ভোটের ভূত

২৪ জুন  মস্কোয় বিজয় দিবসের প্যারেড হল করোনা ভাইরাসের কারণে গতানুগতিক নিয়ম অনুযায়ী মে প্যারেড হয়নি ২৪ তারিখে সেটা করার অন্যতম কারণ ১৯৪৫ সালে বিজয়ের ঠিক পরপরই এই ২৪ জুন বিজয় প্যারেড হয়েছিল রেড স্কয়ার বা ক্রাসনায়া প্লসিদে এটা নিঃসন্দেহে বিশাল এক চ্যালেঞ্জ শত্রু (করোনা) পিছু হটতে শুরু করলেও এখনও সীমানা পেরিয়ে যায়নি এসময় এমন বিশাল জমায়েত তাই রিস্কি তবে এর প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে দীর্ঘ লকডাউনের পর মস্কো খুলে দেওয়া হয়েছে এই প্যারেড একদিকে যেমন রিস্কি, অন্যদিকে তেমনি আশা জাগানীয়া পুতিন সাধারণত খুব হিসাব-নিকাশ করেই পথ চলেন আশাবাদী কারণেই যে আজকের প্যারেড পুতিন বা তার টীম করোনা ভাইরাস যে আয়ত্ব্বের মধ্যে সেটা বিশ্বাস করেন একথাই বলে আর বিশ্বাস নিশ্চয়ই শুধু রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নয়, করোনার সাথে লড়াই করছে যারা সেই সব ডাক্তার বিজ্ঞানীদের মতের প্রতিফলন    

আগামী ১ জুলাই এদেশের মানুষ সংবিধান পরিবর্তনের জন্য ভোট দেবে
নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন কথা আছে পক্ষে ও বিপক্ষে  বলছে লোকজন সরকারি টিভিতে পরিবর্তনের পক্ষে বলা হলেও ইন্টারনেটে পরিবর্তনের বিপক্ষে অনেকেই বলছে আমার বন্ধুদের অনেকেই এ নিয়ে বিভিন্ন মত প্রকাশ করছে

যেহেতু আমার কাজকর্ম গবেষণার সাথে জড়িত আর বন্ধু বান্ধবদের অধিকাংশই শুধু উচ্চ
শিক্ষায় শিক্ষিতই নয়, আনালিটিক্যালি চিন্তা ভাবনা করে, মানে যেকোনো ব্যাপারে চিন্তা ভাবনায় ম্যাথেম্যাটিক্যাল লজিক ব্যবহার করে, এখানে বিরোধী মতবাদ বরাবরই শক্তিশালী সেটা কোন  নির্দিষ্ট ব্যক্তির বিরোধিতা নয়, প্রচলিত ব্যবস্থার বিরোধিতা করা বা সেটাকে সন্দেহের চোখে দেখা সন্দেহ, প্রচলিত ব্যবস্থায় অবিশ্বাস  - এটা গবেষণার চালিকা শক্তি  মনে পড়ে সোভিয়েত আমলের কথা পেরেস্ত্রইকার শেষের দিকে আমার বন্ধুরা প্রায় সবাই মস্কোভস্কি কমসমলেতস পড়ত আর গরবাচেভের বিরোধিতা করত তাদের অনেকেই ইয়েলতসিনের সমর্থক ছিল তখন আমাদের জন্য বিভিন্ন এক্সারশনের আয়োজন করা হত আজও মনে পড়ে এমন এক এক্সারশনে আমরা গিয়েছিলাম ভ্লাদিভস্তক দেখা হয়েছিল পরিব্রাজক ফিওদর কনিউখভের সাথে, মিটিং হয়েছিল শহরের পার্টির লোকজনদের সাথে আমি সেখানে তাদের অতি মাত্রায় গরবাচভ প্রীতির সমালোচনা করেছিলাম, তাদের মস্কোভস্কি কমসমলেতস পড়ার কথা বলেছিলাম ১৯৯১ সালের আগস্টের দিনগুলোতে ইয়েলতসিনকে সমর্থন করে “বেলি দমের” ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম ইয়েলেতসিনের ক্ষমতায় যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বুঝেছিলাম যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ, তাই ধীরে ধীরে তাঁকে সাপোর্ট করা থেকে বিরতহয়েছিলাম

আসলে আমরা যারা সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করতাম, সবাই নিজের অগোচরেই দেশটাকে ভালবেসে ফেলেছি, বিশেষ করে দেশটা নাই হয়ে যাওয়ার পর সে ভালবাসাটা যেন আরও তীব্র হয়েছে তাই যখনই দেখতাম এক সময়ের উন্নত শির সেই রুশ বা সোভিয়েত জাতির মাথা হেহয়ে যাচ্ছে অযোগ্য আর আপকামী নেতৃত্বের কারণে, নিজের খুব কষ্ট যেন ছিল ১৯৪৩ মস্কোর উপকণ্ঠে কোণঠাসা সোভিয়েত জনগণের মত, যখন সবাই এক গলায় বলে ওঠে পেছেনে মস্কো, আর পিছু হটবার জায়গা নেই ঠিক সেই মুহূর্তেই অপ্রত্যাশিত ভাবে পুতিনের আগমন, প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, পরে ইয়েলতসিন সবাইকে অবাক করে নিজে পদত্যাগ করেন পুতিন হন রাশিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট আসলে এসব একদিনে হয়নি তার আগে পুতিন যখন রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি ছিলেন, তখন তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহনে রুশ সৈন্যরা কসোবার এয়ারপোর্ট দখল করে ন্যাটোর কম্যান্ডারদের হতবাক করে দেয় আর এরও আগে গরবাচভ যখন পশ্চিম জার্মানির কাছে পূর্ব জার্মানি হস্তান্তর করেন, পুতিন বলতে গেলে একাই কেজিবির জার্মান অফিস তার দলিলপত্র ক্ষুব্ধ জার্মানদের হাত থেকে রক্ষা করেন তাই আমাদের বা সাধারণ মানুষের কাছে Who is Mr. Putin একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হলেও সেনাবাহিনী বা গেনস্তাব মানে আরমি হেড কোয়ার্টারে অপরিচিত ছিলেন না এরপর আসে চেচনিয়ায় বিজয় অনেক সাফল্য-ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া প্রায় খণ্ড খণ্ড অংশে ভেঙ্গে যাওয়া রাশিয়াকে একটা একক রাষ্ট্রে পরিণত করা বর্তমান দলিলপত্র বলে কেজিবি প্রধান ইউরি আন্দ্রপভ সোভিয়েত দেশের দুর্বলতা সম্পর্কে খুব ভালভাবে অবগত ছিলেন আর সে জন্যেই তিনি চেষ্টা করছিলেন এদেশের শাসন ব্যাবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনার পুতিন অনেক দিন পূর্ব জার্মানিতে ছিলেন, তাই তিনিও সোভিয়েত অর্থনীতির ব্যাপারে মোহমুক্ত ছিলেন অনেকের ধারণা গরবাচভ বা ইয়েলতসিনের চেয়ে পুতিন অনেক বেশি পশ্চিমপন্থী আর সে কারণেই ২০০১ সালে আমেরিকার উপর সন্ত্রাসবাদী হামলা  হলে তিনিই প্রথম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, এমন কি রাশিয়ার ন্যাটোভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেননি আসলে তখন যথেষ্ট সুযোগ ছিল পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে আমেরিকা, রাশিয়া এবং ইউরোপিয়ান দেশগুলোর একসাথে কাজ করার, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব সে পথে যায়নি বরং সর্বোতভাবে চেষ্টা করেছে রাশিয়াকে শত্রু পক্ষ বানাতে ব্যাপারে হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, “সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙ্গে আমরা নিজেদের বিজয়ী ভেবেছিলাম, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির সাথে সাথে আমেরিকা তথা পশ্চিমা বিশ্ব প্রতিযোগীকে হারিয়েছে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন এক সময় পশ্চিমা বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ রাখত, তার বিলুপ্তি আজ নিজেদের ভেতরকার সমস্ত মতানৈক্য উস্কে দিয়েছে  একটা সম্মুখ সমরে জয়লাভ করলেও আজ আমরা যুদ্ধে হারতে বসেছি

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সংবিধান পরিবর্তন করা দরকার ছিল কি না? হয়তো না করলেও চলত, তবে যদি বড় ধরণের পরিবর্তন করতেই হয় আর করতে হয় জনসমর্থন নিয়ে, তবে সেটা করা উচিৎ জনপ্রিয় নেতার অধীনেই তাতে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যায় এখানে মনে রাখা দরকার, ১৯৯৩ সালে ইয়েলতসিনের রাশিয়া সংবিধান গ্রহণ করে পার্লামেন্টে গুলি চালিয়ে গণতন্ত্রের নামে হলেও গণতন্ত্রকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েই সেটা করা হয় তাছাড়া তখন সেটা করা হয়েছিল পশ্চিমা বিশ্বকে খুশি রাখার জন্য, তাদের সরাসরি হস্তক্ষেপে  দীর্ঘ দিনের সোভিয়েত ইতিহাসকে উপেক্ষা করে আমেরিকার স্টাইলে সংবিধান করা হয় আর সেটা করা হয় যাতে কখনই সোভিয়েত সিস্টেমে ফিরে যাওয়া না যায় সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে যদি কে কতদিন প্রেসিডেন্ট থাকতে পারে সে কথাই ধরি আমেরিকা বাদে প্রায় সব পশ্চিমা দেশেই অনেকেই যুগ যুগ ক্ষমতায় আছেন, থাকেন এঞ্জেলা মেরকেল এর তরতাজা উদাহরণ আচ্ছা, যেখানে সিনেটররা যুগ যুগ ধরে ক্ষমতায় আছেন সেখানে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট যদি দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতেন কার কী অসুবিধা হত এখন ট্রাম্প আর বাইডেনের সব রেকর্ড দেখে তো মনে হয় দুই টার্মের ব্যারিয়ার না থাকলে আমেরিকানদের অন্য চয়েজ হত সব চেয়ে বড় কথা, সেই ব্যারিয়ার কার পক্ষে কাজ করছে? জনগণের? কে জানে? একজন লোক যখন বার বার ক্ষমতায় আসেন, তাঁকে খারাপ বা স্বৈরাচারী হতে হবে এমন তো কথা নেই গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হলে, জনগণের ম্যান্ডেট থাকলে নেতা সত্যিকার অর্থেই শক্তিশালী হয়, যেমন ছিলেন রুজভেল্ট উল্লেখ্য, এর পরেই কিন্তু এই দুই টার্মের কথা আসে ফল কী দাঁড়ায়? প্রথম টার্ম প্রেসিডেন্ট কাজ করে দ্বিতীয় টার্মে নির্বাচিত হওয়ার জন্যে, আর নির্বাচিত হলে তাঁকে বলা হয় খোঁড়া হাঁস মানে Lame Duck. এর ফলে শক্তিশালী কর্পোরেট স্বার্থের কাছে কোন প্রেসিডেন্টই  মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারে না তাই যারা আমেরিকান গণতন্ত্রে দুই টার্ম নিয়ে গর্ব করেন, তারা আসলে জেনে বা না জেনে ওয়াল স্ট্রীটের হাত শক্তিশালী করেন এটা গণতন্ত্রের বিজয় নয়, শক্তিশালী কর্পোরেট অর্থনীতির কাছে গণতন্ত্রের পরাজয়।

যাকগে, ফিরে আসা যাক রাশিয়ানির্বাচনের কথায় পশ্চিমা বন্ধুদের খুশি রাখতে এদের সংবিধানে আন্তর্জাতিক আইনকে আভ্যন্তরীন আইনের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে এটা কী আপনারা আমেরিকা বা অন্যান্য পশ্চিমা দেশের ক্ষেত্রে কল্পনা করতে পারেন? এরা চাইছে নিজেদের আইনকে আন্তর্জাতিক আইনের উপরে স্থান দিতে এতে আমি অন্তত খারাপ কিছু দেখি না পশ্চিমা বিশ্ব তখন মনে করত ঠাণ্ডা যুদ্ধে তারা জয়ী হয়েছে, তাই যা খুশি তাই করা যায়, যেমনটা করেছিল প্রথম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জার্মানির সাথে

যদি একটু খেয়াল করি, দেখব সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবিধানে এর অঙ্গরাজ্যগুলোর বেরিয়ে যাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছিল ফলে সবাই আইনের মধ্যে থেকেই সেটা করেছে, শুধু তাই নয়, অনেক প্রজাতন্ত্র রাশিয়ার ভূমি সাথে করে নিয়ে গেছে ইয়েলতসিন নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন রাজ্যকে বলেছিলেন, “যতটুকু হজম করতে পার, ততটুকু সার্বভৌমত্ব নিয়ে নাওফলে অনেকগুলো প্রজাতন্ত্রের সংবিধান সেরকম ভাবেই করা হয়েছে পুতিন শক্ত          হাতে কেন্দ্রবিমুখী বলকে (centrifugal force) হার মানিয়ে দেশটাকে এক রাখতে পেরেছেন কিন্তু কখনও যদি কেন্দ্রে দুর্বল নেতৃত্ব আসে  আবার যে সেই শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াবে না,  সোভিয়েত ইউনিয়নের মত রুশ দেশটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে না, সেটা কে জানে? ফলে কোন অবস্থাতেই রাশিয়ার ভূমি নিয়ে দর কষাকষি চলবে না, রুশ ভূমি কাউকে দেওয়া চলবে না দেশের অখণ্ডতা বজায় রাখতে কোন জাতি না চায়? বিশেষ করে অনেক পশ্চিমা দেশ প্রকাশ্যেই যখন রাশিয়ার এত ভূমি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে, তখন দেশের অখণ্ডতার দাবি কি এমন অন্যায়? তাছাড়া ভেবে দেখুন প্রিবাল্টিক, ইউক্রাইন, মধ্য এশিয়ার দেশ গুলোর কথা তিরিশ বছর পরেও জাতিগত, ভাষাগত সমস্যা রয়েই গেছে তিরিশ বছর কেন, তিয়াত্তর বছর পরেও কী উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যা মিটেছে? এখন ভাবুন মস্কোর মত মাল্টিন্যাশনাল শহর যেখানে রুশ বাদেও বিভিন্ন জাতির বিশাল বিশাল ডায়াস্পরা আছে, তাদের কী হবে? আবারও যে ছেচল্লিশের কোলকাতা ফিরে আসবে না সেটা কে বলবে? আপনি যখন আইন তৈরি করেন তখন কিন্তু ভাবেন না অপরাধ হবেই হবে, আপনি সেটা করেন প্রিভিন্টিভ মেজার হিসেবে আমরা কেউই চাই না কেউ খুন হোক, তারপরেও খুনীর শাস্তির ব্যবস্থা রাখি আইনে উদ্দেশ্য একটাই, যদি কেউ খুন করেই, সে যেন আগে থেকে জানে বা ভাবে, এর শাস্তি কী হতে পারে

এখানে বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে আন্টিসোভিয়েত শক্তির প্রবল ক্ষমতা ইচ্ছা থাকার পরেও সমাজতন্ত্রের সব সুফল নস্যাৎ করতে পারেনি ফলে তেমন না হলেও চিকিৎসাসহ অনেক কিছুই এখনও ফ্রি কিন্তু সেটা তখন সরকার করেছে হয় বাধ্য হয়ে, নয় জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে কোন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থেকে নয় এখনও অনেক কিছুই হচ্ছে পুতিনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা হস্তক্ষেপে আমলারা যে এতে খুব খুশি সেটা বলা যাবে না তাই এসব যদি সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে দেওয়া হয় আপত্তির কী আছে? বিশেষ করে করোনা ভাইরাস চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের মত না হলেও সেই ধাঁচের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কত জরুরী    

এরকম টুকিটাকি অনেক পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, যেমন মিনিমাম বেতন জীবনযাপনের   সর্বনিম্ন ব্যায়ের কম হতে পারেব না, ইনফ্ল্যাশনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেতন বাড়াতে হবে, খেলাধুলার ক্ষেত্রে সরকারি সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে, সংবিধানে বিয়ে মানে ছেলে আর মেয়ের মধ্যে বিয়েকেই বোঝানো হবে, পশ্চিমা অনেক দেশের ছেলের সাথে ছেলের বা মেয়ের সাথে মেয়ের আইনি সম্পর্ককে নয়; পরিবার বলতে বাবা-মা, ছেলে-মেয়েকেই বোঝাবে, অর্থাৎ বাবা হবে পুরুষ আর মা হবে মেয়ে, এটাও বর্তমানের পশ্চিমা টেন্ডেন্সিকে চ্যালেঞ্জ করে; আর অনেক দেশের মত পলিট কারেক্ট প্যারেন্ট ওয়ান আর প্যারেন্ট ট্যু (আমি ভেবে পাই না, ওয়ান আর ট্যু – এখানেও তো সমতা বজায় থাকে না, ওয়ান তো আর ট্যু নয়) নয়, এ দেশের সংবিধানে থাকবে বাবা আর মা। এসব আপাত দৃষ্টিতে হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু বিশ বছর আগে কী আমরা এসব ভাবতে পারতাম? তালিবান যখন আফগানিস্তানে বুদ্ধের মূর্তি ধ্বংস করে সারা বিশ্ব নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠে, আজ আমেরিকা আর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যখন মূর্তি ভাঙ্গা হচ্ছে আমরা কী নীরব নই? অত দূরে যাব কেন, হাইকোর্টের সামনে মূর্তি ভাঙ্গা নিয়েই কী কম রাজনীতি হয়েছে? আজ যদি রবীন্দ্রনাথ জমিদার ছিলেন বলে স্লোগান তোলে, তখন আমরা কী বলব? আসলে আজ যেটা অসম্ভব মনে হচ্ছে দ্রুত বদলে যাওয়া পৃথিবীতে দু’ দিন পরেই সেটা খুবই সম্ভব। তাই কিছু কিছু বিষয়ে অঘোষিত অধিকার যেসব এতদিন আমলাদের মর্জির উপর নির্ভর করেছে, সেগুলোকে সাংবিধানিক অধিকারের রূপ দেওয়া যুগের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিকার দিলেই যে সেটা রাতারাতি বাস্তবায়িত হবে এমন কোন কথা নেই, তবে কাগজে কলমে অধিকার থাকাটাই বা কম কি? আরও আছে দেশের বিভিন্ন প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিতদের ও আমলাদের অন্য কোন দেশের নাগরিক হওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা, যেটা আমাদের দেশেও  আইন করে করা দরকার বলে মনে হয়। 
 
কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়, শেষ মুহূর্তে পুতিনের পুননির্বাচিত হওয়ার এজেন্ডা তুলে একদিকে বুঝি চাইলে তিনি এসব পার্লামেন্টের মাধ্যমেই করিয়ে নিতে পারতেন আবার অন্য দিকে ক্ষমতায় যদি থাকতেই হয় প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কোন ক্যাপাসিটিতে সেটা পারতেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এর আগেও কাজ করেছেন মেদভেদেভের অধীনে, বন্ধু সির মত নতুন কোন পদও করে নিতে পারতেন তাহলে জেনেশুনে এরকম একটা এজেন্ডা নিয়ে এগুনো কেন? সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে বিরোধীরা এতে তাঁর ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছে দেখছে আবার অনেকে অন্যভাবে বলছেন বিশেষ করে করোনা পরবর্তী বিশ্বে যে অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে আর পশ্চিমা বিশ্ব পুতিন কবে যাবে কবে যাবেভেবে যখন ওত পেতে বসে আছে তখন ধরণের একটা অনিশ্চয়তা তৈরি করে একদিকে যেমন পশ্চিমাদের বাড়া ভাতে ছাই ঢালা যাবে, অন্যদিকে আমলারা যাতে খোঁড়া হাঁসের তত্ত্ব মেনে কাজে ঢিলে না দেয় সেটাও নিশ্চিত করা যাবে তবে এটাও ঠিক স্থিতিশীলতার নিয়মহল স্থবিরতা এখানে ইতিমধ্যেই এক ধরণের স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে, অসন্তোষ না হলেও আগের মত উদ্দীপনা আর নেই ১৯৯৩ সালে ইয়েলতসিনেরদা, দা, নিয়েত, দা” (হ্যাঁ, হ্যাঁ, না, হ্যাঁ) প্রচারে চারিদিক ভরে গেলেওনিয়েত, নিয়েত, দা, নিয়েতএকেবারে কম ছিল না সেদিক থেকে এখন টিভিতে বিরোধীদের তেমন দেখা যায় না, যদিও বিভিন্ন টক শোতে অনেকেই পরিবর্তনের বিপক্ষে বলছেন বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে অনেকেইআমি পরিবর্তনের বিপক্ষেলোগো লাগিয়ে বসে আছে সব মিলিয়ে যদি সবগুলো পরিবর্তন যদি প্যাকেহিসেবে না আসত সেটা হয়তো অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হত, অন্তত দশটা পছন্দের পক্ষে ভোট দিতে গিয়ে একটা দুটো অপছন্দের পক্ষে ভোট দিতে হত না দুদিন আগে পিকনিকে ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করলমার মত আমি ওদের এসব কথাই বললাম আর বললাম, পক্ষে বা বিপক্ষেযেখানেই ভোট দাও না কেন, ভোট দেওয়া উচিৎ অন্তত নিজের মতামত জানানো দরকার যদি সেটা শেষ পর্যন্ত হেরেও যায়


আমি কি যাব ভোট দিতে? জানি না কাকু প্রায়ই ডারউইনের বিয়ের গল্প করতেন তিনি নিজের কাজিনের প্রেমে পড়েন এরপর বিয়ের পক্ষে বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন দেখা যায় বিয়ের বিপক্ষে যুক্তি পক্ষের চেয়ে কয়েকগুন বেশি তা সত্বেও তিনি ডাইরির কোনায় লিখেন «তারপরেও আমি বিয়ে করব» আমি এখন জানি না অনলাইনে ভোট দেওয়ার আবেদন করেছিলাম, এখনও ভাবার সময় আছে শুধু আমারই নয়, অনেকের কাছেই একজন পরপর কতবার প্রেসিডেন্ট হতে পারবে নিয়ে সংশোধনী অন্তত এভাবে আসাটা দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে যদি দুই টার্মের ব্যারিয়ার একেবারে উঠিয়ে দেওয়া হত, সমস্যা ছিল না, কিন্তু শুধু পুতিনের জন্য এটা করা আইনের সামনে সবাই সমান সেই নীতির বরখেলাপ কসমোলজিতে আমরা মহাবিশ্বের মডেল হিসেবে স্পেস-টাইমকে হোমোজেনাস এবং আইসোট্রপিক বলে মনে করি, মানে সমস্ত বিন্দু আর দিকের সমান অধিকারে বিশ্বাস করি এই নীতির সাথে ভূকেন্দ্রিক বা সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের মডেল যায় না, একই রকম পুতিনের ক্ষেত্রেও ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত উনি রাশিয়াকে খণ্ড বিখণ্ড হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন সে জন্যে নিঃসন্দেহে রাশিয়ার ইতিহাসে তাঁর নাম লেখা থাকবে ২০০৭ সালে মিউনিখ ভাষণের আগে পর্যন্ত পশ্চিমের সাথে তাঁর সম্পর্ক মোটামুটি ভালো ছিল সময়ে তিনিই প্রথম বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার মনোপলির সমালোচনা করেন এটা অনেকটা পাড়ার মস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষীণ হলেও আওয়াজ তোলার মত যতদিন না কেউ প্রতিবাদ করে মস্তান নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে যা ইচ্ছে তাই করে, কিন্তু যদি একবার কেউ প্রতিবাদ করার সাহস দেখায় পরে অনেকেই সেটা করে এই বিশ্বে বাস করে আমেরিকার সাথে যে দ্বিমত প্রকাশ করা যায় সেই পথ তিনিই দেখান এটাও নিঃসন্দেহে পজিটিভ তবে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকা তখন অনেকেই ভালো ভাবে নেয়নি তবে ২০০৮ সালে জর্জিয়া দক্ষিণ অসেতিয়া আক্রমণ করলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়, লোকজন তখন ভাবতে শুরু করে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার এই ঘুরে দাঁড়ানো সহজে হজম করবে না এরপর আসে ২০১৪, ক্রিমিয়া ইত্যাদি আজকে যে করোনা যুদ্ধ, সেখানেও তাঁর উপস্থিতি সবাই অনুভব করেছে এরকম পরিস্থিতিতে শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়জনীয়তা অপরিসীম কিন্তু প্রশ্ন হল এত বছরেও কেন তিনি যোগ্য উত্তরসূরি (আক্ষরিক অর্থে নয়) তৈরি করতে পারলেন না, এমন একটা পলিটিক্যাল দল বা সিস্টেম দাড় করাতে পারলেন না যা তাঁর শুরু করা কাজ সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারত রুশরা বলেপ্রতিভাবান বাবামায়ের ছেলেমেয়েদের উপর প্রকৃতি অবসর যাপন করে একইভাবে শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরে সব দেশেই উপযুক্ত উত্তরসূরি পেতে সমস্যা হয়, তারপরেও অনেকেই মনে করে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক বলয় থেকে বের করতে না পারা পুতিনের অন্যতম ব্যর্থতা যদিও সংশোধনীতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হয়েছে, করোনা কালে অনেক কিছুই কেন্দ্রের হাতে না রেখে এলাকার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তবুও মনে হয় একটু দেরি হয়ে গেছে আবার একই সাথে চলছে পশ্চিমা বিশ্ব আর তাদের স্থানীয় দোসরদের প্রোপ্যাগান্ডা। এরকম খবর ছড়ান হচ্ছে যে নির্বাচনের পরেই আবার লকডাউন আসবে। বলা হচ্ছে সোভিয়েত স্টাইলে বিভিন্ন কোম্পানির শ্রমিকদের সংশোধনের পক্ষে ভোট দিতে বলা হচ্ছে, কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে সেই কোম্পানি পাঁচ বছর আগেই পাত্তারি গুটিয়েছে। সব মিলে প্রোপ্যাগান্ডা আর ফেক নিউজে ভারী আজ বাতাস। উল্লেখ করা যেতে পারে, শত ব্যর্থতার মধ্যেও ইয়েলতসিন পুতিনকে তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে বসাতে পেরেছিলেন, এটা ছিল তাঁর অত্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সফল সিদ্ধান্তের একটি। পুতিন যদি তাঁর পরে সেরকম যোগ্য কারও হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে না পারেন সেটা হবে তাঁর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। মনে রাখা দরকার, পশ্চিমা দেশগুলোতে শত বছর ধরে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে, সেখানে একটা সিস্টেম দাঁড়িয়ে গেছে। রাশিয়ায় সে চর্চার বয়স মাত্র তিন দশক, তাই সিস্টেমের চেয়ে ব্যক্তিত্ব এখানে এই মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
              
আমার এ লেখার উদ্দেশ্য কাউকে পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিতে ডাকা নয়। যেসব ব্যাপার আজ সমস্যা বলে মনে হয় না, দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে সেটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত আমাদের শান্ত জীবনকে তছনছ করে যাতে না দেয় সে জন্যে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। মানব সমাজ এক দিনে আজকের অবস্থানে আসেনি, এর পেছনে আছে দীর্ঘ ইতিহাস। সে ইতিহাস সুখে দুঃখে ভরা, বিজয় গৌরব আর পরাজয়ের গ্লানিতে ভরপুর। সময়ের সাথে সত্যও চেহারা বদলায়, গতকালের ভালোটা আজকে খারাপ হতেই পারে। কিন্তু গতকালকে জীবন থেকে মুছে ফেলে যেমন আজকের দিনে আসা সম্ভব নয়, অতীতের সাফল্য ব্যর্থতা অস্বীকার করেও বর্তমানে বাস করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি মানুষের মত সমাজ আর দেশও জীবন্ত, গতিশীল। সমাজের, দেশের শিরা-উপশিরা, নার্ভ – এসব যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা মানুষের চলা, বলা, ভালো লাগা, মন্দ লাগা – এসব। কোন দেশে যেমন ফুটবল মায়ের দুধের সাথে আসে, তেমনি কোন কোন দেশে আসে ক্রিকেট বা অন্য কোন খেলা। একই ভাবে রাজনৈতিক ধারা বা চর্চাও একে দেশে একেক রকম। সেটা মাথায় রেখেই সবাইকে তার নিজের পথটা খুঁজে নিতে হবে, নিজের দেশের জন্য উপযোগী সংবিধান গ্রহণ করতে হবে।

দুবনা, ২৭ জুন ২০২০


Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি