একজন কামাল লোহানী
ছোটবেলায়
নদীর তীরে দাঁড়িয়ে দেখতাম কিভাবে তীরের পাশে কিছু খড়কুটো উল্টো স্রোতে চলছে। উল্টো স্রোত অল্প হলেও কাউকে না
কাউকে তার সাথে নিয়ে যাচ্ছে উজান পানে। এই উল্টো স্রোত শুধু উজানেই নেয় না,
প্রতিবাদই জানায় না, নিকটবর্তী তীরের আভাসও দেয়। কামাল লোহানী তাঁদের একজন যারা
দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবল স্রোতের বিরুদ্ধে সেই বাহান্নতেই প্রথম উল্টো স্রোত তৈরি করেছিলেন, পরে
সেই স্রোতকে মূল স্রোতে পরিণত করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন।
গত বছর
এই
দিনে কামাল লোহানী
চলে গেছেন আমাদের ছেঁড়ে।
আসলে চলে যায় আমাদের মত সাধারণ লোকেরা। কামাল লোহানীরা যান না, তাঁরা রয়ে যান
তাঁদের কর্মে, তাঁদের আদর্শে। শুধু মশালটা দিয়ে যান আমাদের হাতে। সেটা কতদূর নিয়ে
যেতে পারলাম আর সেই মশালের আলোয় কতজনকে আলোকিত করতে পারলাম সেটা নির্ভর করে
আমাদের যোগ্যতা, দক্ষতা, নির্লোভ, নিরিলস পরিশ্রমের উপর।
আশির
দশকে মস্কোয় থাকার ফলে বাম ঘরানার অনেকের সাথেই পরিচয় হয়েছিলাম ব্যক্তিগত ভাবে। মনে করতে পারছি না
তাঁর সাথে দেখা হওয়ার কথা। তবে বিগত বছরগুলোতে হাতে গণা যে কয় জন মানুষ একাত্তরের চেতনা নিয়ে কথা
বলেছেন, বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে কথা বলেছেন তিনি তাঁদের অন্যতম। যেখানে রাজনৈতিক
দলগুলো বারবার
ব্যর্থ হয়েছে সেখানে তিনি ঠিকই সংখ্যালঘু সহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সোচ্চার
হয়েছেন। আর এসব পেরেছেন নিজের বা দলের চেয়ে দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখেছেন বলে।
তাঁর মত আমিও মনে করি বাংলাদেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির মূলমন্ত্র বাহাত্তরের
সংবিধানেই নিহিত।
কামাল লোহানীর আরও একটা পরিচয় উনি আমাদের ভিপুস্কনিৎসা ঊর্মির বাবা। বছর দেড়েক আগে ঊর্মি আমার সাথে যোগাযোগ করে একটা লেখার ব্যাপারে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে ওরা সঙ্কলন বের করছে। এর মধ্যে আমার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে একটা লেখা প্রস্তুত ছিল, তবে সেটা এই ফরম্যাটের জন্য নয়। ঊর্মিকে তাই একটা নতুন একটা লেখা দিলাম আর আগের লেখাটা পাঠালাম লোহানী কাকুর জন্য। জানি না উনি পড়েছিলেন কিনা। কিন্তু এভাবেই একটা ব্যক্তিগত আবেগের সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল তাঁর সাথে। আমরা আমাদের জাতীয় বীরদের ভুলে যেতে সদা সচেষ্ট। জাতি কি করবে আমি জানি না, তবে আশা করব আমরা যারা নিজেদের প্রগতিশীল মনে করি, একাত্তরের চেতনায়, বাহাত্তরের সংবিধানে বিশ্বাস করি, তারা যেন তাঁর স্বপ্নকে একটু হলেও সামনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করি। আর এই চেষ্টার মধ্য দিয়েই লোহানী কাকুদের মত আনসাং হিরোদের স্মৃতিকে ধরে রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য। কারণ এটাই বাংলাদেশের আসল ইতিহাস।
দুবনা,
২০ জুন ২০২১
লেখাটি প্রথম ভার্সন এখানে বেরিয়েছিল ২০ জুন ২০২০ সালে আর বর্ধিত বর্তমান ভার্সন প্রকাশিত হয়েছিল ২০ জুন ২০২১ প্রগতির যাত্রীতে
https://www.progotirjatree.com/2021/06/22/%e0%a6%8f%e0%a6%95%e0%a6%9c%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%b2-%e0%a6%b2%e0%a7%8b%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%80-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%9c%e0%a6%a8-%e0%a6%b8%e0%a6%be/
Comments
Post a Comment