাইবার ফলে সেটা ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বলেও মনে হয়নি। এ নিয়ে ভারতে কোন কথা উঠেছে কিনা সেটাও জানি না। এখানেও কিন্তু একই ব্যাপার ঘটেছে। "সোনার বাংলা"র শুধু প্রথম অংশ বাংলাদেশ জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করেছে, পুরো গানটি নয়। তাই  ওদের গাওয়া এই গানটিকে ঠিক বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে দেখা যায় কিনা সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান। তাছাড়া যতদূর জানি একটা সময় পর্যন্ত রবীন্দ্র সঙ্গীতের ব্যাপারে কথা বলার অধিকার ছিল একমাত্র বিশ্বভারতীর। সেটা এখন কাজ করে কিনা জানি না। আর তাদের মূল কাজ ছিল শুধুই সুর, মানে অফিসিয়াল স্বরলিপি মেনে গাইছে কিনা সেটা দেখা। নচিকেতা প্রায়ই রবীন্দ্র সঙ্গীত নিজের মত করে গায়, যেটা আমার পছন্দ হয় না। তবে আজকের গানে নচিকেতা বা অন্য কেউ স্বরলিপি না মেনে গেয়েছে কিনা সেটা জানি ন। সত্যি বলতে কি, প্রতিদিন বাংলাদেশের হাজার হাজার স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা যখন জাতীয় সঙ্গীত গায়, তারা কতটুকু স্বরলিপি মেনে গায়, সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। হ্যাঁ, জাতীয় সঙ্গীত বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্যেই গাওয়া উচিৎ, তবে আমি নিজে পথে যেতে যেতে নিজের অজান্তেই অনেক সময় সোনার বাংলা গেয়ে উঠি। সেটাও কি তাহলে আইনত দণ্ডনীয়? তাছাড়া এই শিল্পীরা বলতেই পারেন যে তারা গানটা নেহায়েত রবীন্দ্র সঙ্গীত হিসেবে গাইছেন। তাহলে কী তাদের বিরুদ্ধে আইনত কোন ব্যবস্থা নেওয়া যায়? আসলে আবেগ এক জিনিস আর আইন একেবারেই ভিন্ন জিনিস। এরা প্রায় সব সময়ই ভিন্ন পথের যাত্রী। দেশে অনেকেই এখন শুধুমাত্র রবীন্দ্র সঙ্গীত হওয়ার কারণে জাতীয় সঙ্গীত বদলানোর কথা বলে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই শিল্পীরা আর যাই হোক, রবীন্দ্র সঙ্গীতের বিরোধিতা করার জন্য গানটি গাননি। অনেক সময় অনেক কিছু এড়িয়ে যাওয়া অনেক ভালো। কেনন না এ নিয়ে কে দোষী আর কে নির্দোষ এ আলোচনায় গেলে রবীন্দ্র বিরোধীরাই ফসল ঘরে তুলবে, রবীন্দ্র প্রেমীরা নয়। দেশপ্রেমীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।   

দুবনা, ১৮ জুন ২০২০ 


Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি