গল্প নিয়ে গল্প ২

কিছু দিন আগে আমি "গল্প নিয়ে গল্প" নামে একটা নোট লিখেছিলাম, যেখানে সোভিয়েত
দেশে পড়া আমার বন্ধুদের লেখা নিয়ে কথা হচ্ছিলো (http://bijansahawhispers.blogspot.ru/2016/10/blog-post_20.html)।
যতটা না লেখা নিয়ে, তার চেয়ে বেশি লেখকের অধিকার নিয়ে।
ওখানে কয়েকদিন আগে আমার বন্ধু মাসুদ লিখলো "তবে পলিট-কারেক্টনেস এবং লেখকদের
প্রতি তোর প্রফেশনাল সলিডারিটি প্রকাশ পেয়েছে।" কি বলবো, আমি নিজেকে লেখক বলে
ভাবি না, কারণ একটাই, পড়তে পারি নাতো, তাই লিখি। শুনিস নি, "চুকচা পাঠক নয়,
চুকচা লেখক। (Чукча не читатель, чукча писатель)" শোন, তোকে কানে কানে
আরো একটা কথা বলি, "আমি এমনকি নিজের লেখাও পড়ি না। সময় নেই। আমার কাজই
তো পড়াশুনা করা। ওই ফিজিক্সের আর ম্যাথের পেপার পড়তে পড়তেই দিন কেটে যায়।
তাই যেটুকু সময় পাই, পড়ি ক্ল্যাসিক্যাল লিটারেচার, রাশিয়ান ও ওয়েস্টার্ন।
আসলে জানিস কি, ফিজিক্সের আর ম্যাথের উপর লেখা পড়তে পড়তে একটা বদভ্যাস
হয়ে গেছে, সব থেকেই কিছু একটা শিখতে চেষ্টা করি, কিছু পেতে চাই নিজের জন্য। তাই
পড়ি সাধারণত: সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ন সব লেখা।"
যেহেতু দু কথায় তোর প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা ঠিক হবে না, তাই একটা আলাদা নোট লিখছি।
কষ্ট হবে, তবুও পড়িস।
সোভিয়েত বন্ধুদের লেখায় আমি যতটা না সাহিত্য খুঁজি, তার চেয়ে বেশী খুঁজি নিজেকে।
জানিসতো আমি ছবি তুলি। ২০১২ তে আমি বাংলাদেশের উপর একটা প্রদর্শনী করি, নাম
"ছেলেবেলায় ফিরে যাওয়া (Back to the childhood)।" ওই সময় স্থানীয় পত্রিকা
থেকে প্রদর্শনীর উপর ইন্টারভিউ নেয়, জানতে চায় আমি কেন ছবি তুলি। আগে যে জানতাম
না কেন ছবি তুলি, তা নয়, তবে ওই প্রথম সেটাকে ভাষায় রূপ দিলাম -
১) আমি ছবি তুলি আগামীকাল আজকের অমিকে দেখার জন্য। ১৯৮৩ তে যখন এ দেশে আসি, ছবি তোলার উদেশ্য ছিল দেশে ফিরে গেলে সবাইকে যেন দেখাতে
পারি কোথায় থাকি, মানে যেখানে ঘটনা ঘটলো সেই জায়গা থেকে রিপোর্ট করা। পরে দেখলাম
মানুষের থেকে প্রকৃতির ছবি তুলতেই বেশী ভালো লাগে আমার। আর ছবি তুলি, যখন সেটা
করতে আমার ইচ্ছে করে. আবহাওয়া বা অন্য কোনো কিছু হিসেবে আসে না। ওই অর্থে আমি আমার
настроение বা মুডের ছবি তুলি। তাই বলতে পারো, আমি এখন থেকে অনেক পরে দেখতে চাই
ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন তোমার সাথে হাটছি, কথা বলছি আর ছবি তুলছি, আমার মনের অবস্থা
কেমন ছিল। ২) আমি ছবি তুলি আমার একাকীত্ব থেকে মুক্তি পেতে বা একাকিত্বে নিজেকে বিসর্জন দিতে। দেখ, আমি দুবনায় একা থাকি। দেশ থেকে অনেক দূরে। প্রিয় কাজ, প্রিয় বন্ধুরা - সবই আছে,
তার পরেও কখনো কখনো একাকী লাগে। ছবি তুলতে গিয়ে ভোলগার তীরে যখন আমি হাটি,
যেন আমার গ্রামে কালিগঙ্গার তীরে চলে যাই। ছবি আমাকে একাকীত্ব থেকে মুক্তি দেয়। আবার
দেখো, কখনো কখনো আমি কোন অনুষ্ঠানে যাই। প্রচুর লোকজন, বন্ধুবান্ধব। কিন্তু কিছুক্ষন
পরেই আমি হাপিয়ে উঠি, তখন ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতে শুরু করি, যতটা না ছবি তুলতে
তার চেয়েও বেশি এই জনারণ্যে হারিয়ে যেতে। ৩) আমি ছবি তুলি এই মুহূর্তে একান্ত আপনার থাকতে। হ্যারে মাসুদ, আমার বন্ধুদের লেখা রুশ দেশের স্মৃতিকথা সেই ছবির মতোই, আমাকে নিয়ে যায়
সেই দিনগুলোতে, দেখতে পাই অনেক চেনা মুখ, মনে হয় আমিও যেন সেখানে ছিলাম। নানা,
এটা দস্তয়েভস্কির "সাদা রাত" (Белые ночи) পড়ে লেনিনগ্রাদে সেই নায়ক-নায়িকাদের
খুঁজে বেড়ানোর মতো নয়, বা তলস্তয়ের "যুদ্ধ ও শান্তি" (Война и мир) পড়ে নাতাশা রোস্তভার
খুঁজে অত্রাদনাযায় যাওয়া নয়। এটা অন্য রকম অনুভূতি। আমার মনে হয় আমরা যারা সোভিয়েত
দেশে পড়েছি, ওই সব লেখায় নিজেদের খুঁজি। মনে আছে, যখন আমরা এদেশে আসি বা পরে বেড়াতে
যাই দেশে, সবাই বলতো তোমাদের মগজ ধোলাই করা হয়েছে। আমার মনে পরে না। করলে নিশ্চয়ই
টের পেতাম। এই দেখ, আমি আমেরিকায় যাইনি কখনো। কিন্তু ঠিকই এখন ভোগবাদী হয়ে গেছি,
সামর্থের বেশি খরচ করে দিব্যি আছি। অনেক সময় নিজেকে পাইপের মতো মনে ময়। কেমিস্ট্রির
ল্যাবরেটরীর নল যা দিয়ে দুটো বোতলকে যোগ করা হতো। আমিও ঠিক ওই পাইপের মতো দুটো
ব্যাংককে যোগ করি, এক ব্যাংক থেকে ধার করে অন্য ব্যাংকের টাকা শোধ করি। তবে কাঁচের নল
তাতে ক্ষতিগ্রস্থ হতো না, কিন্তু আমি যখন নল হিসেবে কাজ করি, ব্যাংকগুলো আমার রক্ত চুষে নেয়,
এই আর কি। তাই সোভিয়েত দেশ আমাদের মগজ ধোলাই করতে না পারলেও আমেরিকা ঠিকই
পেরেছে, শক্তিশালী রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে। তাই বলে সোভিয়েত ট্ দেশ যে কিছুই করে নি তা নয়।
গত বছর গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠানে এক বড় ভাইয়ের সাথে
দেখা। জিজ্ঞেস করলাম, - আচ্ছা ফেসবুকে আপনাদের ছবি দেখে মনে হয় আপনারা শুধু রুশ বা রুশ ফেরৎ বাংলাদেশীদের
সাথেই সময় কাটান। কানাডাতে তো অনেক বাংলাদেশী। - ওদের সাথে আমাদের পরে না। মজা পাই না। কি যেন একটা মিস করি। আমার মনে হয় এই কি যেন সেই "রহস্যময় রাশান মন" (загадочная русская душа) যেটা
কিছুটা হলেও আমরা সবাই পেয়েছি, তাই সব কিছুর পরেও এই দেশ, এ দেশের স্মৃতি এতো ভালো লাগে।
তাছাড়া ওটা আমাদের যৌবনের স্মৃতিও বটে। তাই তো বন্ধুদের স্মৃতিকথা পড়তে আমাদের এতো ভালো
লাগে, ওখানে আমরা নিজেদের যৌবন খুঁজি, নিজেদের ভালোলাগা, ভালোবাসা খুঁজি। আর ওটা করতে গিয়ে
এমনকি কোনো কাল্পনিক চরিত্রেও নিজেদের পরিচিত মুখ খুঁজি। তাই এতো কথা, এতো গুঞ্জন। আমার
আগের লেখাটা ছিল ওই গুঞ্জনের প্রতিবাদে। তার মানে এই নয় ওখানে সবই আমার ভালো লাগে। যেহেতু
তুই কথাটা তুললি, তাই ওদিকটায় একটু যাবো। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। জানিনা অন্যদের চোখে
এটা পড়েছে কিনা। যেহেতু তুই শিহাবের লেখা নিয়ে কথা বলছিস, তাই ওটা নিয়েই কিছু কথা বলবো। আমি সবগুলো লেখা
পড়িনি, প্রথম দিকের গুলো পড়া হয়নি। তবে শেষের প্রায় সবই পড়া। এখনো ঠিক কোন ধারায় এটা
লেখা, বুঝে ওঠা কঠিন। অনেকটা ডাইরির মতো, যখন যে ঘটনা ঘটে, তার নোট রাখা। কখনো কখনো,
বিশেষ করে যে লেখাগুলো নিয়ে এতো তোলপাড় এটাকে আমার শফিক রেহমানের "যায় যায় দিন" এর
মতো মনে হয়, মানে স্টাইলটা। আবার কিছু লেখায় প্রাচীন গ্রিক বা জার্মান সাহিত্যের অনবদ্য
উপস্থাপনা লেখাকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। কখনো আসে দেশীয় রাজনীতির কথা, কখনো সোভিয়েত
রাজনীতির। শুধু এই লেখাই না, আমার অনেক পরিচিতই ব্যক্তিগত কথোপকথনে সেই সময়ে
কমরেডদের দোষারোপ করে তাদেরকে বাইরে যেতে না দিতে বা অন্য কোনো লোককে ছাত্র সংগঠনের
দ্বায়িত্ব অর্পণ করতে না দিতে। আমি একটা জিনিষ বুঝি না, সবাই ছিল প্রাপ্ত বয়ষ্ক, কেউ কাউকে ধরে
রাখেনি, চাইলেই অন্য দলে যাওয়া যেত। অন্য ভাবে চলা যেত। নিজের চিন্তাভাবনা প্রকাশ বা প্রতিষ্ঠা
করার দায়িত্ব নিজের, যদি কেউ সেটা না পারে, তা তাদের দুর্বলতা। এখন ঢালাওভাবে অন্যদের দোষ
দেয়া অনেকটা বন্ধুদের পিঠে ছুরি মারার মতো। আমি তাই মনে করি। এখন ওই সময়ের অনেক কিছুই
আমার ভালো লাগে না, তবে আমি এ জন্য অন্যদের দোষ দেই না, ওটা ছিল সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত।
এখন যদি কারো ভুল স্বীকার করার ইচ্ছা থাকে, নিজের পক্ষ থেকে করলেই হয়। কেননা আমি একটা
জিনিষ খেয়াল করেছি, ভুলটা শুধু আমরাই স্বীকার করি, অন্যদের যেন কোনো ভুল ছিল না। তখন
দুটো পথ ছিল। যদি আমাদের পথ ভুল হয়, মানে অন্য পথটা ঠিক। আসলেই কি তাই? সেখানেও অনেক
ভুল ছিল। ভুল স্বীকার করা ভালো, তবে তা যেন এমন না হয়, যাতে করে অন্য পথটাকে ঢালাও ভাবে
সঠিক বলে মেনে নেয়া হয়। আমার বিশ্বাস, আমার বন্ধুরা, যারা এটা বলেন বা লিখেন তেমনটা ভাবেন না। আরো কিছু ব্যাপার, যা আমার ভালো লাগেনি। বিশেষ করে সোভিয়েত সমাজ নিয়ে কিছু ঢালাও মন্তব্য।
একটা লেখা পরে মনে হয়েছে এই দেশের পুরুষেরা মাতাল, অকর্মন্য আর মেয়েরা সহজলভ্য। আসলেই
কি তাই? এদেশে মেয়েরা প্রচুর কাজ করে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তবে তখন আর্মিতে ছিল মূলত
ছেলেরা, খনিতে কাজ করতো ছেলেরা, বৈজ্ঞানিকদের অধিকাংশ ছিল ছেলেরা। আমি এখানে নারীর
বিরুদ্ধে বলছি না, শুধু এটুকুই বলছি, শিহাবের কথা সত্য হলে এদেশে বৈজ্ঞানিক, খনি শ্রমিক,
মহাকাশচারী, সৈনিক কিছুই থাকতো না, দেশই থাকতো না, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যেটা
হতো না। তাই এসব ঢালাও ভাবে লেখার আগে চারিদিকে একটু তাকিয়ে দেখলে ভালো হয়।
হতে পারে ডাক্তারদের অধিকাংশ মহিলা, তবে ফিজিক্সে, ম্যাথে, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সে সংখ্যাটা কম। মেয়েদের নিয়ে ঢালাও মন্তব্য বেশ হাস্যকর। হয়তো ভাবতে পারেন, আমার নিজের বৌ, মেয়েরা
রাশান বলে (মেয়েরা রাশান, কেননা ওরা এখানেই মানুষ, এখানকার সংস্কৃতির সাথেই ওতপ্রোতভাবে
জড়িত) আমি এটা বলছি। শিহাবের ওই লেখাটা পড়ে সাথে সাথে এক হিসেবে করে দেখলাম, ওই
সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের জনসংখ্যা ছিল ২৭০ মিলিয়ন। যদি ধরে নেই তার অর্ধেক মেয়ে
(যদিও সংখ্যাটা বেশী) তাহলে মেয়েদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩৫ মিলিয়ন। ওই সময় এ দেশে কি ১
মিলিয়ন বিদেশী ছিল? যদি ধরে নেয়া যায় ১ মিলিয়ন, আর সবার যদি রুশ বান্ধবী থাকে তাহলে
সংখ্যাটা ১ মিলিয়ন। এটা ১% এর কম। তাই এসব ঢালাও মন্তব্য দুঃখজনক। কেননা গল্পের
চরিত্রের মতো এসব বিবৃতিকে কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দিতে পারবেন না লেখক। এসব মন্তব্য যারা
এ দেশে ছিল না, এ দেশ সম্পর্কে জানে না, তাদের কাছে ভুল ম্যাসেজ দেয়, যা অনেকটা সিনেমার
২৫ নম্বর স্ন্যাপের (২৫ кадр) মতো কাজ করে। বর্তমানে যেভাবে রাশিয়াকে নিয়ে অপপ্রচার
চলছে, সোভিয়েত দেশের ইতিহাস যেভাবে মুঁছে ফেলা হচ্ছে - এ সব মন্তব্য যদিও সেই মূলধারায়
পরে, তবে একজন সোভিয়েত ফেরত বিশেষজ্ঞ, যে নিজেকে প্রগতিশীল বলে দাবী করে তার কাছ
থেকে এরকম হালকা কিন্তু একটা দেশের ও জাতির ভাবমূর্তি নষ্টকারী এ সব মন্তব্য দুঃখজনক।
সব কিছুর পরেও আমাদের বর্তমান সাফল্যের ভিত্তি আমরা এদেশেই পেয়েছি, আমাদের দেশটাও
ভারতের সাথে সাথে শত দোষে দোষী সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যেই স্বাধীন হয়েছে। দুবনা, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি