গল্পে গল্পে ভল্গা তীরে
ছোটবেলায়
ছেলেমেয়েরা সানন্দে আমার সাথে ঘুরতে যেত। বড় হয়ে সেটা আর তেমন করতে চায় না। সামারে
বাইরে গেলেও এই ঝামেলা। শুধু ফ্যামিলি কেন, কোন এক্সারশনে (তা সে কোন কনফারেন্স
থেকেই হোক আর অন্য কোন গ্রুপের সাথেই হোক) গেলেও একই সমস্যা। আমি ছবি তুলতে তুলতে
কোথাও চলে যেতে পারি আর ওদের সবাইকে আমার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ২০১৪ সালে তো
তাজমহল দেখতে গিয়ে বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড। শেষ পর্যন্ত দিল্লীতে চঞ্চলকে ফোন করে ওরা
আমার হদিশ পায়। এখন বিকেলে বনে বা ভল্গার তীরে হাঁটতে গেলে একই অবস্থা। অবশ্য
আমাকে ট্রিপড বসাতে দেখলেই গুলিয়া কুকুর নিয়ে হাঁটতে যায় আর মিনিট পনের বিশ পর পর
এসে দেখে যায় আমি আছি কিনা। মনিকা বা ক্রিস্টিনা সাথে থাকলে জানে ছবি তুলব, তাই
ওরা ছবি তোলার জন্য প্রস্তুত হয়েই যায়। আন্তনকে ডাকি গভীর রাতে (১২ তার পরে) বা
খুব সকালে (সকাল ৩ বা ৪ টার দিকে) ছবি তুলতে গেলে নিরাপত্তা জনিত কারণে। সেভা আগে
সব সময় যেত। এখন ঘুরতে যেতে বললেই জানিয়ে দেয় ক্যামেরা যেন না নিই। (মনে পড়ে, ধার
দেনা শোধের জন্য তুরস্ক গিয়ে সারা দিন ছবি তুলে বেড়িয়ে যখন ধার আরও বেড়ে যায়
বন্ধুরা বলেছিল, আমি এরপরে বিজনেস ট্রিপে যাওয়ার আগে ওরা আমার ক্যামেরা সীজ করবে)।
তবে সেভা ইদানীং এক নতুন বুদ্ধি বের করেছে। বাসা থেকে বেরুনোর সাথে সাথেই কোন এক
প্রশ্ন করে বসে। সেটা কসমোলজির উপর হতে পারে বা কোন ফুটবল টীম, কোন গ্রুপ বা রাজনীতি
নিয়ে। ও বুঝে গেছে আমাকে একবার উস্কে দিতে পারলে দেড় - দুই ঘণ্টার জন্য ক্যামেরায় আর হাত পড়বে না। আসল কথা
আমাকে তর্কে জড়িয়ে ফেলা।
কয়েকদিন আগে সেভা দুবনা বেড়াতে এলে দুজনে ঘুরতে যাই ভল্গার তীরে।
তুমি দেখছ আমেরিকায় কী শুরু হয়েছে?
হ্যাঁ। এটাকে ঠিক শুরু বলা চলে না। এটা অনেক আগে শুরু হওয়া সামাজিক বৈষম্যের
বহিঃপ্রকাশ।
তোমার কি মনে হয় না ট্রাম্প বোকা?
দেখ, একজন লোককে বোকা বলার জন্য যতটুকু জানা দরকার আমি ততটা জানি না ট্রাম্প
সম্পর্কে। তাছাড়া এই যে তুই হুট হাট এক জনকে বোকা বললি, সেটাও ঠিক নয়।
কিন্তু সবাই তাই বলে।
সবাই বললেই তোকে বলতে হবে তার মানে নেই।
তাহলে কী বুঝতে হবে সে বোকা নয়?
আবারও বলছি, একজন লোক সম্পর্কে এরকম মন্তব্য করতে হলে অনেক কিছু জানতে হয় তাঁর
সম্পর্কে। আমি যতদূর জানি উনি একজন সফল বিজনেসম্যান। শো বিজনেসে যথেষ্ট সফল ছিলেন।
আজ যারা তাঁর সমালোচনা করছে বছর পাঁচেক আগে এদের অনেকেই তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ
ছিল। অনেক তাঁর সাফল্যে ঈর্ষা করত। অনেকে তাঁর পাশে বসার জন্য, তাঁর শোতে অংশ
নেওয়ার জন্য পাগল ছিল। বলতে গেলে আমেরিকার দুই প্রধান দলের এস্টাব্লিসমেন্টের
বিরোধিতা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোটে জিতে অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিতে পৃথিবীর
সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এতগুলো বাধা পার হওয়া তো চাট্টিখানি
কথা নয়। এটা শুধু ভাগ্যের উপর নির্ভর করে হয় না। বোকা হলে তো হয়ই না। সবচেয়ে বড়
কথা কি জানিস? ট্রাম্প যদি প্রেসিডেন্ট ইলেকশন না করতেন বা প্রেসিডেন্ট না হতেন আজ
আমরা তাঁকে নিয়ে কথা বলতাম না। না আমি, না তুই, না পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ - আর
যাই বলুক তাঁকে কেউ বোকা বলত না। এজন্যেই যদি কোন বিষয়ে আমাদের আলোচনা করতে হয়,
সেটা প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর সাফল্য বা ব্যর্থতা নিয়ে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি কি ব্যর্থ?
এটা তিনি যে দেশের প্রেসিডেন্ট সে দেশের লোকেরা বলবে। আমরা বলতে পারি তাঁর
পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে যা আমাদের উপর প্রভাব ফেলে। আমি এখানে ৩৭ বছর। এর আগে কোন
প্রেসিডেন্ট রাশিয়ার জন্য এত ক্ষতিকর ছিলেন না। অন্তত নতুন রাশিয়ায়। কেননা সোভিয়েত
ইউনিয়ন ভাংতে রেগ্যানের বিশাল ভূমিকা ছিল, যদিও সেটা মূলত হয়েছে সোভিয়েত ব্যবস্থার
ব্যর্থতার কারণেই। এটা ঠিক আমেরিকার অন্য কোন প্রেসিডেন্টকে দেশের ভেতর এত
বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়নি। বাংলাদেশে মূলত দুটো রাজনৈতিক দল। যারা টোটালি
আন্টাগনিস্টিক। কোন
বিষয়েই একমত হতে পারে না। তাদের চেষ্টাই থাকে যেকোনো ভাবেই হোক প্রতিপক্ষকে হেয়
করা। তাতে দেশের ভালো না মন্দ হল সেটা নিয়ে কোন দলের মাথা ব্যথা নেই। এক সময়
আমেরিকার দু দলকে দেখতাম
শত মতবিরোধের পরেও
দেশের বিপদে সবাই এক কাট্টা হয়ে কাজ করত। এখন সেখানেও বাংলাদেশের অবস্থা। দেশের বা
মানুষের কী হল, তাতে কারও কিছু এসে যায় না। আসল কথা কে কাকে কতটা হেয় করতে পারে।
এক সময় বাংলাদেশে দেখতাম একদল অন্য দলের নেতা কর্মীদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ
করছে। এখন গণতন্ত্রের দুর্গ আমেরিকায় সেটা ঘটছে। এসব তো এক দিনে হয় না। দীর্ঘ
দিনের জমে থাকা ক্ষোভ, বৈষম্য এসব করছে।
তুমি কী বলতে চাইছ,
বর্তমানে যা ঘটছে তার পেছনে ট্রাম্পের কোন দোষ নেই?
না, আমি সেটা বলছি না। যারা ট্রাম্পের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দিতে চায় তারা এটা করে
ট্রাম্পের প্রতি তাদের বিরোধিতা থেকে।
তারা মনে করে সমস্যাটা ট্রাম্পে। আমার মনে হয় সমস্যা সিস্টেমে। যদি সেটা না হত,
ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার কথা ছিল না। কী ডেমোক্র্যাটিক কী রিপাবলিক - আমেরিকার
পলিটিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্টের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়েই কিন্তু মানুষ ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে, এটা ছিল প্রতিবাদী ভোট।
এস্টাব্লিশমেন্ট কিন্তু সেটা বুঝতে চাইছে না বা স্বীকার করছে না, সব দায় ট্রাম্প
আর রাশিয়ার ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেদের অতীতের ব্যর্থতা ঢাকতে চাইছে। বিপদটা এখানেই। রোগ
মুক্তির জন্য দরকার সঠিক ডায়াগনোসিস। সেটা হচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে। আসলে কেনেডির
পর থেকে প্রায় সব প্রেসিডেন্টই আমেরিকার এস্টাব্লিশমেন্ট দ্বারা পরিচালিত। ফলে
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি যাই থাকুক, দিনের শেষে সবাই সিস্টেমের কাছে হার মেনেছে।
ট্রাম্পের সমস্যা হল তিনি কর্পোরেট স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করলেও এস্টাব্লিশমেন্ট
নিজের লোক নন। আর মরার উপর খাঁড়ার ঘা হল তাঁর এক্সট্রাভ্যাগান্ট কাজকর্ম। সবচেয়ে
বড় কথা তিনি এস্টাব্লিশমেন্টের প্রতি অনুগত নন।
কিন্তু তুমি যেসব বলছ সেটা তুমি জান কিভাবে? তুমি তো দূর থেকে দেখে বা শুনে এসব
বলছ।
তা ঠিক। তুই খেয়াল করেছিস, আমি যখন ছবি তুলি বেশ কয়েকটা শট নেই। বিশেষ করে কোন
অনুষ্ঠানের ছবি তুলতে গেলে যেমন পুরা হলের বা মিছিলের ছবি নেই, তেমনি নেই কয়েকজন
লোকের, আবার কোন একজনের মুখ, কখনও হয়তো মুষ্টিবদ্ধ হাত, অথবা খোঁপা বা কানের দুল।
যখন পুরো হলের ছবি তুলি সেটা দেখায়
উপস্থিতিড় সংখ্যা কিরকম ছিল। সেটা এই অনুষ্ঠানের প্রতি মানুষের আগ্রহ কেমন সেটা
জানায়। গ্রুপ ছবি দেখে বুঝি লোকজন কীভাবে দেখেছে বা কী করছে অনুষ্ঠানে এসে। একটা মুখ - এটা অনুষ্ঠান দেখে তার
আবেগের প্রকাশ। মুষ্টিবদ্ধ হাতও তাই। খোঁপা বা কানের দুল বা ফুল দেখে বুঝি আসার
আগে তার প্রস্তুতি। তার মানে হল কোন কিছুর বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য আমাদের
বিভিন্ন জায়গা থেকে সেটা দেখতে হবে। ভেতরে বাইরে সব জায়গা থেকে।
কিন্তু তুমি তো দূর থেকে দেখছ।
তা তো বটেই। তবে এতে করে আমার সুযোগ থাকে নিরপেক্ষ ভাবে ঘটনার বিচার করা। বলেনা
চাক্ষুষ সাক্ষী সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী।
কেন?
কারণ সে শুধু এক জায়গা থেকে ঘটনাটা দেখে। অন্য জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখলে একই ঘটনা সেটা
অন্য রকম দেখত। তাই তো কোন ঘটনার নিরপেক্ষ চিত্র পেতে হলে অনেককে জিজ্ঞেস করতে হয়,
বিভিন্ন মানুষের সাক্ষী নিয়ে তারপর সেটার সঠিক চিত্র আঁকতে হয়। যদি আমি এখন
আমেরিকায় থাকতাম নিশ্চয়ই কোন না কোন ভাবে ঘটনাবলী দ্বারা প্রভাবিত হতাম। কোন না
কোন দলের পক্ষ নিতাম। তবে এটাও ঠিক অনেক কিছু নিজের চোখে দেখতে পেতাম। তবে সবচেয়ে
বড় কথা ইনফরমেশন, কতটুকু তথ্য আমরা পাচ্ছি আর কোন কোন সোর্স থেকে পাচ্ছি। যদি
বিভিন্ন সোর্স থেকে ইনফরমেশন নেওয়া যায় আর নিরপেক্ষাভবে সেগুলো এনালাইসিস করা যায়
তাহলে কমবেশি একটা গ্রহণযোগ্য চিত্রও আঁকা যায়। তবে জানিস কী, যত ভালো, যত সঠিক চিত্রই
আঁকিস সব সময়ই কেউ না কেউ তাতে ভুল বের করবে বা সঠিক নয় বলে দোষারোপ করবে। আমাকে
প্রায়ই এর সম্মুখীন হতে হয়। মস্কোয়
আমাদের একটা সংগঠন আছে। বাংলাদেশীদের। আমার মতামত জানতে চায়। কখনও শুনে কখনও শোনে
না। অনেক সময় যুক্তি দিয়ে বোঝায় কেন আমি ঠিক বলছি না। কিন্তু যদি যুক্তি না থাকে
আর আমার মত গ্রহণ করতে ইচ্ছে না থাকে বলে "আপনি দুবনায় থাকেন। লোকজনের সাথে তো আমাদের মিশতে হয়,
অনেকের মতামত, আবেগ এসব বিবেচনায় নিতে হয়।" আবার আমি যখন দেশের ব্যাপারে লিখি
অনেকেই বলে "রাশিয়ায় বসে আমি দেশের ব্যাপারে কেন নাক গলাব, কেন লিখব। এরাই
আমার আমার মতে তাদের মতের প্রতি সমর্থন পেলে সেটা লুফে নেয়।" আসল কথা হল
স্বার্থ। বাইরে বসেই হোক, ভেতরে থেকেই হোক, যদি কেউ নিরপেক্ষ ভাবে কোন ঘটনার
এনালাইসিস করতে পারে, সে নিঃসন্দেহে সঠিক চিত্র আঁকতে পারবে। আর সেটা কেউ গ্রহণ
করবে কী করবে না তা নির্ভর করবে এই চিত্র ঐ লোকের পক্ষে যাবে নাকি বিপক্ষে।
তুমি কিন্তু এখনও বললে না ট্রাম্প ভালো বা মন্দ।
সেটা বলার উদ্দেশ্য আমার কখনোই ছিল না, এখনও নেই। ব্যাপারটা ট্রাম্প ভালো না মন্দ
তাতে নয়, সমস্যাটা সিস্টেমের। সেটা সবাইকে বুঝতে হবে আর সেটা বুঝে প্রয়োজনীয়
ব্যবস্থা নিতে হবে। যেকোনো সমস্যা সমাধানের প্রথম ও প্রধান শর্ত নিজেদের ভুল খুঁজে
বের করা, ভুল স্বীকার করা এবং অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে সমাধানের পথ খোঁজা।
কিন্তু শুধু এটুকু বলার জন্য তুমি এতক্ষণ ধরে এত কথা বললে?
আমি তো তোকে আমার মত জানাতে এসব বলিনি। আমি চেয়েছি তুই যেন কোন ব্যাপারে কোন
সিদ্ধান্তে আসার আগে বিভিন্ন দিক থেকে সেটা বিচার করিস, যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষ ভাবে
সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করিস। আমি যদি আমার মতামত জানাতাম, তুই সেটা গ্রহণ বা বর্জন করতি, ঠিক যেমন
ইন্টারনেটে পড়ে তুই বলেছিলি ট্রাম্প বোকা। এখন আরও তথ্য সংগ্রহ করে ঠাণ্ডা মাথায়
সেসব এনালাইসিস করে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবি আমেরিকা যা ঘটছে সেটার শুরু কবে,
কারণ কি আর ট্রাম্প কতটুকু দায়ী।
দুবনা, ১৩ জুন ২০২০
Comments
Post a Comment